আমার শিক্ষক, আমার মা
রাকিব হাসান:
গ্রামের স্কুলে প্রাইমারীতে পড়ি। বর্ণগুলো তখনও ঠিকমত লিখতে পারিনা। আর যোগ- বিয়োগ করতে দিলেতো এক ডজন ভুল করে বসতাম। শুধুই ধমক আর মার খেতাম। বাবার ভয়ে এমনিতেই অর্ধেক ভুল করে বসতাম। বাবা বলতেন অমনোযোগী, গাধা ছেলে। একে দিয়ে কিছু হবেনা।
হঠাৎ বদলে গেল আমার শিক্ষক। এ শিক্ষককে আমি ভয় পাইনা। অনেক মমতা নিয়ে পড়ান তিনি। ভুল করলেও বিরক্ত হননা। তার কোলে বসেই অংক করি, কখনও কাঁধে চড়ে বসি। একেকটা অংক করার পর মেটানো হয় যত আবদার। দ্বিগুণ উৎসাহে আমি পড়তে শুরু করি। হঠাৎ করে ভালো ছাত্র হয়ে উঠি। বাবার চোখে রাজ্যের বিস্ময়।
পরীক্ষার সময় যেন পুরো বাড়িটাই হয়ে ওঠে পরীক্ষার হল। গোসল করতে করতে নামতা পড়া, খেতে খেতে কবিতা বলা, আর চুল আচড়াতে আচড়াতে শব্দার্থ বলা।
ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ প্রতিটি ক্লাসে পরীক্ষার পর চলত আবার পরীক্ষা। পুকুর পাড়ে চালতা গাছটার নিচে পাটিতে বসে দিতে হতো সে পরীক্ষা। লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা। অংক বা ইংরেজি কোথাও ভুল হলে শুরু হতো আবার বুঝিয়ে দেয়ার পালা। এরপর বিশ্রাম। হারিকেনের আলোয় সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো পরের দিনের পরীক্ষার প্রস্তুতি। কিছুক্ষণ পরপর টেবিলে চলে আসতো ধোঁয়া ওঠা গরম দুধ অথবা কোন শরবত। ঘুমানোর আগে চলত প্রস্তুতি যাচাই পরীক্ষা। তারপর ঘুম। পরদিন জম্পেশ একটা পরীক্ষা দেয়া। আর ফলাফল ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ প্রতিটি ক্লাসেই শীর্ষস্থান। যে শিক্ষকের বদৌলতে এই অভাবনীয় ফলাফল, তিনি আর কেউ নন আমার মা। আমার পৃথিবী।
বছর শেষে যখন ফলাফল ঘোষণা হতো আমার দাদা গর্বের হাসি দিয়ে হেডমাস্টারের হাত থেকে মার্কসিট গ্রহণ করতেন। আর আমি দাদাভাইয়ের কাছ থেকে মার্কসিট নিয়ে দৌঁড় দিতাম মায়ের কাছে। অংক, ইংরেজি ধর্মসহ সব বিষয়ে লেটার। নম্বরপত্র দেখে মায়ের মুখটা খুশিতে ভরে উঠতো। আর বলতেন আরো বেশি মার্কস পাবার যোগ্যতা আমার আছে। উত্তর লেখার সময় আরেকটু সচেতন হলেই হতো।
বাবার চাকুরীর সুবাদে হাইস্কুল পড়তে হলো চট্টগ্রামে। নতুন স্কুল, নতুন পরিবেশ, সব অচেনা ক্লাসমেট। ভালো লাগতো না। মা ভরসা দিলেন, ভয় নেই, ভালো করে পড়াশোনা করো এরাই হবে তোমার ভালো বন্ধু। কয়েক মাস না যেতেই জুটে গেল অনেক বন্ধু। তবে গ্রামের স্কুল থেকে এসেছি শুনে ক্লাস টিচার খুব একটা পাত্তা দিলেন না। ক্লাস সিক্স থেকে যখন সেভেনে উঠলাম নিজের সেকশনে ফাস্ট আর চার সেকশন মিলে সেকেন্ড। বন্ধুরাতো অবাক, সাথে ক্লাস টিচার মকসুদুল করিম স্যারও। স্যার ক্লাসে বলেই ফেললেন তুমি এতা ভালো রেজাল্ট করলে কীভাবে? কে পড়ায় তোমাকে? বললাম ‘মা’। তারপর বললেন, তোমার মাকে সালাম দিও।
ক্লাস সেভেন। কর্নেল হাট স্কুল আর বাসা ছাড়া কিছুই চিনিনা। মাকে না বলে বিকেলে ফুটবল খেলার পর, এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে তার বাসায় গিয়েছিলাম কিন্তু ফিরে আসতে অনেক দেরি হয়ে যায়। রাত তখন ১০ টা। মা বিভিন্ন দিকে আমার খোঁজে লোক পাঠিয়েও যখন খুঁজে পেলো না তখন থেকে ৬ ঘন্টা ধরে গেইটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাসার গেটে আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না…আজোও ভুলিনি। এখনও মাঝেমাঝে স্বপ্নে দেখি মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। কর্নেল হাটের সেই বাসা। সেই গেট।
চার বিষয়ে লেটার মার্কস সহ যেদিন এসএসসি পাস করলাম সেদিন মা ছিলেন খুশীতে আত্বহারা। মনে হয়েছিলো, এটা আমার না, মায়েরই রেজাল্ট। আসলেইতো তাঁর রেজাল্ট। আমার মতো গাধা ছেলেকে দিয়ে এতো ভালো ফলাফল তাঁর মতো শিক্ষককে দিয়েই সম্ভব। আমার ফলাফলে আত্নীয় স্বজন সবাই খুব খুশি, কিন্তু এতটা খুশী আর কাউকে হতে দেখিনি।
এইচএসসিতে ভর্তি হই সিটি কলেজে। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠতেই ধরা পড়ে মায়ের কঠিন অসুখ। বাইরে বাইরে থাকি, বাসায় কম আসি। মায়ের কষ্ট দেখে বাসায় আসতে মন চাইনা। পড়াশোনায় মন নেই। মাঝে মাঝে মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করলেই ভাল হয়ে যাবে। মা কেমন যেন আত্ববিশ্বাস নিয়ে থাকেন তিনি ভালো হবেন। তাঁর সন্তানদের জন্য তাকে ভালো হতেই হবে। এরই মধ্যে তাঁর কষ্ট বাড়তে থাকে, ডাক্তার অপারেশনের পর জানান ক্যান্সারের প্রাথমিক ধাপ। কেমোথেরাপিতে ভালো হবেন। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। আমার পড়তে ইচ্ছে করেনা। আমার ভাবনা অনেক টাকা যদি থাকতো । পৃথিবীর সেরা হাসপাতালে নিয়ে যদি চিকিৎসা করাতে পারতাম। মা ভালো হতো। ভাবি আর নিরবে কাঁদি। একা একা কাঁদি। পরীক্ষা চলে আসে। এই প্রথম একটি পরীক্ষা দিই কোন প্রস্ততি ছাড়াই। ফলাফলে চরম বিপর্যয়। সেকেন্ড ক্লাস। এই ধরনের রেজাল্ট আমার কাছে কেউ ভুলেও আশা করেনি। মা এমনিতেই অসুস্থ। আমার ফলাফলে ভীষণ ভেঙ্গে পড়লেন। আমাকে জড়িযে ধরে হাইমাউ করে কাঁদলেন। এই প্রথম দেখলাম আমার আত্মবিশ্বাসী মায়ের দুচোখে রাজ্যের হতাশা। কয়েক মাস পর তাঁর শরীর আরো খারাপ হতে থাকলো। বাবা জানালো ডাক্তারদের চিকিৎসায় আর কোন কাজ হচ্ছেনা। আর কিছুই করার নেই। আমি বললাম বিদেশে নিয়ে যেতে। বাবা বললেন আমি সরকারী চাকুরীজীবী। অত টাকা আমার নেই॥ বললাম গ্রামে জায়গা জমি যা আছে সব বিক্রি করে দিতে। মা বেঁচে থাকলে সব হবে। শেষ পর্যন্ত কিছুই বিক্রি করতে হলো না। আমার নানা আর ছোট মামা ইন্ডিয়া যাবার ব্যবস্থা করলেন। ভাবলাম এবার ভালো হযে যাবে আমার মা।
এরই মধ্যে জেদ চাপলো রেজাল্ট খারাপ হয়েছেতো কি হয়েছে ? খারাপ স্টুডেন্টতো আমি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো একটি সাবজেক্টে ভর্তি হতে হবে। মায়ের বিষণ্ণ চেহারাটা মনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপক প্রস্তুতি নিলাম। মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকায় ভাইভার জন্য ডাকা হলো। ভাইভা বোর্ডে ছিলেন ফ্যাকাল্টির ডিন। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক। তার অনুরোধ স্বত্ত্বেও ইংরেজি বাদ দিয়ে আমি ভর্তি হলাম চবি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। পছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে পড়া শুরু করলাম। ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস শুরু হল।
এদিকে ইন্ডিয়ার ডাক্তার সব পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালো এখন আর কিছুই করার নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে নিযে আসলে কিছু করা যেতো। বাংলাদেশে সঠিক চিকিৎসা হয়নি। কয়েকমাস ইন্ডিয়া থাকার পর এবার মাকে দেশে নিয়ে আসা হলো। ততক্ষণে মা বুঝে গেলেন তিনি আর বাঁচবেন না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির খবর শুনে তিনি খুশি হলেন। কিন্তু ডাক্তাদের বেঁধে দেয়া সময় শুনে আমি হতাশায় ভেঙে পড়লাম। তাঁকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। ঐদিন আমাকে তিনি সান্তনা দিলেন-‘ কারও মা চিরজীবন বেঁচে থাকেনা। ভালো করে পড়াশোনা করো, মানুষের মত মানুষ হও, নামায পড়ো, নিজের আত্বসম্মানবোধ ধরে রেখো, বাবা এবং ছোটভাইদের দিকে খেয়াল রেখো। এই তাঁর সাথে শেষ কথা। এরপর আর ঠিকভাবে কথাই বলতে পারেননি। এর দুদিন পর ( ২০০২ সালের ১৯ই অক্টোবর) মা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমি শুধু মাকেই হারলাম না , হারালাম আমার একজন শিক্ষককেও।
মা চলে যাবার পর কত রাত না ঘুমিয়ে কেঁদেছি। কিন্তু পড়ালেখা চালিয়ে গেছি। ১৮ বছরের একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলে থাকা, হলের অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়া। এটা যে কত কষ্টকর ছিলো তা তুমি না থাকাতে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছি ‘মা’। যাদের মা নেই তারাই শুধু বুঝবে এই কষ্ট।
মা, আমি তোমার কথামতো পড়াশোনাটা ভালোভাবেই করেছি, অনার্সে ফাস্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছি, আর মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হয়েছি। তবে রেজাল্ট যখন হাতে পেয়েছি তখন তোমার খুশিতে ঝলমল করা চাঁদমুখটা আর দেখা হয়নি। আমার রেজাল্টে তোমার মতো কেউ আর আত্মহারা হয়নি।
তোমার ছেলে হয়তো বড় কিছু হয়নি, ভালো রেজাল্ট স্বত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়নি, বিসিএস ক্যাডার হয়নি। তবে যে পেশায় আছি, সেখানে নানা প্রলোভন স্বত্বেও কখনও কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি। নিজের আত্বসম্মানকে বিসর্জন দিইনি।
প্রায় এক যুগ হলো তোমাকে হারিয়েছি ‘মা’..তোমাকে স্বপ্নে দেখে এখনও ঘুম থেকে জেগে উঠি, চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি আর তোমার জন্য কান্না করি। অত:পর ভাবি মানুষ কি হতে পেরেছি? পেরেছি কি তোমার যোগ্য ছেলে হতে?
রাকিব হাসান
লেখক: সাংবাদিক
=====
নিচে আরও কিছু লেখার লিংক দেওয়া হল: