ভুল পারসেপশন যেন তৈরী না হয়
শাহাদত হোসেন বাচ্চু
পরপর দু’জন বিদেশী নাগরিক খুনের পরে সামগ্রিক তদন্তে অগ্রগতি কতটা আছে তা জানা না গেলেও দেশের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন, এই হত্যাকান্ডে বিএনপি-জামায়াতের হাত থাকতে পারে। কথিত ইসলামিক ষ্টেট (আইএস) এই খুনের দায়িত্ব স্বীকার করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনমনীয় দৃঢ়তায় দাবি করছেন, দেশে আইএস জঙ্গীদের কোন অস্তিত্ব নেই। আবার অন্য খবরে বলা হয়েছে, আইএস-এর বিবৃতির সত্যতা নিরূপণ করতে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ তদন্ত শুরু করেছে। এর ফলে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। পারসেপশন তৈরী হতে পারে- তদন্ত, প্রমান হাতে আসার আগেই সরকারের নির্বাহীরা বলছেন, অমুক জড়িত থাকতে পারে বা অমুকের অস্তিত্ব নেই। এসব বক্তব্য তদন্ত প্রভাবিত বা ভিন্নখাতেও প্রবাহিত করতে পারে। অন্য কথায় ধরে নেয়া যেতে পারে, তথ্য-প্রমান সবকিছুই সরকারের হাতে রয়েছে। সেগুলি জাষ্টিফাই করার জন্য তদন্ত নিছকই আনুষ্ঠানিকতা।
এই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন। তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন, ভয়াবহ হামলা এবং হত্যার তদন্ত কিভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হয়। সে সময়ে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। চারদলীয় জোট সরকার তদন্ত প্রভাবিত করেছিল। সরকার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি এই ঘটনা কিভাবে ভিন্নখাতে প্রভাবিত করেছে তা সকলেই জানে। জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল। মামলার সমস্ত আলামত নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। আসামীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল।
সৌভাগ্যক্রমে সেনাসমর্র্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসে মামলাটির পূনরুজ্জীবন ঘটায় এবং বিচারের সম্ভাবনা তৈরী করে, যদিও এর পেছনে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পরে অধিকতর তদন্তের পর এখন মামলাটির বিচার কাজ চলছে। এই বিচারাধীন মামলার বিষয়েও পক্ষে-বিপক্ষে লাগামহীন মন্তব্য মাঝেমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ঘটনার ১১ বছর পরেও অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই মামলাটির বিচার সম্পন্ন করা যায়নি।
বিষয়টি এজন্যই উল্লেখ করা হয়েছে, যে কোন অপরাধ বিশেষ করে খুনের মত জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্ত এবং প্রমান না থাকলে সন্দেহের তীর প্রতিপক্ষের দিকে ছুঁড়ে দেয়া বিপজ্জনক। বিশেষত: সরকারের নির্বাহীরা যখন এসব বিষয়ে ঢালাও মন্তব্য করেন তখন এসব ঘটনার তদন্ত ও প্রমান সংগ্রহের ক্ষেত্রটি প্রভাবিত হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়। দুই বিদেশী হত্যাকান্ডের সাথে আইএস জড়িত কিনা, বিএনপি-জামায়াতের মদতে এই হত্যাকান্ড ঘটেছে বা অন্য কোন পক্ষ এর সাথে জড়িত-এটি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে উঠে আসা উচিত। তাহলেই কেবলমাত্র এ ধরনের অপরাধের বিচার সম্ভব হবে এবং এর বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে উঠবে।
হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর দাবি সঠিক, যেটি তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘দু’জন বিদেশী নাগরিকের হত্যার ষ্টাইল একইরকম। … এটা সুপরিকল্পিত। আমি স্মরণ করতে চাই এর আগে বিএনপি এক নেতার বক্তব্য। তারপর তার রিএ্যাকশন। সেগুলি যদি মিলিয়ে দেখেন তাহলে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে’। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সাথে একমত হলেও বলতে হবে, সরকারের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তাঁর অপেক্ষা করা উচিত এবং তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে কাউকে অভিযুক্ত করা বাঞ্চনীয়। অন্যথায় আশংকা থেকেই যাবে, পূর্বের অনেক ঘটনার মত এটির তদন্তও প্রভাবিত হয়ে পড়তে পারে।
এপ্রিলের পর ভালই চলছিল। সবকিছু ধাপাচাপা দেবার মত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও শান্ত-নিস্তরঙ্গ। কার্যত: বিরোধী দল নামে আছে। সংসদে বিরোধী দল অনুগত ও সরকারের অংশীদার। মাঝে-মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ দেশে গণতন্ত্রের চিহ্নমাত্র দেখতে পান না এবং আগামীতে তার দলের ক্ষমতাসীন হওয়ারও আশা করেন। বিএনপির মুখপত্র আসাদুজ্জামান রিপন নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে কিছু নসিহত সহকারে প্রতিপক্ষের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া লন্ডনে, চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অন্তরালে পুত্রের সাথে সাক্ষাত ও আলোচনা করে দলের ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারন সফরের মূল উদ্দেশ্য।
গত ক’দিন ধরে মিডিয়াগুলি মেতেছিল গরুর হাট, ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা আর ফিরে আসার দুর্ভোগ বয়ানে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী গভীর বদান্যতায় এই দুর্ভোগে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন, যা এই দেশে প্রায় বিরল। ভালই কি চলছিল? ক্রসফায়ার ও পুলিশ হেফাজতে চলতি বছরে ১৮৬ জনের মৃত্যু, পুলিশের গ্রেফতার বানিজ্য, আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি, কসমেটিক উন্নয়ন-জনগণের মাঝে অদ্ভুত নৈশব্দ, সব মিলিয়ে ভালই কি চলছে? নিশ্চয়ই ভাল চলছে। রয়েছে বিশাল সব অর্জন।
নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই জলবায়ু পরিবর্তনে বিপর্যয় রোধে প্রধানমন্ত্রী এখন জাতিসংঘ ঘোষিত চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ। টেলি-কমিউনিকেশনে অবদানের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘ পুরস্কার তার হাতে। স্বল্পোন্নত দেশগুলি চেয়ারম্যান এখন বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ২৫ বিলিয়ন ডলারের ওপর রিজার্ভ, ২০১৯ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ- সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা তার সাফল্যের মুকুটে একের পর এক পালক পরে যাচ্ছেন। একক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে (গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তাঁর শাসনকে গণতান্ত্রিক বলেই দাবি করেছেন) মানতেই হবে, এমন কৃতিত্ব হাল আমলে বিশ্বের অন্য কোন সরকার প্রধানের নেই!
এই আনন্দের আতিশয্যে গত শনিবার ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সঙ্গী ১৪ দল ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে সম্বর্ধনা দিয়েছে তাও নজিরবিহীন। দলের ও জোটসঙ্গীদের অমন উচ্ছাস-আতিশয্য অতি নিরীহ জনসাধারন মেনেই নিয়েছে, হয় প্রধানমন্ত্রীর চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ হওয়ার ভাগীদার হতে অথবা তাদের আসলে বলার কিছুই নেই বলে। কারন একটি একক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে সম্ভবত: জনগণ এখন এতটাই অভ্যস্ত যে, অমোঘ নিয়তির মত সবটাই তারা মেনে নিয়েছেন। কোন কিছুতেই তাদের প্রতিক্রিয়া বোঝা যাচ্ছে না। হোক সেটি র্যাব-পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বা শিশুকে গুলি করে কিংবা নির্যাতন করে হত্যা বা আহত করার ঘটনা। এক শিশু আয়লান কুর্দির নিথর ছবি সারা বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে তুললেও এখানে ওরকম ঘটনা আর দশটা সাধারন অনুষঙ্গের মত।
এত আনন্দ- উল্লাসের মাঝে বেশ কয়েকটি ঘটনা কাঁটা হয়ে বিঁধতে শুরু করেছে কি? নিরাপত্তার অজুহাতে ক্রিকেট অষ্টেলিয়ার বাংলাদেশ সফর বাতিল, ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা ও জাপানী নাগরিক কুনিয়ো হোশির খুন নিয়ে অনেক রহস্য জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। কথিত আইএস, অন্যান্য জঙ্গীগোষ্ঠি, বিএনপি-জামায়াতের কথিত ষড়য›ন্ত্র- পুলিশ এখনও পর্যন্ত অন্ধকার হাতড়ে ফিরছে, যদিও প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ও আগে নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলনেও আভাস দিয়েছিলেন, বিএনপি-জামায়াত এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে এবং দেশে এসেও সংবাদ সম্মেলনেও একই কথা বলেছেন।
আমাদের বুধবার
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই