পেট্রোল বোমায় দগ্ধরা সুস্থ জীবনে ফিরবে কি ?

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৫ সময়ঃ ১:৪৬ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:৩৪ অপরাহ্ণ

রাকিব হাসান, প্রতিক্ষণ ডট কম:

দগ্ধঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের ওয়ার্ডগুলোতে এখন শুধু পোড়া মাংসের গন্ধ। একদিকে পেট্রোল বোমায় আহতদের দুর্বিসহ যন্ত্রণা এবং অন্যদিকে তাদের স্বজনদের চাপা কষ্ট। দু:খজনক হলেও সত্যি এই দগ্ধ মানুষদের প্রায় সবাই শ্রমজীবী মানুষ।

বর্তমানে বোমায় দগ্ধ ৪৮ জন খেঁটেখাওয়া সাধারণ মানুষ প্রচন্ড যন্ত্রণা ও অস্থিরতা নিয়ে ভর্তি আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। এদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হবার কারণে দূর্বিসহ দিন পার করছে পরিবারগুলো।

ইতমধ্যে ৮১ জনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হলেও মানসিক কারণে অনেকেই পূর্বের পেশায় ফিরে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ডাক্তাররা।

কেস স্টাডি-১
বগুড়ায় পেট্রোল বোমায় দগ্ধ ৬ জনের সাথে ঝলসে গেছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মামুন। শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রণা নিয়ে বার বার অস্থির হয়ে ওঠছেন তিনি। কখনও বসতে চান আবার কখনও শুতে চান।  তাকে  নিয়ে সদা ব্যস্ত তার স্ত্রী রোকেয়া গত ৫ দিন ধরে ঘুমাতে পারেন না। রোকেয়ার চোখের পানি টলমল করছে।

burn-3কোনমতে অাঁচল দিয়ে চোখ দুটি মুছে বলেন, ‘ভাই আমগো আল্লাহ ছাড়া এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। ক্যান আমার স্বামীডারে পুইড়্যা মারল। অহন আমরা কী খামু, কই যামু।

হে ছাড়া আমগো আর কোন ইনকাম নাই। মাইয়্যাডা বিয়ার বয়স অইছে, কে দ্যাখবো তারে।’ হাইমাউ  করে কাঁদছেন রোকেয়া। রোকেয়ার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে বার্ণ ইউনিটের বাতাস। তাকে সান্তনা দেয়ার ভাষা কি জানা আছে আমাদের রাজনীতিবিদদের ?

মামুনের দিকে তাকাতেই কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘নিউজ ছাপাইয়া আর কি অইব? আমার পরিবারের ভরনপোষনের দায়িত্ব কেউ নিবো না, তারা পারবো শুধু পুইড়্যা দিতে।’

এত্তো কষ্ট আর ভালা লাগে না। মইর‌্যা যাইতে মন চায়।  দুই নেত্রীরে বলেন আমারে একটু দেইখ্যা যাইতে।’

কেস স্টাডি-২

মামুনের পাশের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ট্রাকের হেলপার সেলিম মিয়া। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ট্রাক নিয়ে আসার পথে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় ঝলসে গেছে তার শরীরের ৬০ ভাগ। তাঁর চিৎকারে বার্ণ ইনিটের অন্য রোগীরা বিরক্ত। শরীরের পুড়ে যাওয়া দগ দগে ক্ষত নিয়ে প্রচন্ড যন্ত্রণায় বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছেন তিনি। 

সেলিম মিয়ার মুখ , গলা এবং হাত এমনভাবে পুড়েছে তাঁর চেহারাটি বিভৎস আকার নিয়েছে।  সাংবাদিক দেখেই শিশুদের মত কান্না জুড়ে দেন। ‘ ভাই আমিতো কোন রাজনীতি করি নাই, ট্রাকের হেলপারি কইর‌্যা কোনমতে দুইবেলা খাই। আমারে পোড়াইয়্যা তাগো কি লাভ ? তাদের বিচার কি অইব না ? আমার এহন ইনকাম নাই, আমার বাচ্চারা না খাইয়্যা আছে ?

আমি ছাড়াতো তাগো কেউ নাই। আমার ভবিষ্যত কি ?

 কেস স্টাডি-৩

গাজীপুরে দগ্ধ ৮ জনের সাথে বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন দোকানকর্মচারী সবুজ। গাজীপুর থেকে বাসে নিজের কর্মস্থলে ফিরছিলেন সবুজ।  ওয়ারলেস এলাকায় একটি জলন্ত বোতল ছুঁড়ে আসতে দেBRTC-Bus fireখেন বাসের দিকে। জীবন বাঁচাতে জানালা দিয়ে লাফ দেন। তারপরও ৩০ ভাগ পুড়ে গেছে শরীর।

সবুজের সব ক্ষোভ ঝরে রাজনীতিবিদদের প্রতি। ‘ তারা ক্ষমতা নিয়া কাড়াকাড়ি করে আমগোরে বলির পাঁঠা বানায়। এই পঁচা রাজনীতি বন্ধ কইর‌্যা দ্যান। তাগো বিচার করেন। আমরা ক্যান পুড়মু তাগো লাইগ্যা। আমার মায়ের ওষুধ কিনতে পারি না। ট্যাকা নাই। আমি আছি হাসপাতালে। কে রাখে আমগো খবর ’?

 এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় রাজনীতিবিদদের গালাগালি শুরু করে সবুজ। তার এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। নিতান্ত বাধ্য হয়েই প্রতিবেদককে ছাড়তে হয় বার্র্ন ইনিটের ওয়ার্ড।

আসার পথে কথা হয় বার্ন উইনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. সামন্ত লাল এর সাথে। এসব পোড়া মানুষের সেবায় যিনি সবসময় নিবেদিতপ্রাণ তিনি হচ্ছেন এই ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. সামন্তলাল সেন।

বোমায় দগ্ধ ১৩৮ জনের মধ্যে অধিকাংশকে সুস্থ করতে পেরে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। তিনি জানান ‘এ পর্যন্ত ১৩৮ জন পেট্রোল বোমায় পোড়া রোগী ভর্তি হয়েছে। ৮১ জনকে চিকিৎসা দিয়ে আমরা ছাড়পত্র দিয়েছে। তবে এখনও ৪৮ জন আছে। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

তারা কি সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে ?

এমন প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়েন তিনি। তাঁর মতে ‘ সবার সুস্থ জীবনে ফেরার সম্ভাবনা কম। এ বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েছে। কারণ যারা দগ্ধ তাদের অনেকেই শারীরিভাবে বিকলাঙ্গ। আবার ধরেন যে ট্রাক চালক দগ্ধ হয়েছে সে যখন ট্রাক চালাতে স্টিয়ারিং এ  বসবে তখন তার এই দূস:হ স্মৃতি মনে পড়বে। সারাক্ষণ অাতঙ্ক তাড়া করবে তাকে।  আসলে এদের সবার দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চিকিৎসা দরকার। কিন্তু বসে বসে চিকিৎসা নেয়ার সময় ওদের নেই। জীবীকার তাগিদে শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূণ সেরে ওঠার আগেই তারা আবারো বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। সে কারণে আমার মনে হয় পেট্রোল বোমায় দগ্ধরা আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে  ফিরতে পারবে না। ’

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G