জোনাকির কথা
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
আমাদের আশেপাশের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে হাজারো বিচিত্র প্রাণী। তাদের কিছু আমরা দেখি এবং কিছু দেখিও না। অনেকের সম্পর্কে আমরা জানি না। তবে এসব অদ্ভুত পতঙ্গের মধ্যে আমাদের সকলেরই একটা পরিচিত নাম হলো ‘জোনাকি’।
জোনাকি পোকার আলো দেখে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। রাতের অন্ধকারে তাদের মিটিমিটি জ্বলা আলো দেখলে মনে হবে, মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জ বুঝি এই পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে। মজার বিষয় হলো, জোনাকি পোকা সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য আছে যা আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা। চলুন জেনে নেওয়া যাক জোনাকি পোকা সম্পর্কে কিছু মজার তথ্যঃ
সাধারণত জোনাকি পোকাকে লাইটিং বাগ বা ফায়ার ফ্লাই বলা হলেও আসলে এটি বাগ বা ফ্লাই যা বাংলায় মাছি প্রজাতির কোন পোকা নয়। ছোট্ট কালচে বাদামী রংয়ের পোকা এটি, শরীরের গড়ন অনেকটা লম্বাটে ধরণের। এই পোকার পেটের পেছনের দিকে থাকে সেই আলো জ্বলা অংশ। আমাদের দেশ থেকে শুরু করে, মালয়েশিয়া-আমেরিকা পর্যন্ত অনেক দেশেই জোনাকি পোকা বাস করে। একটা বৈজ্ঞানিক গবেষনায় দেখা গেছে যে, এ পর্যন্ত পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির জোনাকি পোকা আছে। এই প্রজাতির পোকারা অনেকটা সাদাসিধে ধরনের পতঙ্গদের মত হয়ে থাকে। এদের প্রিয় খাবার হলো এসকারগোট নামক এক ধরনের শামুক। তাছাড়া পচা প্রাণীএবং আবর্জনাও এদের প্রিয় খাদ্য। লম্বায় এরা এক ইঞ্চিরও অনেক কম, প্রায় দুই সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। অন্যান্য পোকাদের মতোই এদের শরীরে শক্ত দুটো পাখা আছে, যেগুলোকে ইলিট্রা বলা হয়। এগুলো পিঠের ওপরে সোজাসুজিভাবে থাকে। দেহের ভারসাম্য রক্ষায় এবং ওড়ার কাজে এই পাখাগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এদের পাখা এবং মাথায় লম্বা হলুদ দাগ আছে। ছয়টা পা, দু’টো অ্যান্টেনা, এবং অক্ষিগোলক নিয়ে এদের শরীরটা মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি জোনাকিই তাদের শরীরের শেষের ভাগে একটা করে আলোর বাতি নিয়ে ঘোরে। তবে প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকির আলো কিন্তু এক রকম নয়। জাতি ভেদে এরা ভিন্ন ভিন্ন আলোও প্রদর্শণ করতে পারে। কোন কোন জোনাকি পোকার আলোর রং সবুজ, কারো হলুদ, আবার কারও বা কমলা রংয়ের হয়ে থাকে। শুধূ এই আলোর রংই আলাদা নয়, এই আলোর সঙ্কেতও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
নানা দেশে এদেরকে নানা নামে ডাকা হয়ে থাকে। তবে ইংরেজিতে এদেরকে ফায়ার ফ্লাই, ফায়ার ফ্লাই বিটল, গ্লো ওয়ার্ম, গ্লো ফ্লাই, মুন বাগ, লাইটিং বাগ, এবং গোল্ডেন স্পর্কলার বলে। জাপানিজরা ডাকে-হোটারু, জামাইকানরা-বিতলুংকি, মালয়ালামরা- ‘মিন্না-মিন্নাৎ, স্পানিশরা- লুইসিয়েরনাগা, পুর্তগিজরা- ‘লাগা-লাম’, মালয়রা- ‘কেলিপ-কেলিপ, কুনাং-কুনাং ও হ্যাপি-হ্যাপি’ বলে। জার্মানরা-লুশেটক্যাফর, ফরাশিরা-লুসিয়াল ও ইতালিয়ানরা-লুসিঅলা এবং থাইরাহি হোয় বলে ডাকে।
বৈজ্ঞানীক গবেষনায় দেখা গেছে যে, জোনাকি পোকাদের এই আলো জ্বালানোর অন্যতম প্রধান কারন হলো তাদের বিপরিত লিঙ্গকে আকর্ষন করা। অর্থাৎ এই আলো তার ব্যবহার করে তাদের বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষন করতে। জোনাকি পোকারা মিলনের সময় তাদের শরীরের আলোর সঙ্কেত দ্বারা একে অপরকে আকৃষ্ট করে থাকে। পুরূষ জোনাকি পোকা স্ত্রী জোনাকিদের কাছে আলোর সঙ্কেত দিয়ে তার মনের কথাগুলো প্রকাশ করে। আগ্রহী নারী জোনাকিটিও আলোর সংকেতের সাহায্যে তার ইতিবাচক উত্তর জানিয়ে দেয়। এরপর তারা কম গাছ-পালা বেষ্টিত কোন যায়গায় একত্রে মিলিত হয়। তবে এই আকর্ষণের ব্যাপারটা প্রজাতি ভেদে ভিন্নও হতে পারে। যেমন, আমেরিকায় এক প্রকারের জোনাকি আছে, যাদের পুরুষগুলো পাঁচ সেকেন্ড অন্তর-অন্তর জ্বলে ওঠে, এবং তার প্রতিক্রিয়ায় মাটিতে অপেক্ষ্মান স্ত্রী জোনাকিটি দুই সেকেন্ড পরপর জ্বলে ওঠে। এভাবেই তার মিলন সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। আর এজন্য জোনাকি পোকাদেরকে চলমান বাতিও বলা হয়ে থকে।
আমরা সবাই জানি, জোনাকি হলো আলো জ্বালা প্রানী এবং মুলত আলোর সংকেতের জন্যই বেশি পরিচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কনসাসে এবং উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করা এমন এক প্রজাতির জোনাকি আছে যাদের কোন আলো নেই। জোনাকিদের শরীরের অর্ধেকটাই তার বাতির ওজন। দিনের বেলায়ও তারা আলো জালায়, কিন্তু সূর্য়ের আলোর প্রভাবের কারনে তাদের এই আলোকে দেখা যায় না। এমন অনেক জোনাকি আছে যাদের ডিমও জ্বলজ্বল করে। গবেষকদের মতে, অনেক প্রজাতির জোনাকি পোকা আছে যাদের অস্তিত্ব এই পৃথিবী থেকে আস্তে-আস্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারন হলো অতি মাত্রায় আলোক দূষন। রাতের ঝলমলে আলোর প্রভাবে সাধারন কীট-পতঙ্গসহ অনেক নিশাচর প্রাণীর চলাচলে খুবই অসুবিধা হয়। আর এই আলোর দূষনের কারনেই নিশাচর প্রাণীরা অতিমাত্রায় হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো জোনাকি। কারন জোনাকিরাও যে নিশাচর!
প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর