টেলিভিশন সাংবাদিকতার কৌশল (পর্ব-৩): রাকিব হাসান

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫ সময়ঃ ৪:৪৭ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১০:২৫ অপরাহ্ণ

jn2টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ভয়েজওভার, সিংক এবং ভক্সপপ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। যেকোন প্যাকেজে লিংকের পরপরই এ বিষয়গুলো অনিবার্যভাবে চলে আসে। লিংক পড়ার পর নিউজ প্রেজেন্টারের কাজ শেষ। এরপর নিজকন্ঠে (ভয়েজওভার), সিংক এবং ভক্সপপ এর মাধ্যমে একজন রিপোর্টার তার পরিপূর্ণ প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন। একজন রিপোর্টার তার ভয়েজওভারে যা বলেন, সে সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত বা বক্তব্য উপস্থাপিত হয় সিংক এবং ভক্সপপ এ। প্রথমেই আলোচনা করা যাক ভয়েজওভার সম্পর্কে-

ভয়েজওভার কি? মূলত একজন টেলিভিশন সাংবাদিককে তার নিজের কন্ঠে মূল রিপোর্টটি উপস্থাপন করার পাশাপাশি এর সাথে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য (সিংক, ভক্সপপ) সংযুক্ত করতে হয়। রিপোর্টের যে যে অংশটুকুতে রিপোর্টারের ভয়েজ যাবে সে সে অংশটুকু হচ্ছে ভয়েজওভার। লিংকের সাথে ধারাবাহিকতা (continuity) ঠিক রেখে ভয়েজওভার সাজাতে হয়।

আর ভয়েজওভারের ফাঁকে ফাঁকে সিংক,ভক্সপপ জুড়ে দেয়া হয়। সাধারণত ভয়েজওভারে ধারাবাহিক বর্ণণা থাকে। তবে কখনও কখনও রিপোর্টের ধরণ অনুযায়ী নাটকীয় বর্ণণা দেয়া হয়। আবার কখনও ফিচারাইজডভাবেও উপস্থাপন করা হয়। এটা আসলে রিপোর্টের ধরণ বা চরিত্রের ওপর নির্ভর করে।

ভয়েজওভারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছবি : অনেক সময় নিকট অতীতের কোন ঘটনার ধারাবাহিকতা বোঝাতে রিপোর্টে ব্যাকগ্রাউন্ডটুকু উপস্থাপন করতে হয়। যেমন গত ৩০ শে এপ্রিল সাংসদ নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর নারায়নগঞ্জ-৫ আসনটি শূণ্য হয়। ..

আজ সেই আসনে ৮ প্রার্থীর মধ্যে ঋণ খেলাপীর অভিযোগে রফিউর রাব্বি এবং হামিদুর রহমান ভাসানীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়। এই দুটি লাইনের মধ্যে ১ম লাইনে ভয়েজওভারের সাথে ফাইল ফুটেজ/জিএফএক্স (নাসিম ওসমানের ছবি) দেখাতে হবে। দ্বিতীয় অংশে আজকে নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন বাছাইয়ের যে বৈঠক হয়েছে সে ছবি দেখাতে হবে।

আবার যেমন-২০০২ সালের ১লা বৈশাখ রমনার বটমূলে বোমা হামলার পর পূর্ণ হয়েছে এক যুগ। অথচ আজও মামলাটির কোন কুলকিনারা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন…। এখানে ১ম দুটি লাইনে ভয়েজওভারের সাথে ঐ সময়ের বোমা হামলার ছবি দেখানোটা খুব ডিমান্ড করে। সুতরাং টেলিভিশনের আর্কাইভ থেকে ফাইল ফুটেজটি সংগ্রহ করে রিপোর্টে তা দেখাতে হবে।

মনে রাখতে হবে টেলিভিশন রিপোটিং এর ক্ষেত্রে রিপোর্টারর তার ভয়েজে যা বলছে সেই ফুটেজ তাকে অবশ্যই দেখাতে হবে। সেই সম্পর্কিত ভিডিও ফুটেজ না পেলে তাকে এনিমেশন বা জিএফএক্স দিয়ে হলেও তা উপস্থাপন করতে হবে। নতুবা মানগত দিক থেকে সেটি হবে দুর্বল রিপোর্ট।

 টেলিভিশন সাংবাদিকতায় দর্শক একই সাথে ছবি দেখে এবং শব্দ শুনতে পায়। আর যা শুনে তাই দেখতে চায়। সুতরাং ভয়েজওভারের সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে সংশ্লিষ্ট ফুটেজের উপস্থাপনই রিপোর্টটির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আবেদনকে বাড়িয়ে তোলে। যেমন – টেলিভিশন রিপোর্টে যদি বলা হয় একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দূর্নীতির কারণে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ।

তাহলে শুধু ভক্সপপ দিলেই রিপোর্টটি প্রতিষ্ঠিত হবেনা। এক্ষেত্রে ঐ কর্মকর্তা কি কি দূর্নীতি করেছেন, অবৈধভাবে কয়টি বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন, তার নামে-বেনামে কোথায় কোথায় সম্পদ আছে- সব কিছুর ছবি, এমনকি লোকজনকে নির্যাতন করে কিভাবে টাকা নিচ্ছেন ঐ কর্মকর্তা, এই টাকার ভাগ আর কে কে পাচ্ছে- এ ধরনের তথ্যের সাথে (প্রয়োজনে গোপনে ধারণকৃত লেনদেনের দৃশ্য) ছবিসহ রিপোর্টটি উপস্থাপন করতে পারলে-দর্শকের কাছে রিপোর্টটির আবেদন খুবই গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক হবে।

এছাড়া দালিলিকভাবে সব প্রমাণাধি উপস্থাপন করার কারণে কর্তৃপক্ষ ঐ অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। মনে রাখতে হবে পত্রিকার মত সূত্র  জানায়, ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে টেলিভিশন সাংবাদিকতা হয়না। বরং সরেজমিনে অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঐ সম্পর্কিত ফুটেজ ক্যামেরায় ধারণ করতে হবে। বলা যায়, ফুটেজ এখানে মুখ্য বিষয়।

ফুটেজে যা নেই তা ভয়েজওভারে বলা যাবেনা। কারণ রিপোর্টার যা বলতে চায় তা ফুটেজের মাধ্যমে স্টাবলিশ করতে হয়। এজন্যই বলা হয়, টেলিভিশন সাংবাদিকতায় শুধু ভাল তথ্য/সুত্র থাকলেই চমৎকার রিপোর্ট হয়না, একই সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছবিও যোগাড় করতে হয়।

দর্শকের সাথে সংযোগ: ভয়েজওভারের কিছু কিছু অংশের সাথে আপসাউন্ড দিতে হয়। মূলত যে কোন ঘটনার সাথে দর্শককে একাত্ম হতে সহায়তা করে আপসাউন্ড। যেমন- যখন রিপোর্টে বলা হয়-ঐ দিjn 4ন রমনার বটমূলে বোমা হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিহত হন।

ভয়েজওভারে এই অংশটুকু বলার পরপরই যখন আপসাউন্ডে -বিকট শব্দে বোমা বিস্ফোরণ, মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ সংযুক্ত করা হয়, তখন ঐ ঘটনার সাথে দর্শকের সংযোগটি ভালভাবে ঘটানো যায়। দর্শক অনেক মনোযেগী হয়ে রিপোর্টটি দেখতে উৎসাহী হয়।

আবার যখন একুশে ফেব্রুয়ারী প্রভাতফেরীর কথা ভয়েজওভারে বলা হয় তখন অনিবার্যভাবেই ভয়েজওভারের আগে বা পরে বা পুরো অংশ জুড়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়-আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী…এই গানের অংশবিশেষ।

এছাড়া কোন রিপোর্টের ভয়েজওভার যদি বলা হয়- নিখোঁজ হবার ১ বছর পরও পাওয়া যায়নি লাকসামের বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম হিরুর সন্ধান।ছেলের পথ চেয়ে দুচোখে এখন শুধুই অশ্রু ঝরে বৃদ্ধ বাবা মায়ের। ভয়েজওভারের এই অশটুকু যেমন সফৃট কন্ঠে দিতে হবে, তেমনি এর সাথে সঙ্গতি রেখে ছবিতে হিরুরর কোন জিএফএক্স এবং তার বাবা-মায়ের অশ্রুসিক্ত ছবি দেয়ার পাশাপাশি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বাঁশির করুণ সুর দেয়া যায় তাহলে রিপোর্টটি হৃদয়গ্রাহী হবে। দর্শক রিপোর্টটির সাথে আরোও বেশি একাত্ম হবে।

রিপোর্টের চরিত্র এবং স্ক্রিপ্ট বুঝে সেভাবে প্রাসঙ্গিকভাবে উপস্থাপনই রিপোর্টের গ্রহণযোগ্যতাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। মোটকথা, সঠিক অনুষঙ্গটির প্রয়োগ বা ব্যবহারের মাধ্যমেও একজন রিপোর্টারের সাধারণ রিপোর্ট টি হয়ে ওঠে অসাধারণ।

অতএব, ভয়েজওভারের সাথে সংগতি রেখে আপসাউন্ড/ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকের প্রয়োগের বিষয়টি যেন যথাযথভাবে হয় সেদিকে খেয়াল রেখে সৃজনশীলতার পরিচয় দিতে হয় একজন টেলিভিশন সাংবাদিককে।

ভয়েজওভারের ক্ষেত্রে লক্ষণীয়: টেলিভিশন রিপোর্টারকে অবশ্যই সঠিক উচ্চারণ এবং স্পষ্ট স্বরে ভয়েজ দেয়ার বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হয়। ভয়েজ সাধারণত একটি নির্দিষ্ট লেবেলেই দেয়া উচিত। তারপরও যদি ওঠানামা থাকে তবে তা এডিটিং প্যানেলে গিয়ে ঠিক করে নিতে হয়।

তাই বলে হুট করেই কোন রিপোর্টে ভয়েজ দেয়া উচিত নয়। কয়েকবার প্র্যাকটিস করে রিপোর্টটির লাইনগুলো ভালভাবে হৃদয়াঙ্গম করে তারপর ভয়েজ দেয়া উচিত। বারবার পড়ার পর ফলে যেকোন শব্দ বা বাক্যের উচ্চারণের জড়তা দূর হয়। তারপরও যদি কোন উচ্চারণের সমস্যা হয় তখন সিনিয়রদের কাছ থেকে সঠিক উচ্চারণটি জেনে নিতে হবে।

মূলত রিপোর্টার কিছু শব্দ এবং বাক্যের গাঁথুনিতে তার রিপোর্ট উপস্থাপনের সাথে সাথে পরোক্ষভাবে নিজেকেও উপস্থাপন করেন বলে ভয়েজওবারের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব বহন করে। কেননা প্রাথমিকভাবে একটি রিপোর্টের সব দায়দায়িত্ব রিপোর্টারকেই নিতে হয়।

রিপোর্টারের ভয়েজ খারাপ হলে, উচ্চারণ ভুল হলে কিংবা যথাযথভাবে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলে দর্শক যেমন বিরক্ত হন তেমনি নিউজরুমেও তিনি সমালোচিত হন। কারণ রিপোর্টারের ইমেজের সাথে পরোক্ষভাবে স্টেশনের ইমেজও ক্ষুন্ন হয়।

সুতরাং টেলিভিশন সাংবাদিকতায় শুদ্ধ উচ্চারণে স্পষ্ট স্বওে নিজের রিপোর্টটিতে কন্ঠ দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই রিপোর্টারকে সতর্ক থাকতে হবে। এ জায়গাটিতে ব্যর্থ হলে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়, নিউজরুমেও তার গুরুত্ব কমে। এছাড়া বার বার ব্যর্থ হলে নিউজরুম ঐ রিপোর্টারকে ভয়েজ দেয়া থেকে বিরত রেখে অন্য রিপোর্টারকে দিয়ে তার রিপোর্টে ভয়েজ দেয়ার নির্দেশ দেন। সুতরাং নিজের কৃতিত্ব নিজের করে রাখতে হলে কন্ঠ অনুশীলনের বিকল্প নেই।

 প্রতিটি রিপোর্টের ভয়েজওভার একই লেবেল বা একই স্টাইলে হয়না : আগেই বলেছি রিপোর্টের ধরণ বা চরিত্র বা মেজাজ বুঝেই কন্ঠ দিতে হয়। যেমন- রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান আর নেই। তাঁকে কিশোরগঞ্জে নিজ গ্রামে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। এই রিপোর্টে কন্ঠ দেয়ার ক্ষেত্রে আবেগ আর শ্রদ্ধার একটি সংমিশ্রণ অবশ্যই থাকবে।

অথবা পিলখানায় বিডিআর অফিসার হত্যার আজ ৪র্থ বার্ষিকী।…এই রিপোর্টে কন্ঠ দেয়ার ক্ষেত্রে ভয়েজ সফট রাখার পাশাপাশি আবেগের জায়গাটিও থাকতে হবে। একই সাথে যথাযথ আপসাউন্ড এবং ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে দর্শককে একাত্ম করতে হবে।

আবার সিরিয়াস বা রাজনৈতিক কোন রিপোর্টে আবেগ চলবে না। কোন ক্ষেত্রে ভয়েজে আবেগ থাকবে আর কোন ক্ষেত্রে আবেগ থাকবেনা, এটা রিপোর্টারকে তার কমনসেন্স দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। অর্থাৎ রিপোর্টটি কি নাটকীয়, রম্য, না সিরিয়াসধর্মী তা বুঝেই কণ্ঠ দিতে হবে।

এছাড়া ভয়েজওবারে, এমন কোন শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করা যাবেনা যা দুর্বোধ্য বা দ্বৈত অর্থ প্রকাশ করে অথবা শ্রুতিমধুরহীন। যেমন ব্যাতিরেখে শব্দের পরিবর্তে ব্যতীত। অগ্নি নির্বাপন যন্ত্রের পরিবর্তে আগুন নেভানোর যন্ত্র -এই ধরণের সহজ শব্দ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও রিপোর্টে কন্ঠ দিতে গিয়েও যদি মনে হয়, কোন শব্দ কঠিন হয়ে যাচ্ছে তখন রিপোর্টার বিকল্প বা সহজ শব্দ ব্যবহার করতে পারেন।

ভয়েজওভার অংশে লক্ষ্য রাখতে হয় যেন কোনভাবেই লিংকে ব্যবহৃত বাক্য বা শব্দের পুনরাবৃত্তি না হয়। ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রয়োজনে প্রতিশব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। ভয়েজওভারে যা বলা হবে সেই সম্পর্কিত বক্তব্য সিংক, ভক্সপপে থাকবে, তবে হুবহু ভয়েজওভার অংশের মত হবে না। উদাহরণস্বরুপ- সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বক্তব্য দিলেন– ‘এই সরকারের পায়ের তলায় মাটি নেই, তাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে।

তারা স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে জগদ্দল পাথরের মত জনগণের বুকের ওপর চেপে বসেছে। শীঘ্রই মধ্যবর্তী নির্বাচন না দিলে জনগণ তাদের ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার বাস্তায়ন করতে আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করা হবে। এই সরকারের মন্ত্রীদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে……।’’

–বক্তব্যের এই অংশটুকু থেকে রিপোর্টের ভয়েজওভার অংশে দেয়া যেতে পারে—জণগণ এই সরকারকে বিদায় করে মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্ণবহাল করবে বলে দাবি করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব।…এতটুকুই- বাকী অংশটুকু ফখরুলের সিংকে শুনিয়ে দিলেই চলবে। অর্থাৎ রিপোর্টারের ভয়েজে একটি সারমর্ম উপস্থাপিত হবে, কখনও বক্তার বক্তব্য হুবহু যাবেনা।

কখনও ভয়েজওভারে এমনভাবে তুলে ধরা যাবেনা যেন মনে হয় এটা রিপোর্টারের নিজের বক্তব্য। কোন রিপোর্টেই রিপোর্টারের নিজের মন্তব্য বা বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই, রিপোর্টার শুধু ঘটনা তুলে ধরবেন মাত্র।

আবারো বলছি, সবসময় গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে লিংক, ভয়েজওভার , সিংক, ভক্সপপে যেন একই কথা পূর্ণব্যক্ত না হয়। এটা কাঠামোগতভাবে রিপোর্টটিকে দুর্বল করে দেয়। বরং মালা গাঁথার মত করে এ অংশগুলোকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন পুরো বিষয়টি মিলে একটি পুরপূর্ণ প্রতিবেদন হয়। সিংক এবং ভক্সপপ আলোচনায় এ বিষয়টি সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

সিংক কি? সাধারনত কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বক্তব্য হচ্ছে সিংক। রিপোর্টে ঐ ব্যক্তির বক্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হয় রিপোর্টটিকে স্টাবলিশ করার জন্য। তিনি হতে পারেন সরকারী কর্মকর্তা, যেকোন প্রতিষ্ঠানের কতৃপক্ষ, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, মেয়র, নগর পরিকল্পনাবিদ, পুলিশ কর্মকর্তা, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী।

অর্থাৎ যার বা যাদের বক্তব্য সংশ্লিষ্ট ঐ রিপোর্টের জন্য গুরুত্ব বহণ করে সেটিই হচ্ছে সিংক। ভয়েজওভারের ফাঁকে ফাঁকে সিংক (তাদের বক্তব্য) উপস্থাপন করা হয়। রিপোর্টে ঐ ব্যক্তির যখন বক্তব্য যাবে তখন টিভি স্ক্রিনে নির্ভুল বানানে তার নাম এবং পদবী (এসটোন) দেখানো হয়। মূলত যে রিপোর্টটি করা হচ্ছে সেই রিপের্টের সাথে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার, নগর বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্যটি উপস্থাপনের পাশাপাশি তার পরিচয়টি তুলে ধরা হয় রিপোর্টের বস্তুনিষ্টতার স্বার্থে।

বক্তার বক্তব্যটি যেহেতু দালিলিক প্রমাণ হিবেবে উপস্থাপিত হয়, সেকারণে তার পরিচয, পদবী এমনকি নামের বানান সঠিকভাবে যাচ্ছে কিনা তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেবল মাত্র প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলের নেত্রীর এসটোন (নাম-পদবী) টিভি স্ক্রিনে দেখানো হয়না। কেননা তারা জনগণের কাছে এতটাই পরিচিত যে তাদের নাম-পদবী দেখানোটা বাহুল্য ছাড়া আর কিছুই মনে হবেনা। এছাড়া স্পিকার এবং মন্ত্রী থেকে অন্য সকলের এসটোন নাম-পদবী দেখানো হয়।

সিংকে কোন অংশটুকু দেখানো হবে, আর কতটুকু দেখানো হবে এ ব্যাপারের সিদ্ধান্ত নেবেন রিপোর্টার। রিপোর্টার তার রিপোর্টের ভয়েজওভার অংশের সাথে সমন্বয় করে যে অংশটুকুকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবেন সেই অংশটুকু তুলে ধরবেন। বক্তার বক্তব্যের অতিরঞ্জিত, অযাচিত, অনর্থক কথাবার্তা তিনি নিদ্বিধায় সিংক থেকে বাদ দিয়ে দিবেন।

বিশেষ কোন রিপোর্টের ক্ষেত্রে রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট বক্তব্য রিপের্টারার কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে বক্তার কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সেমিনার বা সভায় যেসব বক্তব্য বক্তারা দেন তা সম্পূর্র্ণ শুনতে হয় এবং স্পটে বসেই গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় সেই অংশের নোট নিতে হয়। পরবর্তীতে ভিডিও মিক্সিং এর সময় ভিডিও এডিটরের সহায়তায় সেই সেই অংশটুকু সিংকের জন্য কেটে নেন।

কোন অনুষ্ঠানে একজন মন্ত্রী/ শীর্ষ নেতা হয়তো ১/২ ঘন্টার বক্তব্য দিচ্ছেন। দক্ষতার সাথে রিপোর্টারকে ঠিক করতে হবে কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু তিনি সিংকে দিবেন। এক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করলে সিংক ধরাটা খুব সহজ হয়ে যায় একজন রিপোর্টারের কাছে। যেমন- বিএনপি নেতা রুহুর কবির রিজভী বক্তব্য দিচ্ছেন- তার বক্তব্যে কোন কর্মসূচী থাকলে রিপোর্টার নোট টুকে নেবেন।

 তিনি অনেক কথা বলেন এবং সবসময় বলেন -এসব রিপোর্টের জন্য অপ্রয়োজনীয়। নতুন কোন কথাটি বললেন যা সরকার বা নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অথবা সেটা বিতর্ক বা আলোচনার জন্ম দেবে। এছাড়া দলের মুখপাত্র হিসেবে কোন পরিকল্পনা বা আল্টিমেটাম তিনি উপস্থাপন করছেন কিনা তা টুকে রাখতে হবে। যেন এডিটিং প্যানেলে গিয়ে ঐ অংশটুকু সহজে খুঁজে পাওয়া যায এবং সিংক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

এছাড়া রিপোর্টার চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে ক্যামেরারম্যানকে জিজ্ঞেস করে টিসি কোডও (বক্তব্যের ঐ অংশটুকু কত মিনিটের সময় বলেছেন) লিখে রাখতে পারেন। আর এসব কৌশল ব্যবহার করলে অফিসে এসে স্ক্রিপ্ট লিখতে যেমন সুবিধা হয় তেমনি এডিটিং প্যানেলে গিয়ে ভয়েজওভারের সাথে সমন্বয় করে খুব সহজেই সিংকটি ধরতে পারেন।

আবার বিশেষ রিপোর্টের ক্ষেত্রে, বিশেজ্ঞ বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে রিপোর্টার তার বক্তব্যটুকু বের করে অনবেন এবং ক্যামেরাম্যান সেই সেই অংশটুকু ধারণ করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রয়োজনীয় বক্তব্যটুকু পাওয়া যায় রিপোর্টার প্রশ্ন করার মাধ্যমে তা বের করার চেষ্টা করবেন। এক্ষেত্রে বক্তাটি হয়তো বেশি কথা বলেন/অনেক তথ্যই দিচ্ছেন। এডিটিং প্যানেলে গিয়ে গুরুত্বহীন বিষয় বাদ দিয়ে রিপোর্টার তার ভয়েজওভারের সাথে মিল রেখে সিংকে প্রাসঙ্গিক অংশটুকুই উপস্থাপন করবেন।

সিংকের গুরুত্ব: অনেক রিপোর্টের পুরো অংশই হয় সিংক নির্ভর। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংবাদের ক্ষেত্রে এটা শতভাগ সত্য। এ কারণে বক্তার বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ উপস্থাপিত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখা জরুরী। সিংকের অকর্ষনীয় অংশটুকু তুলে ধরার মাধ্যমে রিপোর্টটির গুরত্ব বা আকর্ষণকে বাড়িয়ে তোলা যায়। একারণে এডিটিং প্যানেলে সিংক ধরার সময়পূর্ণ মনোযোগ দিতে হয় রিপোর্টারকে।

যেমন-প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার বক্তব্যে- সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং সুশাসনের চিত্র তুলে ধরলেন। কিন্তু বক্তব্যের শেষদিকে এক পর্যায়ে বলে বসলেন, ‘বিএনপি যদি মনে করে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দেবে, তবে তারা এখনও বোকার স্বর্গে বাস করে। তাদের মনে রাখতে হবে জনগণ ৫ই জানুয়ারী নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকারকে ক্ষমতায় এনেছে, সুতরাং এই সরকার ৫ বছরই ক্ষমতায় থাকবে।

বিএনপিকে জনগণ প্রত্যাখান করেছে বলে এখন তারা আবোল-তাবোল কথা বলছে।’ এখানে লক্ষণীয় প্রধানমন্ত্রীর আগের বক্তব্য ছিলো উন্নয়নের নিয়ে, কিন্তু যখনই তিনি বিএনপির দাবী সম্পর্কে তার মন্তব্যটি করলেন সংগত কারণেই এই অংশটুকু সিংকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠবে। রিপোর্টার পুরো বক্তব্যটি পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে না শোনার কারণে যদি এই অংশটুকু সিংকে সংযুক্ত না করেন তখন রিপোর্টি পরিপূর্ণতা হারাবে।

আর গুরুত্বপূর্ণ একটি মেসেজ তুলে ধরার ক্ষেত্রে রিপোর্টার ব্যর্থ বলে বিবেচিত হবেন। মূলত সিংক নির্ভর প্যাকেজে এসব কারণেই সিংক খুবই গুরত্ববহ হয়ে ওঠে। আর রিপোর্টারকেও ক্ষিপ্রতার সাথে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু সিংকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়।

ভক্সপপ কি? ভক্সপপ হচ্ছে সাধারণের কন্ঠস্বর বা জনতার বা জনগণের কন্ঠস্বর। ভক্সপপ শব্দটি কোথ্থেকে কিভাবে এল সে ব্যাখ্যায় না গিয়ে রিপোর্টে এর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা যাক। ভয়েজওভারের সাথে ভক্সপপ এবং সিংক এ দুটোর সমন্বয়ে প্যাকেজ হলেও অনেক ক্ষেত্রে ভক্সপপ নির্ভর প্যাকেজ হয়। যেমন বাণিজ্য মেলার রিপোর্টে শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার বক্তব্য নিয়েই প্যাকেজ হয়।

ভক্সপপে সাধারণত পথচারী, প্রত্যক্ষদর্শী, অভিভাবক, পিয়ন, চাকুরীজীবী, রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানদার, শিক্ষার্থী, দারোয়ান থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সাধারণ মানুষের বক্তব্য নেয়া হয়। ভক্সপপ সংক্ষিপ্ত হয়। কয়েক সেকেন্ডের হয়। বেশ কয়েকজনের বক্তব্য একটু একটু করে দেখানো হয়। যেকোন ঘটনায় সাধারণ মানুষ বা প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য রিপোর্টে যখন উপস্থাপিত হয় তখন তাদের এসটোন (নাম-পদবী) যায়না।

তাদের বক্তব্যের যে সমস্যা বা বিষয়টি ওঠে আসে সেটি নিয়ে রিপোর্টার ওয়াসা, বিশেজ্ঞ বা নগর পরিকল্পনাবিদ বা মেয়র বা সংশ্লিষ্ট কোন বিশেঞ্জর বক্তব্য নিয়ে সেটিকে জাস্টিফাই করেন। যেমন জনদুভোর্গের কোন রিপোর্টে -একটি এলাকায় তীব্র পানি সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। কেউ বলছেন এক সপ্তাহ ধরে গোসল করতে পারছি না, আরেকজন বলছেন রান্না করার পানিটুকুও নেই।

কেউ বলছেন ওয়াসার কোন নজর নেই। আর কেউ বলছেন পানি কিনেই প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হচ্ছে। অর্থাৎ ছোট ছোট আকারে এক/দুই লাইনে তাদের যে অভিযোগটুকু উপস্থাপিত হয় সেটিই হচ্ছে ভস্কপপ। আর তাদের অভিযোগের সূত্র ধরে ওয়াসা বা সিটি কর্পোরেশনের কোন কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে যখন ব্যাখ্যা চাওয়া হবে এবং তার বক্তব্যটি নেয়া হবে সেটি হচ্ছে সিংক। সুতরাং ভক্সপপ হচ্ছে সাধারণ মানুষের কথা আর সিংক হচ্ছে বিশেজ্ঞ বা ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট অফিসার বা কোন কর্মকর্তার বক্তব্য।

একজন রিপোর্টার যখন ফিল্ডে কারও ভক্সপপ নেবেন তখন টু দ্যা পয়েন্টে প্রশ্ন করে উত্তরটি জানার চেষ্টা করবেন। তিনি ঘটনার সত্যতা জানার জন্য অনেকের বক্তব্য নেবেন, ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলবেন। ঐ সম্পর্কিত ছবি যেমন- টেপে পানি নেই, ওয়াসার গাড়িতে পানির জন্য মানুষের লম্বা লাইন- এসব ফুটেজ নেয়ার নির্দেশনা দেবেন ক্যামেরাম্যানকে। ঐ দুভোর্গের সাথে সংশ্লিষ্ট কমপক্ষে ৮/১০ জনের বক্তব্য নেবেন।

এরপর এডিটিং প্যানেলে গিয়ে তার স্ক্রিপ্টের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় এমন জোড়ালো বক্তব্যগুলো বাছাই করবেন। ৮/১০ জনের ব্ক্তব্য এজন্যই নিতে হবে, কারণ অনেকে ক্যামেরার সামনে স্বাভাবিকভাবে তাদের দাবিটি/অভিযোগটি তুলে ধরতে পারেননা। এই ৮/১০ জনের বক্তব্য থেকে যে যে বক্তব্যগুলো স্পষ্ট এবং জোড়ালো সেই বক্তব্যগুলো রিপোর্টার তার রিপোর্টে ভক্সপপ হিসেবে ব্যবহার করবেন। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে বক্তব্য দুর্বল হলে রিপোর্টটিও দূর্বল হয়।

কাজেই প্রশ্নের মাধ্যমে এমনভাবেই জবাবটি নিতে হবে যেন বক্তা স্বত:স্ফূর্তভাবে-যৌক্তিকভাবে তার দাবিটি/অভিযোগটি তুলে ধরেন। যদি অভিযোগকারী ব্যক্তি চেহারা দেখাতে না চান বা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তবে তার চেহারা এডিটিং প্যানেলে ঢেকে (ব্লার্ব) দিতে হবে। এমনকি এডিটিং প্যানেলে তার কন্ঠের লেবেলও চেঞ্জ করে দিতে পারেন যাতে তাকে কোনভাবেই চেনা না যায়। সাধারণত ক্রাইম রিপোটের্র ভক্সপপে এটা করতে হয়।

এভাবে সোর্সকে নিরাপদে রাখাটা সাংবাদিকের অন্যতম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ভক্সপপ নেয়ার সময় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য রাখতে হয়, এমন কোন প্রশ্ন করা যাবেনা যা অপ্রাসঙ্গিক এবং যেটির উত্তর হ্যাঁ /না হবে।

ভয়েজওভার, সিংক এবং ভক্সপপ নিয়ে ৩য় পর্বের আলোচনা এ পর্যন্তই থাকল… আগামী পর্বে সিংক, ভক্সপপের সাথে আরো কিছু টার্মিনোলজি নিয়ে আলোচনা থাকবে। কারও কোন প্রশ্ন থাকলে নিদ্বিধায় ই-মেইল/ফোন করতে পারেন। (… চলবে…)

রাকিব হাসান

লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G