ভারতের পথে পথে

প্রকাশঃ জুন ৭, ২০১৬ সময়ঃ ৪:০৪ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:৪৮ অপরাহ্ণ

ইমাম হাসান সৌরভঃ

l

সফরটা এক মাসের। সংবাদ সংগ্রহের জন্য ভারতের একাধিক শহরে যেতে হবে। এই দীর্ঘ সময়ে থাকার জন্য প্রস্ততি ভালভাবে নিতে পারিনি। আর সাথে ক্যামেরা পার্সন না থাকায় রিপোর্ট লেখা, ফুটেজ নেয়া, অফিসে পাঠানো সব আমাকেই করতে হবে। সব মিলে মনে ভয় আর চিন্তা। নির্ধারিত দিনই যাত্রা শুরু।

এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখলাম আরো কয়েকটি চ্যানেলের পরিচিত রিপোর্টার। এতে একটু সাহস পেলাম। দিল্লীর কানেকটিং ফ্লাইট ধরার আগে রাতভর কোলকাতা এয়ারপোর্টে একা থাকতে হবেনা। নির্ধারিত সময়ে উড়াল দিল এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ান। বিমানে উঠে একটু হতাশ হলাম। কারনটা কেবিন ক্রু। এর আগে কতবার বিমানে উঠলাম। সুন্দরী বিমান বালাদের দেখলেই বিমান যাত্রীদের মন ভাল হয়ে যায়। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়ার বয়স্ক কেবিন ক্রু দেখে হতাশ হলাম।

রাতটা কোলকাতা এয়ারপোর্টে আটজন টিভি আর অনলাইন রিপোর্টার গল্প গুজব আর হালকা খাবার খেয়ে পার করে দিলাম। ভোরে দিল্লী হয়ে ধর্মশালার উদ্দেশ্যে যাত্রা। দিল্লী এয়ারপোর্টে কঠিন চেক। মানিব্যাগসহ সব কিছু বের করতে হলো। এরপর একজন বললো প্যান্টের বেল্ট খুলতে। কিঞ্চিত বিরক্ত হলাম। কিন্তু বুঝতে না দিয়ে বললাম প্যান্ট খুলতে হবে।
নিরাপত্তা কর্মী বুঝতে পেরে হেঁসে বললো, ঐটা বাসায় খুললেই হবে।
আকাশে থাকতেই ধর্মশালার সৌন্দর্য্য আঁচ করতে পারলাম। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে বুঝতে পারলাম আসার আগে যা শুনেছি কেউ বাড়িয়ে বলেনি। পাহাড় আর বুনো গাছের মিশেল। ঢাকার মত গরম নেই। বরং শীত মনে হলো বেশ। শীতটা টের পেয়েছি রাতের বেলায়। হোটেলে রুম হিটার ছিল। এরপরও যেন ভেতরে খবর হয়ে যাচ্ছিল।

m

ধর্মশালায় ছিলাম এক সপ্তাহ। পুরো সপ্তাহ জুড়ে ছিলাম চরম ব্যাস্ত। ফুটেজ কালেক্ট, নিউজ লেখা, অ্যাজ লাইভ দেয়া, ভয়েস দেয়া এবং সব শেষে নিউজ পাঠানো। সাত দিন সকাল থেকে রাত অবদি ছিল এই কাজ। যাওয়ার আসার পথে আর সকালে ধর্মশালার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতাম। এই অল্প সময়ে মুগ্ধ হয়ে

দেখেছি পাহাড়ি রাজ্যের অপরুপ সৌন্দর্য্য। তবে, সবচেয়ে ভাল লেগেছে সেখানের মানুষগুলোর ব্যবহার। সব সময় মুখে যেন হাঁসি লেগেই থাকে। কোন মিথ্যা বলেনা। ট্যাক্সি ড্রাইভারগুলো আকাশ ছোঁয়া ভাড়া চাইতোনা। একদিন রাতে হোটেলে এসে দেখি ম্যানেজার দরজা খোলা রেখে ঘুমাচ্ছেন। পরদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, দরজা খোলা রেখে ঘুমালে চুরি হবেনা।
ম্যানেজার বললেন, তাদের এখানে চোর নেই। আমাদের পাশের দেশের একটি শহরে এমন মানুষও তাইলে আছে। একবার এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা তোমাদের এখানে মানুষ এত ভাল কেন? ভারতের অন্য জায়গার সাথে এখানকার মানুষের কোন মিল নেই। একটা দারুন হাসি দিয়ে ভদ্র লোক বললেন, হয়তো পাহাড়ি এলকার প্রভাব। আবহাওয়া ফ্রেশ তাই মানুষগুলোও ফ্রেশ। পুলিশ অফিসার বাড়িয়ে বলেনি।

ধর্মশালায় সব ছিল ঠিকঠাক। শুধু একটা ছোট্ট বিড়ম্ববনা ছাড়া। ঢাকা থেকেই আমার ৯টি ফ্লাইটের টিকেট কনফার্ম করে দেয় হয়েছিল অফিস থেকে। সব ফ্লাইটই ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার। শুধু ধর্মশালা টু দিল্লী ফ্লাইটটির টিকেট করতে পারেনি সিট পায়নি বলে। তাই আমি দিল্লী থেকে ধর্মশালা নামার দিন এয়ারপোর্টে স্পাইস জেটে ধর্মশালা টু দিল্লীর ফিরতি ফ্লাইট কনফার্ম করে ফেলি। মাঝে একদিন আমাকে স্পাইস জেট থেকে একটি মেইল করা হয়, অনিবার্য কারন বশত: নির্ধারিত দিনের ধর্মশালা-দিল্লী ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তড়িঘড়ি করে স্পাইস জেট অফিসে ফোন করলাম। বল্লাম একই দিন আমার দিল্লী থেকে কোলকাতার এয়ার ইন্ডিয়ায় টিকেট কনফার্ম। নির্দিষ্ট সময়ে দিল্লী যেতে না পারলে আমার ঐ টিকেট বাতিল হবে। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ে আর আমি কোলকাতায় না যেতে পারলে নিউজ মিস করবো। তারা আমাকে দশ মিনিট পর ফোন করবে বলে জানালো।
দুই ঘন্টার পরও ফোন না করায় আমি অফিসে গেলাম। সাথে ছিলেন ইত্তেফাকের চট্টগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টার শামীম ভাই। বললাম, ভাই এইটা কেমন ব্যাপার? আপনারা ফ্লাইট বাতিল করলেন, কোন ফ্লাইটে যাব তাও কিছু জানালেন না। আমি নিজে ফোন করার পরও রেসপন্স করলেন না।

o

হালকা রাগে কাজ হলো। একজন কর্মকর্তা সরি বলে দ্রুত একই দিনের অন্য একটি ফ্লাইটে সিট কনফার্ম করলো। জেট অফিস থেকে বের হওয়ার পর শামীম ভাইয়ের ব্যাপক আনন্দ। আমারে বলল, ভাই দারুন দেখাইলেন।
এনটিভির দোদুল ভাই আগে থেকেই কোলকাতায় আমাদের জন্য হোটেল রুম ঠিক করে রেখেছিলেন। তিনি ধর্মশালায় যাননি। ঢাকা থেকে আমাদের একদিন আগে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। কোলকাতায় এসে ব্যাপক হতাশ। প্রথমেই ট্যাক্সি ভাড়া। রাতের বেলায় এয়ারপোর্টে ড্রাইভার ৩শ রুপির ভাড়া চাইলো ১২শ রুপি। পরে দরদাম করে ৮শ রুপিতে রাজি করালাম। প্রথম ধাপে তিন দিন ছিলাম কোলকাতায়। তিন দিনেই যেন হাঁপিয়ে উঠেছি। এ যেন পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি। মানুষগুলোও পুরো কমার্শিয়াল। ধর্মশালার ভিন্ন চিত্র।
কোলকাতার গন্তব্য ব্যাঙ্গালোর। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টটা অনেক সুন্দর। ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্ট থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হোটেলে গেলাম। সাথে ছিল বৈশাখী টিভির সুমন ভাই আর এসএ টিভির সিপলু ভাই। রাতের ব্যাঙ্গালোর শহরের দৃশ্য বেশ মনোরম। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে বেশ। পাঁচ দিন ছিলাম ব্যাঙ্গালোরে। লোকদের জীবন যাত্রা অনেকটাই পশ্চিমা ধাঁচের। কোলকাতার তুলনায় প্রতারনা নাই বললেই চলে। ব্যাঙ্গালোরের আশাপাশে ব্যাপক ঐতিহাসিক নিদর্শন। কাজের চাপে ঘোরার ভাগ্য হয়নি।

ব্যাঙ্গালোর থেকে ফের কোলকাতায়। এবার ছিলাম তিন দিন। উঠলাম অন্য হোটেলে। রুমে উঠে দেখি এসি কাজ করছেনা। গরমে বাজে অবস্থা। বাধ্য হয়ে রুম পাল্টালাম। এই জন্য অবশ্য ম্যানেজারের সাথে ব্যাপক ঝামেলা।

index

কোলকাতা থেকে এবার ছুটলাম দিল্লীর উদ্দেশ্যে। সেখানে আগেই হোটেলে রুম ঠিক করে রেখেছিলেন একাত্তর টিভির আরেফিন ভাই। পাহাড়গঞ্জ এলাকায়। হোটেলটি বেশ পছন্দ হয়েছিল। বিশেষ করে সকালের কম্পলিমেন্টারি ব্রেক ফাস্ট ছিল দারুন। এছাড়া দুপুর আর রাতের খাবার ছিলো বেশ বৈচিত্রময়। দিল্লী থেকে তাজমহলের দূরত্ব ট্যাক্সিতে তিন ঘন্টার। বৈশাখী টিভির সুমন ভাই, এসএ টিভির সিপলু ভাই আর একাত্তরের আরেফিন ভাই গিয়েছিলেন ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে। অন্য একটি অ্যাসাইনমেন্ট থাকায় যেতে পারিনি। মাঝে একদিন রাতে শুধু ইন্ডিয়া গেইট দেখতে গিয়েছিলাম। দিল্লীতে চার দিন থেকে শেষবারের মত আসলাম কোলকাতায়।

এবারো ভিন্ন হোটেলে উঠলাম। এবার অবশ্য আগের দুই হোটেলের চেয়ে তুলনামূলক ভাল হোটেলে। ভারতের অন্য তিনটি শহরে থাকার পর আমার কাছে কোলকাতাকেই সবচেয়ে অসহনীয় মনে হলো। হোটেল থেকে শুরু করে অধিকাংশ জায়গাতেই দরদাম করে জিনিস না কিনলে ঠকার শংকা নিশ্চিত। রাতের বেলায় হাঁটতে বেরুলে রাস্তার দৃশ্য বেশ বিরক্তিকর। অসংখ্য মানুষ ফুটপাতে শুয়ে থাকে। হাঁটা দায়।

দেখতে দেখতে এক মাস শেষ। বাড়ি যাওয়ার ডাক পড়লো। অন্য কোন জায়গা থেকে কেনা কাটা করি নাই। কারন আমার সাথে এমনতিই অফিস ইকুইমেন্টের বোঝা। আসার দিন শুধু কেনা কাটা হলো। হোটেলের পাশ থেকেই বড় একটি ওয়ান স্টপ মল থেকে সব কেনা কাটা।
রাতে ছিল ঢাকার ফ্লাইট। দুই ঘন্টা আগেই রওয়ানা দিলাম। আমার সাথে ছিলেন সিপলু ভাই আর যমুনা টিভির অমিত ভাই আর উনার ক্যামেরা পার্সন। বিমানে ওঠার আগে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একটা মাস থাকার কারনে হয়তো ভারতের জন্য মায়া লাগলো। কিন্তু ঢাকায় আসার পর আবার সব ঠিক। নিজ দেশ বলেই কথা।

 

প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G