ট্রান্সফরমেশন অব জেনারেশন

প্রকাশঃ জুলাই ২৯, ২০১৫ সময়ঃ ৫:২৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৫:২৬ অপরাহ্ণ

ফজলুর রহমানঃ

0000000000002792তিনি যেন কার মতো? তিনি যেন তাঁর মতো। অনেক উচ্চতার একজন। তুলনায় ওজনে কম। শারীরিক ওজনের কথা বলা হচ্ছে। জ্ঞানের পরিমাপে তা অসীম ওজনের। তিনি মানতেন ‘জ্ঞানই শক্তি’। এখন যেমন ব্যবহার হচ্ছে ‘জ্ঞানই ক্ষমতা’-ঠিক তেমনটি নয়। এই জ্ঞানবৃক্ষকে নিয়ে ভাবতে বসলেই সবুজের মনে যেন মুষলধারে স্মৃতিবৃষ্টি হয়। ক’ফোটাই বা বৃষ্টি ধরবে সে। বাকি কত প্রবাহই তো যায় তাকে পাশ কাটিয়ে।

আর দশটা গ্রামের মতো সবুজদের গ্রামেও অনেক কিংবদন্তী ছিল। স্কুল সংলগ্ন জোড় পুকুরের মাঝখান দিয়ে আসতে নেই। শুকনো দীঘির মাঝখানটা দিনদুপুরেও একলা পার হলে হতে পারে বিপদ। ওইখানে যে বার আউলিয়ার স্বপ্নদৃষ্ট মাজার আছে, সেদিকটায় হাঁটতে হবে ধীরপায়ে। বিশাল যে বটবৃক্ষ, তার তলায় গেলে শুনতে পাওয়া যায় অদ্ভুত সব আওয়াজ। জিনেরা বাজার শুরুর পরই রোববার-বৃহস্পতিবার হাট বসে। এমন কিছু দেখ-েশুনইে সবুজের বড় হওয়া। এমন কিংবদন্তীর কথার ঘোরলাগা গ্রামে সবুজ যেন খুঁজে পেল জীবন্ত আরেক কিংবদন্তী। সেই কিংবদন্তীর নাম ‘হেড স্যার’। অনেক হেড মাস্টার এলেন, গেলেন। তারপরও ওই ‘হেড স্যার’-এর প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্থান যেন আমলে নিচ্ছে না মানুষজন। তিনিই যেন একজনই ‘হেড স্যার’। বৃটিশ আমলের সার্টিফিকেট থেকে যার নাম ধারণ করা- রাণা রঞ্জণ সেনগুপ্ত।

সবুজ এখন প্রবাসে। উন্নত দেশে স্বচ্ছন্দ জীবন তার। তবে টেমস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে এখনো ধারণ করেন গ্রামের খালের সোঁদা গন্ধ। এই যেমন নব্বই দশকের শুরুতে হাইস্কুল জীবনের পাঠ চুকিয়েও এখনো সেই স্কুলের সুবাতাস বয়ে বেড়াচ্ছেন। মেধাবী সবুজের পিতা ছিলেন হাইস্কুলের সমঝদার শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর ছিল সবুজের বাড়ির ভেতরেই। শ্রদ্ধা, খ্যাতির কমতি ছিল না পিতার মারফতে। এমন পিতার সন্তান পরিচয় বড়ই আনন্দ দিতো তাকে। কিছু খেদও ছিল মনে। বিশেষ করে, যখন সৈয়দ মুজতবী আলীদের লেখা পড়তো। আর ভাবতো, কেন জার্মানির কুকুর হলাম না। যে জার্মানির কুকুরের পিছনে এত বিনিয়োগ সেখানে আমাদের দেশের শিক্ষকগণের মাসিক বেতন এত্ত কম! ওই কুকুরের এক ঠ্যাং-এর জন্য যা খরচ তার সমান-ও তো নয়!

সেই বোধ কাজ করতে করতে সবুজ এই বয়সে এসে দাঁড়িয়ে। এবার ভাবনার খোরাকে এলেন ‘হেড স্যার’। যাঁর স্মৃতি বহন করে চলাতেই ধন্য সে। বৃটিশ আমলের উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন সেই হেড স্যার রাণা রঞ্জন সেনগুপ্ত। বড় সাহেবি একটি চাকরি বাগানো কঠিন ব্যাপার ছিল না তাঁর জন্য। কেতাদুরস্থ পোশাকে বাহাদুরি ভাবে চলাচলই হয়তো ‘শোভন’ ছিল। সেই তিনি কনিা চলে এলেন শিক্ষকতায়। ঘর-সংসার ফেলে দূুরের এক উপজেলা শহর সংলগ্ন গ্রামে। পার করে দিলেন জীবনের বেশিরভাগটা সময়। সহজ কথায় জীবন-যৌবন। জার্মানির কুকুরের গল্পটা কি পড়েননি তিনি?

কেমন মানুষ ছিলেন তিনি? অবয়বেই বা ছলিনে কেমন? ৬ ফুট উপরে এক হারা গড়ন তাঁর। ছিপছিপে। মেদহীন। পরনে ট্রেডমার্ক অফ মেরুণের পাঞ্জাবি। সাথে কোচানো সাদা ধুতি। আর বছর ত্রিশেক আগেকার সেই ‘এলিট’ প্লাস্টিকের জুতোজোড়া। সবটাতেই পরিচ্ছন্নতার ছাপ। পরিপাটি উপস্থিতি।

আহারে পরিমিতিবোধ। দরিদ্র জনগোষ্ঠির আহার সমস্যা সমাধানের সুবিধার্থে নিত্যদিন এক মুঠো করে ভাত কম খেতেন তিনি। খিদে পেটে রেখে আহার শেষ করতে সচেষ্ট থাকতেন সব সময়। বলতেন, ‘‘কম খেয়ে কেউ মরে না, বরং বেশি খাওয়ার ফলে মানুষ রোগ-ব্যাধিতে দ্রুত মরে যায়। কম খাবে তো বেশি বাঁচবে।’’

নীরোগই ছিলেন বলা যায়। সুন্দর ও সহজ রুটিনে দিনযাপন করতেন। ভোরে উঠে হাঁটাহাঁটিতে দিন শুরু। এরপর গায়ে নরম রোদ মেখে নিতেন। তারপর শেষে কর্মদিবস শুরু হতো। বিকেলের সোনারোদে ফিরতেন বাসায়। একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটতনে। ফর্সামুখে ক্ষীন হাসির রেখা লেগে থাকতো। এই তো তিনি। কোথাও কোন আহামরি উপস্থাপনা নেই তাঁর।

এই সাধারণ ধারণেই অসাধারণ হয়ে যান সবুজদের প্রিয় হেড স্যার। শতায়ু এই জ্ঞান তাপসকে নিয়ে কে.এম. হাইস্কুলে অনেক সরস আলোচনাও ছিল। বিশেষ করে, তাঁর ইংরেজী ক্লাস নিয়ে। যে ভাষার দখল তার চেয়ে কেউ বেশি রাখতে পারে বলে মনে হয়নি সবুজের শৈশব-কৈশোর জুড়ে।

ধরা যাক, তিনি বোগাস-বু পড়াচ্ছেন। সেখানের ‘ফ্যান্টাস্টিক’ শব্দটির এত ভালো উচ্চারণ করতেন যে ৬০ পেরুনো এই বৃদ্ধ শিক্ষকের কাছে নির্ঘাত হেরে যাবেন ২০ বছরের যে কোন শুদ্ধ উচ্চারণে পটুয়াও।

বয়স ক্রমেই বাড়ছিল। পড়ে যাচ্ছিল দাঁত। এতে করে উচ্চারণে ঘাটতি আসাটাই স্বাভাবিক। এর জন্য একটি উপায় আবিষ্কার করেছিলেন এই মহান শিক্ষাগুরু। মুখের বাম পাশটায় একটি পান গুঁজে রাখতেন। যার ফলে দাঁতের ফাঁকে হাওয়া ফসকাতো না। আওয়াজ আসতো প্রমিতে। উচ্চারণে নিপুণতা আর ইংরেজী জ্ঞানে দক্ষতার কারণে সবাই তখন বলাবলি করতো, স্যারকে যদি কোনদিন দাহ করা হয়, তাহলে আওয়াজও আসবে সেই ঠিকঠাক ঠুসঠাস ইংরেজী বলার মতো।

সবুজদে আরো অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্য ছিল একই সময়ে। বিএসসি স্যারের দৃঢ়তা, নিখিল স্যারের মানবিকতা, ভুলু স্যারের সামাজিকতা, মৌলভী স্যারের শ্রুতিলিপি, পন্ডিত স্যারের কৌতুককর উপস্থিতি নিয়েও স্মৃতির অনেক রোমন্থন চলতে পারে। একেকজনের শিক্ষকতাচক্র নিয়ে প্রকাশ করা যায় অনেক শিক্ষণীয় কিছু। কিন্তু কেবল ওই ‘হেড স্যার’ ছিলেন যেন বিশেষ এক প্যাকেজ। জনতার ভিড়ে আলাদা করে দেখা একজন।

সবুজরা বাংলা ক্লাসে পড়তো ‘’ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদরে ঘা মরেে তুই বাঁচা’’। আর তখন ভাবতো তারাই যেন সেই আধমরা। অথচ প্রিয় হেড স্যার ওই বয়সেও প্রাণশক্তিতে ভরপুর কত তরুন একজন ছিলেন!

এই যেমন- ক্লাসের ফাঁকে ছাত্র-ছাত্রীরা আব্দার করে বসলো, ‘স্যার, জোনের ফুটবল খেলা শুরু হবে, আমাদের তো বুট নেই, আমরা তো পিছিয়ে থাকি, বুট কিনে দিন না স্যার?’ গ্রামের এক হাইস্কুলের ঐতিহ্য ধারণ করে বসে আছেন তিনি। ফান্ডে তেমন টাকা নেই। কারো কাছে হাত পাতার চলও ছিল না ওই সময়টাতে। একটু ভেবে তাই সহাস্য জবাব দিলেন-‘ও বুটের কথা বলছ! কিনে নাও, কোন সমস্যা নেই, এক টাকায় তো এক মুঠো বুট (চনাবুট) পাওয়া যায়!’’। এমন জবাবে সবুজরা আশা না পেলেও হাসির দিশা পেত।

প্রায় দশক আগেকার ওই দিনগুলোতে ‘র্হাট’ বা ‘লাভ’ চিহ্ন আঁকার ধুম পড়ে যায়। টুল-টেবিল-র্বোডেও তার প্রকাশ ঘটতে থাকে। অনেকটা মহামারী হয়ে যায় পান পাতা সদৃশ এই চিহ্ন আঁকার বিষয়টা। বিষয়টি লুফে নিলেন রাণা রঞ্জণ সেনগুপ্ত। সবুজদের ছবক দিলেন তিনি, ‘মনে ভালোবাসা থাকা ভালো, কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশ এত বিচ্ছিরি তো হতে পারে না। আর ব্লাক বোর্ডে, নোটিশ বোর্ডে, টুলে-টেবিলে হার্ট চিহ্ন আকঁলে, চিহ্নের মাঝখানে কোন মেয়ের নাম বা নামের প্রথম অক্ষর গেঁথেদিলেই তো মেয়েটি তোমার হয়ে যায় না, মেয়েটি তোমার সাথে চলেও যাবে না, সুতরাং আগে ভালোবাসাটা বুঝতে শিখো।’

একটি প্রতিষ্ঠান ও একজন হেড মাস্টার কিভাবে একাকার হয়ে যায় তার উদাহরণ ওই বর্ষীয়াণ রাণা রঞ্জন সেনগুপ্ত। তিনি যখন শিক্ষকতা জীবনের সমাপনী লগনে উপস্থিত তখন মাঝে মাঝে বিরল এক দৃশ্য দেখা যেত। সেটা হলো- কোন প্রবীন ছাত্র তাঁকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে, সাথে প্রণামে যোগ দিচ্ছে ওই প্রবীনের ছেলে, এমনকি ওই প্রবীনের সাথে থাকা নাতিও। সবাই যে ওই দীর্ঘায়ুর ছাত্র! সেই মহান শিক্ষকের প্রস্থান এই বিদ্যাপিঠে না হয়ে যায়না। শেষকৃত্যও যদি এখানে সারা যেত-এমন ভাবনার কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। এখানেও তাই হলো। একটি জনপদকে কাঁদিয়ে তিনি একদিন বিদায় নিলেন।

রাণা রঞ্জন স্যারের শারীরিক প্রস্থানেও এতটুকু নির্জীব হয়নি অর্ধশতাব্দী ভরপুর স্মৃতি। এই ত্রির্শোধ্ব বয়সে এসেও তা তাজা সবুজদের মনে। দীঘির পাড়ের সেই পরিচিত বটতলায় বসে সবুজের কেবলই মনে হচ্ছে একটু পর ঘন্টা বাজবে। ছুটতে হবে স্কুলে। ইংরেজীর ক্লাসে হয়তো হেড স্যার বলবেন ‘ও সবুজ, ট্রান্সফরমেশন অব সেন্টেন্স-এর ধারাগুলো মনে রাখিস, ইংরেজীর গঠনে এটি বিশেষ সৌন্দর্য নিয়ে আসে’।

সাবেক সহপাঠির জন্য অপেক্ষারত সবুজের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে স্কুলমুখোরা। সেই চিরচেনা কালো প্যান্ট, সাদাশার্ট। সেই সাদাটে পোশাকের ছাত্রীসকল। চিরচেনা। অথচ কত যোজন দূরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। হেড স্যারের কথার ধ্বনির মতই বাজছে সবুজের হৃদয় কোণে, ‘ট্রান্সফরমেশন অব জেনারেশন-এর আচরণগুলো দেখিস দেশ গঠনে এটি বিশেষ প্রভাব নিয়ে আসে।’ ধীরপায়ে পথ চলা শুরু করে সবুজ। ওইখানে কেবল হেড স্যারকে নিয়ে গাঁথা সেই স্মৃতির মালাটাই পড়ে থাকে। যা কালের নীথর জলে ছুঁড়তে থাকে পাথর…।

 

প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G