একজন ভাষাসৈনিক নারীর কথা

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৭ সময়ঃ ১২:১৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:২৭ অপরাহ্ণ

Sharifa-2ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখার জন্য এ বছর একুশে পদক পেলেন অধ্যাপক শরিফা খাতুন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নেতারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করার জন্য সেখানে সমাবেশের আয়োজন করেন। শরিফা খাতুন তাদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে অংশগ্রহণ করেন।সেই উত্তাল একুশের ৬৫ বছর পর আজ পেলেন সম্মাননা।

ভাষাসৈনিক ড. শরিফা খাতুন ১৯৩৬ সালের ৬ ডিসেম্বর সে সময়ের ফেনী মহকুমার শর্শদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মোহাম্মদ আসলাম এবং মায়ের নাম জেবুন্নেছা চৌধুরানী। নোয়াখালী সদরের উমা গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স, ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করেন।

বাবা আসামের রেলওয়েতে চাকরি করতেন। জন্মের সময় বাবা-মা ফেনীতে আসেন। সেখানেই তাঁর জন্ম হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে আসামের লঙ্কা-ডিপুতে থাকতেন। সেখানে বাঙালিদের কোনো স্কুল ছিল না। অসমিয়া ভাষার স্কুল ছিল। তখন বাবা-মা তাঁর লেখাপড়া নিয়ে ভাবতে লাগলেন। শরিফার খালা-খালু কুমিল্লা শহরে থাকতেন।  তিনি কুমিল্লায় খালুর বাসায় থেকে শহরের লুৎফুন্নেসা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

তখন  চাচা তাঁকে ফেনীতে এনে ভর্তি করান। সেসময় ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তি দেয়া হতো। তিনি নোয়াখালী স্কুল থেকে বৃত্তি পান। ওই সময় ফেনীতে জাপানিরা বোম্বিং করেছিল। স্কুল এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোকজন বসবাস করত। তারা খুব সচেতন ছিল। ওখানে ব্রিটিশ আন্দোলন হয়েছে। স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দু’একটি মিছিলেও তিনি গিয়েছেন।

১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আসে। জিন্নাহ ৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখন আন্দোলনটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নোয়াখালীতে তখন মিছিল হয়েছে বাংলা ভাষার পক্ষে। স্কুলের ছাত্রীদের সাথে শরিফাও সে মিছিলে অংশ নেয়। মূল আন্দোলন ঢাকায় হলেও ওই সময় বাংলা ভাষার ব্যাপারে সবার মধ্যে একটা চেতনা তৈরি হয়েছিল। শরিফা তখন খালুর বাসায় থাকতেন। খালু ছিলেন আইনজীবী। বাসায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আসত। সেগুলো পড়েই তিনি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নানারকম তথ্য পেতেন।

১৯৫১ সালে শরিফা ইডেন কলেজে ইন্টারে ভর্তি হন। তিনি মফস্বল থেকে এসেছিলেন বলে হোস্টেলে সিট পেয়ে যান। হোস্টেলের রিডিং রুমে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আসত। বান্ধবীদের সাথে তিনিও সেগুলো পড়তেন। তখন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন বেশ চাঙা।

১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে খাজা নাজিমুদ্দিন  ঢাকা আসেন। তিনি পল্টনের জনসভায় ঘোষণা দিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানের সে সময়ের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ’৫২-এর ২৭ জানুয়ারি জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন। এই ঘোষণাই মূলত একুশের পরিবেশ তৈরি করে। খাজা নাজিমুদ্দিন  রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের চাপে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে গণপরিষদে কথা বলবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার প্রতিশ্রুতি রাখলেন না। ছাত্ররা প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। সে প্রতিবাদের প্রভাব ইডেনের হোস্টেলে এসে পড়ল। michil 1

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভা হয়। সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেয়া হয়। গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সভা ডাকে। ইডেন গার্লস কলেজের ছাত্রীরা সে সভায় অংশগ্রহণ করে।

সেই সময় চিঠির যে খাম ছিল তাতে উর্দু এবং ইংরেজি লেখা ছিল। কোনো বাংলা লেখা ছিল না। এটা শরিফার কাছে খুব খারাপ লাগতো। ৪ ফেব্রুয়ারি যে মিটিং হয় সেখানে তিনি গেলেন। সে সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইডেন কলেজের জিএস মনোয়ারা বেগম। আরো ছিলেন  জেবুন্নেসা, লুৎফুন্নেসা, শাহাদত আরা, আমিরুন্নেসা, রওশন জাহান হেনা, ফিরোজী বেগম, সুফিয়া খাতুন, রাহাত আরা, শহর বানু।

মিটিংয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁরা আন্দোলনের পক্ষে পোস্টার লিখে দেয়ালে সাঁটাতেন। সবার মুখে একটাই আলোচনা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা সংবলিত ব্যাচ বিলির কাজ করেছেন তিনি। তাঁদেরকে আরেকটি দায়িত্ব দেয়া হলো যে, মেয়েদের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বোঝাতে হবে। শরিফাসহ কয়েকজন ছাত্রী মুসলিম গার্লস স্কুলে গেলেন। মুসলিম স্কুলে দারোয়ান তাঁদের ঢুকতে দিল না। তাঁরা বললেন, কয়েকজন ছাত্রীকে ডেকে দেন। দারোয়ান ডেকে দিল। ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির কথা জানান শরিফার দল।

২০ ফেব্রুয়ারি  বিকেলে হঠাৎ করে শরিফারা শুনতে পান মাইকিং হচ্ছে, পরদিন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। রাত ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলের ছাত্র নেতারা ইডেন কলেজের গেটে এসে  জি এসকে জানালেন, ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা হবে। ইডেনের মেয়েদের সবাইকে যেতে হবে। ২১ তারিখ সকালে ৯টার দিকে আমতলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো সবাই। সকালে ইডেনের গেট বন্ধ ছিল। কেউ দেয়াল, কেউ গাছ বেয়ে দেয়াল পার হলেন।

সেদিন হোস্টেল থেকে ৩০ জনের মতো ছাত্রী আমতলায়  গিয়েছিলা। সঙ্গে ব্যানার ছিল। ১৪৪ ধারা ছিল, তাই অল্প কয়েকজন করে যেতে হয়েছে। সবাই একসঙ্গে যেতে পারেন নি। তাঁরা রাস্তায় পুলিশ দেখতে পান- হাফপ্যান্ট পরা, হাতে লাঠি।

আমতলায় গিয়ে শরিফারা দেখতে পেলেন অনেক লোকজন। মুসলিম স্কুল থেকেও মেয়েরা এসেছে। কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীরাও ছিল। প্রায় শ’ খানেক মেয়ে ছিল। মেয়েরা আমতলার একপাশে বসলো। একটা ডায়াচ ছিল। ১২টার দিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ডায়াচে বসলেন। মিটিং শুরু হলো। সভায় গাজিউল হক সভাপতি ছিলেন। আগের রাতেই তাদের সিদ্ধান্ত ছিল- ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য হয়। শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষে ছিলেন। তবে বেশির ভাগ নেতাই এর পক্ষে ছিলেন। তার পর সাড়ে ১২টা বা ১টার দিকে সভা শেষ হয়।

তখন পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে বর্তমান জগন্নাথ হলে অধিবেশন হচ্ছিল। সেখানে গিয়ে রাষ্ট্রভাষার গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য সবাই তৈরি হয়। শান্তিপূর্ণভাবে যাওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল সবার।  ইট-পাটকেল নিক্ষেপের কোনো চিন্তা কারো ছিল না।  ১০ জনের দল গঠন করে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। প্রতিটি দলে একজন ছাত্রী থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্ররা আগে যাবে। প্রক্টর অফিসের গেটের সামনে থেকে সবাই লাইনে দাঁড়ালেন। কয়েকটি দল বের হলে পুলিশ বাধা দেয়। ইট-পাটকেলের প্রচণ্ড শব্দ শুনলেন শরিফা। পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করল। প্রথমে যারা বের হয়েছে তাদের অনেকেই আহত হলো। গাজিউল হক আহত হন।

সবাই আতঙ্কিত। পুলিশ অনেককে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। টিয়ারশেলে শরিফার চোখে জ্বালাপোড়া শুরু হল। চোখ জ্বলছে। কে যেন পানি এনে দিল। চোখে পানি দিলেন। ৩টার দিকে গুলির শব্দ শুনলেন তাঁরা। তবে তখন কারা নিহত তা জানতে পারেননি। কলাভবন ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানে একটা দেয়াল ছিল। দেয়ালটা ভাঙা হলো। শরিফার বান্ধবী রওশন জাহান হেনার ভাই জাহাঙ্গীর মেডিকেলে পড়তেন। তিনি তাঁদেরকে নিরাপদে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিলেন। ডা. জাহাঙ্গীর পরে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ হন।

বিকেল ৫টার দিকে হোস্টেলে ফিরে এসে তাঁরা শুনলেন অনেকে নিহত হয়েছেন। আহতরা হাসপাতালে। কয়েকজন ছাত্রীও আহত হন। খবর এসেছে- লাশ গুম করা হয়েছে। হোস্টেল থেকে শরিফারা কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে আহতদের দেখতে গেলেন। ছাত্ররা আহত। চারদিকে হাহাকার। পরে বরকত, জব্বার, শফিউলরা শহীদ হয়েছেন সে খবর পেলেন তিনি। পরদিনও মিছিল-মিটিং হয়েছে। এরপর ২৩ তারিখ রাতে লুকিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। উদ্বোধন করা হয় ভোরবেলায়।

sohid minar buildউদ্বোধনের পরে সকালের দিকেই সেখানে গেলেন দুঃসাহসী শরিফা। ভাষা আন্দোলনে নারীরা শুধু সক্রিয়ভাবে অংশই নেননি বরং নিজের গায়ের গয়না এবং টাকা দিয়ে সাহায্যও করেছেন। এমনকি ইডেন কলেজের মেয়েরা একদিন রান্না করে জেলখানায় পাঠিয়েছেন। এর পর সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলো। ইডেন কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হল। হোস্টেল থেকে চলে যেতে বলা হলো। শরিফা ট্রেনে করে আখাউড়ায় বান্ধবী শহর বানুর বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। তাঁর বাবা সিলেট থেকে এসে তাঁকে নিয়ে যান।

ভাষা আন্দোলন চলে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়ার আগ পর্যন্ত এবং ২১ ফেব্রুয়ারির পর ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আন্দোলনেও নারীদের ভূমিকা ছিল। শরিফা ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। তখনো আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিল। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে। অনেক ছাত্রী গ্রেপ্তার হয়। অনেককেই সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে পুলিশ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেদিন গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ২০-২১ জন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম নারী অধ্যাপক লায়লাও ছিলেন। লায়লা ছিলেন শরিফার পরিচিত। লায়লার সঙ্গে তিনিও মিছিল-মিটিংয়ে গিয়েছেন। ১৯৫৫-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকারের কিছুটা টনক নড়ে। ৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়।

ভাষাসংগ্রামী শরিফা সংগ্রামমুখর জীবনে কর্মজীবনের শুরুতে ফেনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫৮ সালে। ১৯৬৩ সালে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা শুরু করেন ১৯৬৫-৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিক্ষায় পিএইচডি লাভ করেন। ২০০১ সালে অবসর নেন। এই নারী ভাষাসৈনিক বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন।

প্রতিক্ষণ/এডি/নাজমুল

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G