কুরআনের আলোকে রোযার গুরুত্ব ও ফযীলত

প্রকাশঃ মে ২৭, ২০১৭ সময়ঃ ১২:৫৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১০:১০ পূর্বাহ্ণ

আহমাদ মুঈনুদ্দীন খন্দকার

আহমাদ মুঈনুদ্দীন খন্দকার

সিয়াম সাধনার মাধ্যমে কলুষময় আত্মা ও ক্লেদাক্ত জীবনধারা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নিয়ে আবার আমাদের দ্বারে সমুপস্থিত পবিত্র মাহে রমযান। স্বাগত মাহে রমজান। আহলান সাহলান ইয়া শাহরু রামাদান। মানুষকে মুত্তাকি তথা প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মহান ব্রত নিয়েই প্রতি বছর আমাদের মাঝে আগমন ঘটে এ মুবারক মাসের। এ সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই এরশাদ করেন-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

মূলত رمض শব্দমূল থেকে رمضان শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ জ্বালিয়ে দেয়া বা জ্বালানো, পোড়ানো। সু ও কু মিলে বহুবিধ রিপুর সমন্বয়ে গঠিত মানবদেহ। খনি থেকে আহরিত খাদ মেশানো সোনাকে আগুনে পুড়িয়ে যেমন খাঁটি সোনায় পরিণত করা হয়, কয়লা পোড়াতে পোড়াতে যেমন পৃথিবীর সবচে মূল্যবান ধাতু হিরক খন্ড তৈরি হয়- ঠিক তেমনি রমযান মাস রোযাদারের যাবতীয় কু-রিপুকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে পরিষ্কার করে দিয়ে তাকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে দেয়। তাই এ মাসকে شهر رمضان নামে আখ্যায়িত করা হয়।

রোযার ফরয বিধান অন্য উম্মতদের জন্যে থাকলেও রমযানের পূর্ণ এক মাস রোযা শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর জন্যে মহান আল্লাহর বিশেষ উপহার, অপার অনুগ্রহ। হাদীসের ভাষ্যমতে, মাহে রমযান আগমনের সাথে সাথে জাহান্নামের দ্বার রুদ্ধ করে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং মানব জাতির পরম ও চরম শত্রু শয়তানকে জিঞ্জিরাবদ্ধ করা হয়, যাতে সে মুমিন বান্দাকে অন্তত এ মাসে কোনরূপ ধোঁকায় ফেলতে না পারে। রোযা আসলেই একটি রিয়াশূন্য ইবাদত। কারণ, পানাহারের প্রভূত উপকরণ রোযাদারের হাতের নাগালে থাকলেও দিনের বেলা সে তা অতি সঙ্গোপনে গ্রহণ করা থেকেও বিরত থাকে; শুধু এই ভয়ে যে, দুনিয়ার কেউ দেখুক আর নাই দেখুক আমার আল্লাহতো আমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন। মনের এরূপ অনুভূতির নামই তাকওয়া। আর এটি রোযার মাধ্যমেই বেশি অর্জিত হতে দেখা যায়। তাই মুমিন বান্দা সব ইবাদত আল্লাহর জন্য করলেও রোযাকেই আল্লাহ বিশেষভাবে নিজের দিকে সম্বোধন করে বলেছেন-

الصوم لى وانا أجزى به

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোযা হচ্ছে যাবতীয় গুনাহের জন্যে ঢাল স্বরূপ। তিনি আরো বলেন, জান্নাতের আটটি দরজার একটির নাম রাইয়ান। একমাত্র রোযাদারগণই ঐ দরজা দিয়ে জান্নাতে যেতে পারবে।

মাহে রমযান আসমানী কিতাব নাযিলের মাস। এ মাসেই নিহিত আছে হাজার মাসের চেয়েও সেরা রাত লাইলাতুল কদর। আর লাইলাতুল কদরের এত মাহাত্ম্যের পেছনে কারণ হলো, এ রাতেই বিশ্ববাসীর হেদায়াতের জন্যে নাযিল হয়েছে মহাগ্রন্থ আলকুরআন। তাই সিয়াম-সাধনা, সালাতুত্তারাবীহ, সালাতুত্তাহাজ্জুদ, ইতেকাফ, কুরআন তিলাওয়াত, কুরআন গবেষণা এবং কুরআনের বিধান অনুযায়ী জীবন গঠনই হচ্ছে মাহে রমযানের ঐকান্তিক দাবি।

হাদীসে এসেছে, ঈমান ও ইখলাসের সাথে কেউ যদি পূর্ণ এই মাস রোযা রাখে তবে সে হয়ে যায় সদ্যপ্রসূত সন্তানের ন্যায় নিষ্পাপ ও নিষ্কলুষ। রোযার মাধ্যমেই রোযাদার ব্যক্তি সমাজের আর দশজন বুভুক্ষ ব্যক্তির জঠরজ্বালা উপলব্ধি করে পরস্পরের প্রতি সমব্যথি হয়ে উঠতে পারে। ফলে সমাজে গড়ে ওঠে পারস্পারিক প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ-মমত্ব ও ভালোবাসার সুদৃঢ় বন্ধন। তখন স্বর্গের সুখ ভোগ করা যায় এ ধূলার ধরণীতে বসেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে মাহে রমযানের শিক্ষা থেকে দীক্ষা নিয়ে এর যাবতীয় নিয়ামত ও বরকত লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন!

মহাগ্রন্থ আলকুরআন মানব জীবনের সংবিধান। ইসলামে যাবতীয় বিধানের মৌলিক দিকগুলো তাতে বিধৃত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ 

আমি এ কিতাবে কিছুই বাদ দেইনি।

অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ

আর আমি আপনার ওপর এ কিতাব নাযিল করেছি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ হিসেবে। তাই আমরা যদি আলকুরআনে রোযা সংক্রান্ত আয়াতগুলো পর্যবেক্ষণ করি, তবে দেখতে পাই যে, রোযা ও তৎসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ বিধি-বিধান এবং আদব কায়দা এতে বর্ণিত রয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা প্রথমত রোযা ও তৎসংশ্লিষ্ট আয়াতে কারীমাগুলো উল্লেখ করব। অতঃপর তার অনুবাদ এবং বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুরআনে রোযা ও তৎসংশ্লিষ্ট কি কি বিষয় স্থান পেয়েছে; সম্মানিত পাঠক সমীপে তা পেশ করার চেষ্টা করব।

আলকুরআনে রোযা সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ :

পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় ১৮৩ থেকে ১৮৭নং আয়াত পর্যন্ত মোট ৫টি আয়াতে রোযা সংক্রান্ত আলোচনা স্থান পেয়েছে। আয়াতগুলো-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
* ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ওপর রোযাকে তদ্রুপ আবশ্যক (ফরজ) করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা খোদাভীরু হতে পার। (১৮৩)

أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

* নির্ধারিত কয়েক দিন। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে অথবা সফরে থাকে, তাহলে সে অন্য দিন থেকে তার কাযা পূরণ করবে। আর যারা রোযা রাখতে অক্ষম তারা মিসকীনকে ফেদিয়া হিসাবে খাদ্য দান করবে। আর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে ভালো কাজ করে, সেটা তার জন্য ভালো। আর রোযা রাখাটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে। (১৮৪)

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ

* রমযান মাস এমন একটি মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, মানুষের জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং স্পষ্ট হেদায়েত ও সত্যমিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন উহাতে রোযা পালন করে। আর যদি কেউ অসুস্থ থাকে বা সফরে থাকে, তাহলে সে অন্য দিন থেকে তার কাজা পূরণ করবে। আল্লাহ তাআলা তোমাদের সহজ চান, তিনি তোমাদের কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা মোতাবেক তার বড়ত্ব ঘোষণা করতে পার। এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া করতে পারো।(১৮৫)

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
* আর আমার বান্দা যখন আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, (বলে দিন) আমি নিকটেই আছি। আমি আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন দুআ করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস রাখে, তবে তারা সঠিক পথ পাবে। (১৮৬)

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَهُنَّ عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ فَالْآَنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آَيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
* রোযার রাতে স্ত্রীদের সাথে মিলন করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ তাআলা জানেন, তোমরা নিজেদের সাথে খেয়ানত করেছো। তিনি তোমাদের ওপর দয়া পরবশ হয়েছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে মিলন কর এবং আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তা খোঁজ কর। আর ফজরের সাদা আভা কালো আভা থেকে পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত পানাহার কর। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর। তবে, মাসজিদে ইতেকাফরত অবস্থায় তোমরা তাদের সাথে মিলন করো না। এগুলো আল্লাহ তাআলার সীমানা। তোমরা এর ধারে কাছেও যেওনা। এভাবেই আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য তার আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অর্জন করতে পারে। (১৮৭)

এছাড়াও ত্রিশতম পারার সূরা আলকদরে রমযান সংশ্লিষ্ট লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
এ পর্যায়ে আয়াতসমূহের আলোকে রোযা সংশ্লিষ্ট বিধান সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

রোযার হুকুম:
রোযা রাখা যে মুমিনদের ওপর একটি অবশ্য পালনীয় ফরজ কাজ, তার বর্ণনা স্পষ্টভাবে আলকুরআনে বিধৃত হয়েছে । আল্লাহ তাআলা বলেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ অর্থাৎ, ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের ওপর রোযাকে ফরজ করা হয়েছে।

রোযার ইতিহাস :
রোযা কি শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর ওপর ফরজ, নাকি এর পূর্বেও তা ফরজ ছিল? সে ইতিবৃত্তের প্রতি ইঙ্গিত করে আলকুরআনে ঘোষিত হয়েছে- كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ যেরূপ (এ রোযা) ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। অর্থাৎ, এ রোযা শুধু উম্মতে মুহাম্মাদীর ওপরে নয়; বরং পূর্ববতী সকল উম্মত ও নবীর ওপর ফরজ ছিল।

রোযার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য :
কি উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা বান্দার ওপর রোযা পালন করা আবশ্যক করে দিয়েছেন, তার বিবরণও এসেছে আলকুরআনে অতি স্পষ্ট ভাষায়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন- لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ যাতে তোমরা (এ রোযা পালনের মাধ্যমে) খোদাভীরু হতে পার। অর্থাৎ, রোযা পালনের মূল লক্ষ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। বস্তুত রোযা দ্বারা সে প্রশিক্ষণই বান্দারা পেয়ে থাকে।

রোযার সংখ্যা :
কতদিন রোযা পালন করা আবশ্যক সে বিষয়ে দুটি আয়াতে বর্ণনা এসেছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
أَيَّامًا مَعْدُودَاتٍ নির্ধারিত কয়েক দিন। অর্থাৎ, গণণা করা যায় এমন অল্প কয়েকদিন রোযা পালন করা ফরজ। অন্য আয়াতে তার পরিমাণ ১মাস তথা রমযান মাস বলা হয়েছে। বস্তুত, সারা বছরের তুলনায় ১মাস তো কয়েক দিনই মাত্র।

মুসাফির ও অসুস্থের জন্য ছাড় :
সকল আকেল ও বালেগ মুসলিমের ওপর রমযানের রোযা রাখা ফরজ হলেও মুসাফির এবং অসুস্থ ব্যক্তির জন্য পরবর্তীতে রোযা রাখার শর্তে সাময়িক ছাড় দেয়া হয়েছে। এটি ইসলামে একটি সৌন্দর্য। এ সম্পর্কে আলকুরআনে বলা হয়েছে-
فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ
তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে অথবা সফরে থাকে, তাহলে সে অন্য দিন থেকে তা (কাযা করার মাধ্যমে) পূরণ করবে।

রোযা কাজা করা :
যার ওপর রোযা পালন করা ফরজ সে যদি রমযান মাসে কোনো ওজরের কারণে রোযা পালন করতে না পারে, তবে তার জন্য পরবর্তীতে উক্ত রোযা কাযা করা জরূরী। এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায় আলকুরআনে। যেমন: فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ সে অন্য দিন থেকে তা (কাযা করার মাধ্যমে) পূরণ করবে।

অপারগের মাসআলা :
দ্বীন ইসলাম সহজ ও সুন্দর ধর্ম। অসম্ভব কিছু কাউকে চাপিয়ে দেয়া হয় না এখানে। তাইতো যারা রোযা রাখতে স্থায়ীভাবে অপারগ, তাদেরকে ফেদিয়া দেয়ার বিধান করে দেয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে আলকুরআনে বলা হয়েছে-
وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ আর যারা রোযা রাখতে অক্ষম তাদের কর্তব্য হল মিসকীনকে ফেদিয়া হিসাবে খাদ্য দান করা।

নফল রোযা:
ফরজ রোযার পাশাপাশি নফল রোযা রাখার প্রতি উৎসাহিত করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন: আল্লাহ তাআলা বলেন-
فَمَنْ تَطَوَّعَ خَيْرًا فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ভালো কাজ করবে, তা তার জন্য ভালো। আলোচ্য আয়াতে ইবারাতুন্নস দ্বারা যদিও অধিক পরিমাণে ফেদিয়া দেয়াকে উত্তম সাব্যস্থ করা হয়েছে। কিন্তু এর দালালাতুন্নস দ্বারা নফল রোযা রাখার উত্তমতা প্রমাণিত হয়।

রোযা রাখাই উত্তম:
অসুস্থ, মুসাফির প্রভৃতি ব্যক্তির জন্য পরবর্তীতে কাজা করার শর্তে যে সাময়িক ছাড় দেয়া হয়েছে; তাদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তারা যদি একটু কষ্ট করে রোযা পালন করে, তবে সেটাই উত্তম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَأَنْ تَصُومُوا خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ আর রোযা রাখাটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে।

রমযান মাস কুরআন নাযিলের মাস:
আরবী সালের ৯ম মাস তথা রমযান মাস হল বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মাস। আর এ শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হলো এ মাসে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছিল। এ সম্পর্কে আলকুরআনে বলা হয়েছে-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ
রমযান মাস এমন একটি মাস যাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, মানুষের জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং স্পষ্ট হেদায়েত ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।

রমযান কুরআন নাযিলের মাস হওয়ায় মুসলমানরা এ মাসে তেলাওয়াতে বেশি গুরুত্ব দেন। ফলে এ মাসের নাম হয়েছে কুরআন তেলাওয়াতের মাস। ইমাম আবু হানীফা রহ., ইমাম বুখারী এবং ইমাম শাফেয়ী রহ. এ মাসে মোট ৬০ খতম কুরআন পড়তেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়। মহানবী সা. নিজেও এ মাসে বেশি তেলাওয়াত করতেন।

রমযান মাসেই ফরজ রোযা পালন করতে হবে:

রমযান মাসেই ফরজ রোযা পালন করা আবশ্যক। এমনকি এ মাসে বিনা ওজরে রোযা না রেখে পরে কাজা করলে সওয়াব পাওয়া যায় না। রোযার জন্য এ মাসকে নির্ধারণ করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ মাসে উপস্থিত হবে, সে যেন উহাতে রোযা পালন করে।

রমযানে অধিক হারে দুআ করা প্রসঙ্গে:
রমযান যেমন ইবাদতের মাস তেমনি এটা দুআ কবুলের মাস। এ মাসে দুআ কবুলের অনেক সময় বিদ্যমান। সাধারণত প্রতি দিনের সাহরী ও ইফতারের সময় এবং বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে দুআ কবুল হয়। তাইতো আল্লাহ তাআালা রমযান মাসে বেশি বেশি দুআ করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
আর আমার বান্দা যখন আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, (বলে দিন) আমি নিকটেই আছি। আমি আহ্বানকারীর আহবানে সাড়া দেই, যখন আমাকে ডাকা হয়। সুতরাং তারা যেন দুআ করে এবং আমার প্রতি বিশ্বাস রাখে, তবে তারা সঠিক পথ পাবে।

রমযানে রাতের হালাল কাজ:
রোযা শুধু দিনের বেলায় রাখতে হয়। রাতের বেলায় রোযা ভংগকারী যে কোনো বৈধ কাজ করা যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ
রোযার রাতে স্ত্রীদের সাথে মিলন করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে।

রোযার সময় কমার ইতিহাস :
ইসলামের প্রথম যুগে রাতের শুরুতে ঘুমানোর পর থেকে পরবর্তী দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত রোযা পালন করার বিধান ছিল। কিন্তু দু’জন সাহাবীকে কেন্দ্র করে বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে রোযার সময়ে শিথিলতা আনা হয় এবং ফজর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রোযা পালনের ব্যবস্থা করা হয়। এ দিকে ইঙ্গিত করেই আলকুরআনে বলা হয়েছে-

عَلِمَ اللَّهُ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَخْتَانُونَ أَنْفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنْكُمْ فَالْآَنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ.
“আল্লাহ তাআলা জানেন, তোমার নিজেদের সাথে খেয়ানত করেছো। তিনি তোমাদের ওপর দয়াপরবশ হয়েছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে মিলন কর এবং আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তা খোঁজ কর।”

সাহরী ও তার শেষ সময় :
সাহরী খাওয়া সুন্নাত। এটি বরকতের খাবার। ইসলামের প্রথম যুগে সাহরী খাওয়া প্রথম রাতেই শেষ করতে হতো। কিন্তু পূর্বোক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তাআলা ফজর পর্যন্ত সাহরী খাওয়ার শেষ সময় বিলম্বিত করেন। যেমন: আলকুরআনে বলা হয়েছে,

وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْر.
আর ফজরের সাদা আভা কালো আভা থেকে পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত পানাহার কর।

ইফতার ও রোযার শেষ সময়:
রোযা শুরু হয় সুবহে সাদিক হতে এবং এর সময় শেষ হয় সূর্যাস্ত হলে। আর তখনই কোনো খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ইফতার বা রোযা ভঙ্গ করতে হয়। এ দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তাআলা বলেন- ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ অতঃপর তোমরা রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর।

রমযানে ইতিকাফ ও তার আদব:
রমযান মাসে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করার জন্য মাসজিদে ইবাদতের নিয়্যতে ইতিকাফ করা সুন্নাত। আলকুরআনে উক্ত ইতিকাফ এবং তার বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে- وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنْتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ আর মাসজিদে ইতেকাফরত অবস্থায় তোমরা (স্ত্রীদের) তাদের সাথে মিলন করো না।

লাইলাতুল কদর :
হাজার মাস ইবাদত করার চেয়েও বেশি ফজীলতপূর্ণ একটি মহাবরকতময় রজনী এ পবিত্র রমযান মাসে রয়েছে। যার নাম হল লাইলাতুল কদর (ليلة القدر)। মহিমান্বিত রজনী বা ভাগ্য রজনী। এ রাতে ফেরেশতাগণ ইবাদতকারী উম্মতে মুহাম্মাদীকে সালাম প্রদান করে থাকেন এবং এ রাতে আল্লাহ তাআলার অশেষ রহমতও নাযিল হয়। আলকুরআনে আছে-

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (1) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (2) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (3) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (4) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْر-ِ

“নিশ্চয় আমি এ কুরআনকে শবে কদরে নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন শবে কদর কি? শবে কদর হল হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ আপন প্রভুর অনুমতিক্রমে সকল বিষয়ের ব্যাপারে অবতীর্ণ হন। ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত শান্তি বিরাজ করে।”

রোযার ব্যাপারে সাবধানতা :
রোযা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ ইবাদত। এর বিধানাবলি পবিত্র কুরআনে এবং ব্যাখ্যাসহ হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে। আল্লাহ তাআলা আপন বান্দাকে পরিশেষে সাবধান করছেন এ মর্মে যে, রোযার কোনো বিধান যেন তারা লংঘন না করে। যেমন:

تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ آَيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
“এগুলো আল্লাহ তাআলার সীমানা। তোমরা এর ধারে কাছেও যেওনা। এভাবেই আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য তার আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অর্জন করতে পারে।”

মোট কথা, মাহে রমযান সংশ্লিষ্ট প্রায় সকল মাসআলার প্রতি ইঙ্গিতমূলক বর্ণনা আলকুরআনে স্থান পেয়েছে। আর কুরআনের ব্যাখ্যা হাদীস শরীফে রয়েছে এর বিস্তারিত বর্ণনা। আসুন রোজার মাসে আত্মশুদ্ধির শিক্ষা ধারণ করি। জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরআনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক : প্রভাষক, দারুন্নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা, ডেমরা  এবং খতিব, হাজী ইয়াসিন সোহাগী জামে মসজিদ, নতুন বাজার , গুলশান,  ঢাকা।

প্রতিক্ষণ/এডি/সাই

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G