ভারতীয় ‘গরু’ রাজনীতি

প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৫ সময়ঃ ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ

এস এন এম আবদি

goruপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ নামের ছোট্ট প্রতিবেশী দেশটি ভারতের একেবারে প্রতিটি আবদার বিনা বাক্য ব্যয়ে মিটিয়ে চলছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাজনাথ সিংয়ের সবচেয়ে বড় ‘অর্জনের’ কারণে সেই দেশটির সাথে সম্পর্কে মারাত্মক টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। গরুর গোশতের দাম আকাশচুম্বি হওয়া এবং ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ঈদ-উল আযহায় কোরবানি করার মতো পশুর স্বল্পতার কারণে বাংলাদেশীরা আজ ক্রুদ্ধ। উভয় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে রাজনাথের হিন্দুত্ববাদী বা হিন্দুৎভা নীতির কারণে, যা একই সাথে অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহের সাধারণ সূত্রের পরিপন্থী এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থবিরোধী।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাজনাথ বিজেপির গরু-সম্পর্কিত বাকওয়াজ এবং গরুর গোশত নিষিদ্ধ করার দাবিকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় নিয়ে যান। তিনি আধা সামরিক সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফকে ভারতের দুধ না-দেওয়া উদ্বৃত্ত গবাদি পশুগুলো বাংলাদেশে যাওয়া বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। এর ফলে সরবরাহ ও চাহিদার আলোকে কয়েক দশক ধরে যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য চলছিল, তা কোনো ধরনের পূর্বাভাস না দিয়েই বন্ধ হয়ে যায়। রাজনাথের এই নির্দেশের আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২৫ লাখ গরু যেত, যার বাণিজ্যিক মূল্য ছিল ১০০ কোটি ডলার। এই বাণিজ্যে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা ছাড়াও উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষীরাও উপকৃত হতো। বাংলাদেশে জবাই করা প্রতি চারটি গরুর তিনটি ছিল ভারতীয়। বর্তমানে গরুর বাণিজ্য ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ কমে গেছে। বিএসএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৫.০৫ লাখ গরু বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল। চলতি বছরের একই মেয়াদে সংখ্যাটি ১.২ লাখে নেমে গেছে।

রাজনাথের নির্দেশের কারণে ভারতীয় গরু দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘ ৪ হাজার কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করতে পারছে না। এতে করে চলতি বছর বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ঈদ-উল-আযহা যত কাছে আসবে, দাম তত বাড়তে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ ওই সময় গরুর চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। মিয়ানমার, ভুটান ও নেপাল থেকে বাংলাদেশ গরু আমদানির চেষ্টা করছে। তবে ভারতের নিষেধাজ্ঞা নিশ্চিতভাবে সমস্যার সৃষ্টি করছে।

হিন্দুৎভা আদর্শে চালিত এই কড়াকড়ির মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে : নিজের ‘অর্জন’ নিয়ে রাজনাথের বাহাদুর সাজা এবং ডুগডুগি বাজানো; বাংলাদেশের মতো বন্ধুপ্রতীম দেশের ওপর এর প্রভাব; এবং শেষ, তবে চূড়ান্ত নয়, বাংলাদেশকে গরুর গোশত থেকে বঞ্চিত করে ভারতীয় করদাতাদের ওপর আর্থিক বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া।

নিজের পিঠ নিজেই পিঠ চাপড়িয়ে গত ৮ আগস্ট ‘রাষ্ট্রীয় গোধন মহা সংঘ’ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে গরু সংরক্ষণ বিষয়ক এক সেমিনারে রাজনাথ বলেন, ‘বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্মকর্তারা আমাকে বলেছেন, সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার বন্ধ হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।’ মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, গরু প্রেমিকেরা বিপুল করতালি দিয়ে রাজনাথের বক্তব্যকে অভিনন্দিত করে।

এর আগে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর বিএসএফের ৪৯তম ‘রাইজিং ডে‘তে তিনি জওয়ানদের উদ্বুদ্ধ করে বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে গরু পাচার বন্ধ করতে হবে।’ ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের আনগ্রাইলে বিএসএফ জওয়ানদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে তিনি আত্মপ্রাসাদের সুরে বলেন, ‘আমি বলছি, তোমাদের অত্যন্ত সতর্ক পাহারার ফলে গরুর গোশতের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তোমাদেরকে পাহারা আরো জোরদার করতে হবে যাতে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এবং গোশতের দাম ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বাড়ে, যেন বাংলাদেশের মানুষ গরুর গোশত খাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দেয়।’ বাংলাদেশে গরুর সঙ্কট নিয়ে ঢাকার শীর্ষ স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার তিন কিস্তিতে ‘লস অন বোথ সাইডস’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ভারতীয় স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে সৃষ্ট ক্রোধ প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘এতে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই’ যে ভারতীয় কড়াকড়ির কারণে জন্য গরু শিল্প ও চামড়া শিল্প বিপর্যয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের মাংস প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট, কসাইখানা, ট্যানারি ও হাড় গুঁড়া কারখানাগুলো ভারতীয় গরুর ওপর দীর্ঘদিন ধরেই নির্ভরশীল। বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় মাংস রফতানিকারক বেঙ্গল মিটের সৈয়দ হাসান হাবিব রয়টার্সকে বলেন, তাকে ৭৫ ভাগ আন্তর্জাতিক অর্ডার বাতিল করতে হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার আগে তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোতে বছরে ১২৫ টন গরুর গোশত রফতানি করতেন। হাবিবের কথার প্রতিধ্বনি করে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ সংবাদ সংস্থাটিকে বলেন, চামড়ার স্বল্পতার কারণে ১৯০টি ট্যানারির ৩০টি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে করে ৪ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।

বিজেপির গরুমুখী ও গরুর গোশতবিরোধী এজেন্ডার মূল নিহিত রয়েছে ২০১২ সালের ৯ আগস্ট নরেন্দ্র মোদির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তার ‘পিঙ্ক রেভ্যুলুশন’ শীর্ষক মন্তব্যে। এরপর ২০১৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রার্থিতা সমর্থনের পূর্বশর্ত হিসেবে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগত গো-রক্ষা, অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড এবং ধারা ৩৭০ বাতিলের কথা বলেছেন। সত্যিই ২০১৪ সালে বিজেপির নির্বাচনী মেনিফেস্টোর ৪১ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, সরকার ‘গরু এবং বাছুর রক্ষা ও উন্নয়ন’ সাধন করবে।

স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, রাজনাথের নতুন উচ্চাভিলাষ হলো বাংলাদেশীদের গরুর গোশত খাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া বাধ্য করা, তিনি বক্তৃতায় বিষয়টি খোলাসা করেই বলেছেন। কিন্তু রাজনাথের সর্বশেষ এই আবেশের জন্য ভারতীয় করদাতাদের পকেট থেকে গচ্ছা দেওয়াটা কি ঠিক হবে? গত ৩ এপ্রিল টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বিএসএফ যদি বাংলাদেশে গরু রফতানি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়, তবে ভারতকে তার দেশে থাকা গরু লালনপালন করতে বছরে ৩১ হাজার কোটি রুপিরও বেশি ব্যয় করতে হবে।

টাইমস অব ইন্ডিয়া কিভাবে ৩১ হাজার কোটি রুপির হিসাবে উপনীত হলো? এতে দুধ শিল্পের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, গরু মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে থেকে দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এ কারণে প্রতি বছর যে ২৫ লাখ গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিত, সেগুলোর মালিকেরা সেগুলোকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু এই বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হলে, সরকারকে গোশালায় রেখে এই ২৫ লাখ গরুকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই ব্যয়ভার করদাতাদের বহন করতে হবে। টাইমস অব ইন্ডিয়া হিসাব করে দেখেছে, গোশালা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা, গরুদের খাওয়ানো, রাখালদের বেতন দেওয়া ইত্যাদি বাবদ বছরে ৩১.২৫০ কোটি রুপি ব্যয় হবে। পত্রিকাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের শিশুদের পুষ্টি দিতে মোদি সরকার গুরুত্বপূর্ণ ‘ইন্টিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্কিম’ বাস্তবায়নের জন্য যে ব্যয় বরাদ্দ করেছে, এটা তার চেয়ে চার গুণ বেশি।

এখনো খুব বেশি দেরি হয়নি। রাজনাথ সিংয়ের উচিত তার হিন্দুৎভার একগুঁয়েমি ত্যাগ করে নেমে দুধ দেওয়া বন্ধ করা গরু বাংলাদেশে পাঠানোর সুযোগ দেওয়া, যা তারা দশকের পর দশক ধরে পাচ্ছিল। এই কড়াকড়ির কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই, এটা সুপ্রতিবেশীসুলভ মূলনীতির বরখেলাপ।
অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ

আমাদের বুধবার

প্রতিক্ষণ/এডি/এনজে

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য



আর্কাইভ

December 2025
SSMTWTF
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031 
20G