চিকিৎসাপ্রযুক্তিবিদ ওমর ইশরাক
বিশ্বের চার নম্বর চিকিৎসাযন্ত্র নির্মাতা কম্পানি মেডট্রনিকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ড. ওমর ইশরাক। গত বছর লন্ডনভিত্তিক ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার অ্যান্ড ইন্সপিরেশন’-এর তালিকায় বিশ্বের প্রভাবশালী ১০ বাংলাদেশির মধ্যে উঠে এসেছে তাঁর নাম। চিকিৎসা প্রযুক্তি উদ্ভাবন, বিপণনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল মানুষদের একজন এই বাংলাদেশিকে নিয়ে আজকের জীবনের জয়গান।
মেডট্রনিক তখন লোকসান গুনছিল। পড়ে গেছে এর শেয়ার। এটা তিন-চার বছর আগের কথা। তবে মিনেসোটার এই কম্পানি একেবারে ফেলনাও নয়, চিকিৎসাযন্ত্র তৈরিতে বিশ্বে চার নম্বর। ১৪০টি দেশে পণ্যসেবা দিয়ে থাকে, সহযোগী প্রতিষ্ঠান পাঁচ শ; আর কর্মী অর্ধলাখের কাছাকাছি। এই জাঁদরেল কম্পানিই কিনা মরতে বসেছে! চলছে কর্মী ছাঁটাই! কম্পানির মেডট্রনিকের প্রধান তখন বিল হকিন্স।
২০১০ সালেই তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু নিজের পদে উপযুক্ত লোক না পাওয়ায় ছাড়তেও পারছিলেন না। ২০১১ সালে কম্পানিটি হকিন্সের জায়গায় নিয়ে আসে ড. ওমর ইশরাককে। ১৯৪৯ সালে চালু হওয়ার পর অন্য কম্পানি থেকে কাউকে মেডট্রনিকে প্রধান করার ঘটনাটি আগে একবারই ঘটেছিল। ১৯৮৫ সালে মার্কিন কম্পানি পিলসবুরি থেকে মেডট্রনিকে এসেছিলেন উইন ওয়ালিন। তখনো ধুঁকছিল মেডট্রনিক। তখনো শেয়ারবাজারে দরপতন, বিক্রিবাট্টা কম। সব কিছু ভালোভাবেই সামাল দিয়েছিলেন ওয়ালিন।
তাঁর ছয় বছর মেয়াদকালে ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে মেডট্রনিকের মুনাফার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। কর্মীসংখ্যাও চার হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে হয়েছিল দ্বিগুণ। এই পদে ড. ইশরাক প্রথম এশীয়, আবার বাঙালি। তাঁকে দেখে মেডট্রনিকের লোকজনই নয়, অন্য কম্পানির লোকজনও অবাক হয়েছিল। বলা ভালো, মিনেসোটায় চিকিৎসাযন্ত্র তৈরির কম্পানি আছে পাঁচ শর বেশি।
মেডট্রনিকের ডিরেক্টর কমিটির প্রধান কেন পাওয়েল বলেন, ‘প্রধান নির্বাহী আমরা যাঁকে নিয়েছি, তিনি অত্যন্ত মেধাবী, চিকিৎসাপ্রযুক্তি খাতে তাঁর নিত্যনতুন যন্ত্রাংশ তৈরি ও মুনাফার রেকর্ড পরীক্ষিত।’ অন্যদিকে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীর বক্তব্য ছিল- ‘এখানে যোগদান করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। কারণ অনেক আগে থেকেই এই প্রতিষ্ঠানে কাজের ইচ্ছা ছিল আমার। ৬২ বছরের ইতিহাসে উদ্ভাবন ও বিপণনের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নতি সাধন করেছে এই প্রতিষ্ঠান।’
মেডট্রনিকে ইশরাক
২০১১ সালের ১৩ জুন মেডট্রনিকে যোগ দেন ড. ইশরাক। প্রথম আট সপ্তাহে কাজ বলতে টুইটারে আটটি মাত্র বাক্য। এর মাধ্যমে মনভাঙা কর্মীদের শুধু জানালেন- কাজ করতে হবে, বাড়াতে হবে কর্মদক্ষতা। প্রেসবক্সের মাধ্যমে জানান, ‘ভাববেন না আমিই সব বদলে দেব।’ ইশরাক তখন মেডট্রনিকের ধসে যাওয়ার মূল কারণগুলো খুঁজতে থাকেন। এর মধ্যে একটি ‘ইনফুজ’ নামের চিকিৎসাযন্ত্র। এটি হাড়ের ব্যথা সারিয়ে থাকে।
পণ্যটি বিভিন্ন দেশে অন্তত ১০ লাখ মানুষ ব্যবহার করে। অভিযোগ হলো, যন্ত্রটি ভালোর চেয়ে ক্ষতিই করছে বেশি। এ নিয়ে ঝুলছে হাজারখানেক মামলা। ড. ইশরাক নজর দিলেন ইনফুজের দিকে। গণমাধ্যমকে সন্তুষ্ট করলেন এই বলে- ‘এখনো মেয়াদ আছে এমন ইনফুজ রোগীদের ওপর ব্যবহার করছি। সেগুলো কিভাবে তাদের রোগ ভালো করবে বা তারা আরোগ্য পাবে, সেটি ডাক্তাররাই ভালো বলতে পারবেন।’ আর ভেতরের গবেষণার জন্য উড়িয়ে আনলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানীকে। তাঁদের নানা তথ্য-উপাত্ত দিলেন। এতে নাখোশ হলেন মেডট্রনিকের কর্মীরা। কিন্তু ড. ইশরাক বোঝালেন, এতে তাঁদেরই লাভ, তাঁরা আরো বেশি অভিজ্ঞতা লাভ করবেন।
নানা দেশের প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের মেডট্রনিকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করলেন। দৃষ্টি ছিল চীন, ভারত আর দক্ষিণ কোরিয়ার দিকেই। কারণ আমেরিকার বিশেষজ্ঞদের চেয়ে অনেক কম টাকায় তাঁদের নিয়ে আসা যাবে। এমনকি উদ্ভাবন ও গবেষণায় যেন কম পয়সা লাগে, সে জন্য সে দেশগুলোতেই শাখা খুলে ফেলতে চান। আর নিজের দেশের রোগীদের কিভাবে মেডট্রনিকের পণ্য ব্যবহার করতে হবে, সেটি তাঁরা ভালো বলতে পারবেন।
বিশ্ববাজারে ছড়ালেন
এরপর ড. ইশরাক চোখ দিলেন বিশ্ববাজারে। চলে এলেন জন্মভূমির পাশের দেশ ভারতে। এই বাজার সম্পর্কে তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। ব্যবসার বড় জায়গা বলে মনে হলো। অথচ
তাঁর কম্পানি এত দিন এ দেশের ব্যাপারে উদাসীনই ছিল। মাত্র শ তিনেক লোক কাজ করেন মেডট্রনিকের হয়ে। কিন্তু চেয়ারম্যান বিশ্লেষণ করে দেখলেন- হাজার হাজার ল্যাব-ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রশিক্ষিত লোকের অভাব নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোগীরা পয়সা ঢালেন। ২৮ হাজার পণ্যের বিশাল সম্ভার নিয়ে বসে আছে যে প্রতিষ্ঠান, তাদের তো এমন বাজারই দরকার। এখানে যে বাজার আছে, তার বাৎসরিক মূল্য অবিশ্বাস্য- ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এরপর নজর দেন চীনের দিকে।
আর সব কম্পানির মতো তাঁর কম্পানির দৃষ্টিও গেল তৃতীয় বিশ্বের দিকে। এ দেশগুলো মেডট্রনিকের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসার ৬০ শতাংশ মুনাফা জোগান দেয় তারা। ব্রাজিল, রাশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলোতে ঢুকে পড়তে চান ওমর ইশরাক। এ ছাড়া দরিদ্র মানুষের জন্য আনতে চান কম দামের পেসমেকার। সস্তা হলেও মানে কোনো আপস নেই। সেটি দিয়ে তাঁরা এশিয়া, অফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার লাখো মানুষের মন জয় করবেন। উঠতি মধ্যবিত্তের জন্যও পণ্য আনবেন। সেগুলো মানসম্পন্ন হবে। এই শ্রেণি যাতে সেগুলো কিনতে আগ্রহী হয়, সেভাবে তৈরির নির্দেশ দেন বিজ্ঞানী দলকে। সেখানেও কম দামের ব্যাপারটি খেয়াল রাখা হবে।
চলতি দামের অন্তত পাঁচ থেকে ১০ গুণ কমে পাবেন ক্রেতারা। ফলে কিনবেন মেডট্রনিক পণ্য আর সে কৌশলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মেডট্রনিকের বিক্রির হার ১০ থেকে ২০ গুণ বাড়িয়ে ফেলা হবে- মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওমর ইশরাকের এই পরিকল্পনা শুনেছেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অতিথিরা। ২০১২ সালে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে, তাদের কাছে এসব ভাবনাই তুলে ধরেন তিনি। তাঁর বিরাট এই কর্মকৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেবল মেডট্রনিকই নয়, তিনি জানেন ঘুরে দাঁড়াবে নানা দেশের চিকিৎসা খাত। পাশাপাশি মেডট্রনিকও সামলে ফেলবে দুরবস্থা। তাঁর নেতৃত্বে প্রথম বছরেই মেডট্রনিকের লাভ বেড়ে যায় ১৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে মিনেসোটা
জন্ম বাংলাদেশে। তবে বেশি দিন থাকা হয়নি। ভালো ছাত্র ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সেই সুবাদে একাত্তরে তাঁদের পরিবার পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ছিল। স্বাধীনতার পর পুরো পরিবার চলে আসে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। ১৭ বছর বয়সে, উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর উচ্চতর লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে চলে যান বিলেত। লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক করেন। পরে পিএইচডি।
চাকরিজীবনের শুরু প্রকৌশলী হিসেবে। ক্যারিয়ার গড়েন চিকিৎসাপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। ১৯৮০ সালে যোগ দেন ক্যালিফোর্নিয়ার ফিলিপস আলট্রাসাউন্ডে। নানা চিকিৎসাযন্ত্র উদ্ভাবনের পাশাপাশি বিপণন বিভাগেও কাজ করেন। পরে যোগ দেন এলবিট আলট্রাসাউন্ডে। সেখানে সারা পৃথিবীতে পণ্য বিপণন করেছেন।
পদোন্নতি পেয়ে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত হয়েছেন। ৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯৫ সালে চলে যান জেনারেল হেলথ কেয়ারে। জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পানির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এই জেনারেল হেলথ কেয়ারে তিনি ছিলেন টানা ১৬ বছর। জিইতে ড. ইশরাকের আসা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান জ্যাক ওয়েলচ তাঁর আত্মজীবনী ‘জ্যাক স্ট্রেট ফ্রম দ্য গাট’তে লিখেছেন- ‘আমরা আলট্রাসাউন্ড ব্যবসাকে পুরোপুরি আলাদা করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যেসব প্রার্থী এসেছিলেন, তাঁরা কিভাবে আমাদের পণ্যগুলো বাজারে বিক্রি করবেন, ব্যবসাটি জমিয়ে তুলেবেন- জানতে চেয়েছিলাম।
ওমরের সঙ্গে আলাপের পর মনে হলো, এ লোকটিকেই খুঁজছি। বাংলাদেশি এই মানুষটির মধ্যে আলট্রাসাউন্ড ব্যবসাকে যেভাবে পরিচালনা করা দরকার, সেটি খুঁজে পেলাম। তিনি যাতে কাজ করতে পারেন, সে জন্য বাজেটে কোনো কার্পণ্য করিনি। ফলাফল? ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বের চিকিৎসাযন্ত্র বিপণনের লড়াইয়ের মাঠে যেখানে আমাদের নামগন্ধটিও ছিল না, সেখানে ২০০০ সাল নাগাদ বাৎসরিক লাভের অঙ্কটি ২০ থেকে ৩০ ভাগ বেড়েছে। মোট আয়ের হার ৫০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার! (বাংলাদেশের টাকায় তিন হাজার ৮৩৭ কোটি ৫০ লাখ টাকারও বেশি)।’ এই অসামান্য সাফল্যের জন্য ওমর ইশরাককে বিবেচনা করা হয় ডায়াগনস্টিক পণ্যের বিপণনে অগ্রদূত হিসেবে।
২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ১১ মে পর্যন্ত চারটি বছর জেনারেল হেলথ কেয়ার সিস্টেমসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রেসিডেন্ট। তখন তিনি আলট্রাসাউন্ড, মনিটরিং সলিউশনস, কার্ডিওলজি, বোন ডেনসিট্রোমেট্রি, ম্যাটার্নাল ইনফ্যান্ট কেয়ার ও লাইফ সাপোর্ট সলিউশনস ব্যবসাগুলো দেখাশোনা করেছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে হেলথ কেয়ার লিমিটেডের হেলথ কেয়ার সিস্টেমস বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১০ সালের জুন থেকে জেনারেল ইলেকট্রিকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১১ সালের ১১ মে যখন পদ ছাড়েন, ওমর ইশরাক তখন জেনারেল ইলেকট্রিক কম্পানির জেনারেল হেলথ কেয়ার সিস্টেমসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রেসিডেন্ট।
আছেন সামাজিক কার্যক্রমেও
মেডট্রনিকের ভেতরে তিনি একজন আন্তরিক প্রশাসক। সব সময় মেডট্রনিকের ভেতরের নাজুক অবস্থাটি ভালো করার চেষ্টা করছেন। বাইরের কর্মী আনায় তাদের কোনো সমস্যা হবে না; বরং দক্ষতা-অভিজ্ঞতার বিনিময় হবে- কর্মীদের আশ্বস্ত করেছেন। জানিয়েছেন, তাঁর কাজের ধরন- ‘গবেষণা ও উন্নয়ন খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা।’ এর মধ্যেই শেয়ারবাজারে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কম্পানি। আর ‘কালো এশীয়’ যে কাজের লোক, সেটিও জেনেছেন কর্মীরা। তবে কাজই তাঁর সব নয়। অবসরে বেড়াতে ভালোবাসেন। অস্ট্রিয়া খুব টানে। পড়েনও। এ বছরে পড়া প্রিয় বইটি হলো- ‘দ্য ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন অব মেডিসিন’।
সামাজিক কার্যক্রমেও যুক্ত। এশিয়া সোসাইটির বোর্ড অব ট্রাস্টির একজন সম্মানিত সদস্য। অলাভজনক এ সংগঠন উন্নত বিশ্বের কাছে এশিয়াকে তুলে ধরে। সেভ দ্য চিলড্রেন ফাউন্ডেশনের ‘হেলথ লিডারশিপ’ কাউন্সিলের সদস্য। ১৫০ বছরের পুরনো ইন্টেল ও কেয়ারের যৌথ উদ্যোগ ‘কেয়ার ইনোভেশন’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন ড. ইশরাক। সূত্র: কালের কন্ঠ