যে পথ সহজ ছিল না
ফরহাদ মজহার
কিছুদিন আগে সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম বরণ যাদব একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন যার তাৎপর্য অসামান্য। তিনি জানিয়েছেন গণপরিষদে নেপালের দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নেপালে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেছেন এবং রাষ্ট্র গঠন পরিষদ (Constituting Assembly) বা গণপরিষদ ৫৯৮ গঠনতন্ত্র প্রণেতার মধ্যে ৫০৭ জনের সম্মতির মধ্য দিয়ে নতুন নেপালি গঠনতন্ত্র গ্রহণ করেছেন।
এই গঠনতন্ত্র প্রণয়ন একদিনে হয় নি। বাংলাদেশের মতো নেপালি জনগণ কোন উকিল মোক্তার দিয়ে তাদের সংবিধান মুসাবিদা করেন নি, কোন একটি রাজনৈতিক দল তাদের দলের দলীয় কর্মসূচি পুরা জনগোষ্ঠির ওপর চাপিয়ে দেয় নি। রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক বা আদর্শগত ভিত্তি নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তীব্র তর্ক বিতর্ক, মত বিরোধ ও দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই নেপালের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা একটু একটু করে এগিয়ে গিয়েছে। পথ সব সময়ই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ; অধিকাংশ সময় সংকীর্ণ। কিন্তু নেপাল এগিয়ে গিয়েছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে গঠনতন্ত্র নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়েছে, তীব্র মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে অনেক সময়। মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া বুঝি মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু নেপালি জনগণ প্রাণপণ নিজেদের মধ্যে সবসময়ই রাজনৈতিক ঐক্যের ক্ষেত্র খুঁজেছে, নিজেদের গোঁড়া অবস্থান পুনর্বিচার করেছে, অন্যদের অন্তর্ভূক্ত করবার জন্য ছাড় দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, নেপাল তার দিশা খুঁজে পেয়েছে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিভাবে রক্তপাত ও বহু ত্যাগের বিনিময়ে একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি ঐতিহাসিক ভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে – নেপাল তার অসামান্য নজির। বড় বড় মোটা মোটা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন, রাজনীতি বা সমাজতত্ত্বের বই আমাদের যা শেখাতে পারে নি, গত আটবছরে নেপালের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের লড়াই থেকে আমরা রাজনীতি ও রাষ্ট্রের গাঠনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও হাজার গুণ বেশী শিখেছি।
শুধু তাই নয়। বিশ্ব ব্যবস্থায় নেপালের অবস্থান অতিশয় প্রান্তে। চারদিকে অন্য দেশের সীমান্ত দিয়ে দেশটি পরিবেষ্টিত। যে কারনে নেপালকে ‘ল্যান্ড-লকড কান্ট্রি’ বলা হয়। কথাটা শুধু ভূগোলের বর্ণনা হিসাবে বলা হয় না। এর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। ‘পরদেশ পরিবেষ্টিত’ ভূখণ্ডের সংজ্ঞা কঠিন নয়। সহজে বলা হয় সেই দেশই ল্যান্ড-লকড যে দেশের কোন সমুদ্র বন্দর নাই। এই ধরণের দেশকে ব্যবসা বাণিজ্য করবার জন্য অন্য দেশের ভূমি ব্যবহার করতে হয়। সেই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনে (United Nations Convention on the Law of the Sea 1982) ল্যান্ড-লকড কান্ট্রি হিসাবে নেপালের কিছু অধিকার আছে যা ক্ষুণ্ণ করা আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির পরিপন্থী।
এই ধরণের একটি ল্যাণ্ড-লকড দেশের দুই দিকে আছে দুই বিশাল ও ক্ষমতাধর প্রতিবেশী। উত্তরে চিন এবং দক্ষিণে, পূবে ও পশ্চিমে ভারত। ভারত একটি হিন্দু প্রধান দেশ। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য নেপাল ভারতের ভূমি ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। ভারত ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে চলাচল বা ট্রানজিট সুবিধা পাবার জন্য নেপালকে দিল্লীর আধিপত্য মেনে নিতে হয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে নেপালকে আপোষ করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। আন্তর্জাতিক আইন কাগজে কলমে থাকার পরেও ট্রানজিটের ‘সুবিধা’কে নেপাল আন্তর্জাতিক আইনের ‘অধিকার’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বলা যাবে না। সেইদিক থেকে নেপালের পরদেশ বেষ্টিত হয়ে থাকা তার আভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং দিল্লীর সঙ্গে নেপালের সম্পর্কের চরিত্র নির্ণয় করেছে।
নেপাল নিজেও আগে নিজেকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে পরিচয় দিয়েছে। অধিবাসীদের অধিকাংশই ধর্মে হিন্দু, শতকরা প্রায় আশি জন। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠি নেপালে বাস করে। ভাষার বৈচিত্র্যও বিপুল। নেপালে মতাদর্শিক ভিন্নতাও প্রবল। কিন্তু সকল প্রকার ভিন্নতা ও বৈচিত্র ধারণ করে নেপাল নিজেকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে একটি জনরাষ্ট্র (republic) হিসাবে ঘোষণা দিতে সক্ষম হয়েছে। সংবিধান ঘোষণা করেছে, “নেপাল একটি স্বাধীন, অখণ্ড, সার্বভৌম, ধর্ম নিরপেক্ষ, সকলের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র-মুখি ফেডারেল গণতান্ত্রিক জনরাষ্ট্র”। সংবিধানে ‘সেকুলার’ বা ধর্ম নিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা হিসাবে বলা হয়েছে, “ধর্ম নিরপেক্ষতার মানে হোল প্রাচীন কাল থেকে যে ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা চলছে তার সুরক্ষা এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা”। একদিকে নাগরিক হিসাবে রাষ্ট্রের চোখে সকলের অধিকার সমান, ‘হিন্দু’ বলে রাষ্ট্র কোন নাগরিককে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে না। কিন্তু অন্য দিকে প্রাচীন কাল থেকে সমাজ ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার যে ধারাবাহিকতা বহন করে আসছে রাষ্ট্র তার সুরক্ষার কথাও বলছে।
এমন এক সময় সেকুলার গণতান্ত্রিক জনরাষ্ট্র হিসাবে নেপালের অভ্যূদয় ঘটল যখন দিল্লীতে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতে ক্ষমতায়। হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে নেপাল ছিল হিন্দুত্ববাদীদের আদর্শিক নজির। হিন্দুরাষ্ট্রের পরিচিতি ত্যাগ করে নেপাল আদতে নরেন্দ্র মোদীর গালে চপেটাঘাতই করল । যদি সহজ করে বুঝি তাহলে নেপালের জনগণ ঘোষণা করল আমরা বহু জনজাতি্, নানান ধর্ম, নানান বর্ণ, নানান চর্চা, নানান নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য নিয়েও একটি ঐক্যবদ্ধ্ রাজনৈতিক গোষ্ঠি। আমাদের গঠনতন্ত্রে আমরা আমাদের সব সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি তা না। কিন্তু যেহেতু গণতন্ত্র চর্চা আমাদের মুখ্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার আমরা একই সঙ্গে সকলকে অন্তর্ভুক্ত রাখবার নীতির আলোকে শক্তিশালী জনপরিসর বা রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা তর্ক বিতর্কের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্র গড়ে তুলেছি। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলছে সেটা সকলকে অন্তর্ভূক্ত রেখে গণতন্ত্র চর্চা (inclusive democracy)। সেখানে তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে সমস্যা চিহ্নিত করা ও সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের ধারা অব্যাহত রাখতে চাই। আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজেদের সমস্যার সমাধান করবার প্রতি নেপালের জনগণের অঙ্গীকার দৃঢ় থাকবার কথা। কারণ দেশটি একটি রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সবে মাত্র শান্তি ও স্থিতাবস্থা অর্জনের দিকে যেতে চাইছে। নেপালের নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সেই দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নেপালের অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মূল্য অমূল্য।
প্রায় আট বছর ধরে নেপালে গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলেছে। নেপালের জনরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক গঠতন্ত্র তার সাত নম্বর কনস্টিটিউশান। এর আগে ছয়টি কনস্টিটিউশানের কালপর্ব নেপাল অতিক্রম করেছে। আমরা নতুন গঠনতন্ত্র নিয়ে আজ পর্যালোচনামূলক কিছু লিখছি না। বরং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসাবে এই নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়ার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব। যেন আমরা এই প্রক্রিয়া থেকে শিখতে পারি।
প্রথমেই শেখার হোল এই যে গঠনতন্ত্র প্রণয়নের যে কোন প্রক্রিয়াই ঝুঁকিপূর্ণ। সাতচল্লিশের পর থেকে পাকিস্তানের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ষাট ও সত্তর দশকে তার ব্যর্থতার পরিণতি হিসাবে পাকিস্তানের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক শক্তি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সঙ্গত গণতান্ত্রিক দাবিদাওয়া দমন-নিপীড়নের মধ্য দিয়ে অসঁকার ক্লরতে থাকে। শুধু তাই অয় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী একাত্তরে ২৫ মার্চে নিরস্ত্র জনগণের ওপর যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান ২৫ মার্চ রাত্রেই ইন্তেকাল করে এবং যে অংশ নিজেকে পাকিস্তান বলে এখন দাবি করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তার কোন নৈতিক কিম্বা ঐতিহাসিক ন্যায্যতা নাই। অর্থাৎ জনগণের বিভিন্ন অংশের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় ধারণ করতে সক্ষম গঠণতন্ত্র প্রণয়নের কোন বিকল্প নাই। তার ফল কী হতে পারে আমরা আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে হাড়ে হাড়ে জানি।
পাঠককে একটু ভাবতে বলি, নেপালে মাওবাদিরা প্রায় দশ বছর ধরে রাজতন্ত্র এবং সমাজের শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এই লড়াইয়ের গোড়ায় ছিল জাতপাত, বর্ণাশ্রম প্রথা ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ। সশস্ত্র যুদ্ধে মাওবাদীদের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেছে বিপুল সংখ্যক নারী ও নিম্ন বর্ণের শোষিত নিপীড়িত মানুষ। মাওবাদীদের সশস্ত্র যুদ্ধের সমালোচনা উদার ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দিক থেকে হতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বুঝতে হবে যা নেপালের জনগণের রাজনৈতিক চরিত্র ইতিবাচক অর্থে বদলে দিয়েছে। শুধু সামন্ততন্ত্র ও জাতপাতবিরোধী লড়াই নয় এতে পুরুষতন্ত্রের ভিত্তিও কাবু হয়েছে। বহুক্ষেত্রেই নারী যোদ্ধারা নারী ও পুরুষ সম্পর্কের ইতিবাচক রূপান্তর ঘটাতে পেরেছে। এটা বাংলাদেশের স্বল্পস্থায়ী নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, যে যুদ্ধে প্রতিবেশী ভারত আমাদের সহায়তা করেছে।
শুরুতে ভারত মাওবাদীদের সহায়তা করেছে বলে প্রচার আছে, কিন্তু নেপালের মাওবাদীরা নিজেদের সাফল্য ও ভুলত্রুটি নিয়েই এগিয়ে গিয়েছে। এটা ছিল দীর্ঘ ও রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ যা নেপালের জনগণকেও বিভক্ত করেছে। এই গৃহযুদ্ধে মাওবাদীরা নিরংকুশ বিজয়ী হয় নি। সশস্ত্র গণযুদ্ধের নেপালের সমাজের শরীরের ওপর সহিংসতার মোটা ও গভীর ক্ষত এঁকে দিয়েছে। কিন্তু দশ বছর ধরে সশস্ত্র গণযুদ্ধ পরিচালনার পর এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে অন্যান্য শ্রেণি ও শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম নেপালের রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজতন্ত্রের উৎখাত ঘটাতে পারত না এবং এখ একটি গণতান্ত্রিক জন্রাষ্ট্র হিসাবে নেপালের পরিগঠনও সম্ভব হোত না। মাওবাদীদের এই উপলব্ধি ছিল সঠিক। সশস্ত্র সংগ্রামের পরে মাওবাদীরা রাজনৈতিক পরিসর গঠন ও সমাজের অন্যান্য শ্রেণি ও শক্তির সঙ্গে ঐক্য শক্তিশালী করবার কাজে মনোযোগী হয়। মাওবাদীদের প্রতি প্রবল বিরূপ থাকা সত্ত্বেও শহরের মধ্যবিত্ত ও উদার রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তি মাওবাদীদের শান্তি প্রস্তাবে সাড়া দেয়। মাওবাদীদের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখানে যে তারা সশস্ত্র যুদ্ধকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্যে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়। বিশেষত রাজনীতির সশস্ত্রতার পর্যায় অতিক্রম করে জনপরিসরের পর্যায়ে সফল ভাবে প্রবেশ ও নিজদের রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এই কৃতিত্ব অবশ্য একা মাওবাদীদের নয়। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সকল শ্রেণি ও দল লড়ছিল এই ঐক্য সকলেরই আন্তরিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। নেপাল শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে সফল ভাবে প্রবেশ করে।
রাজনৈতিক ঐক্যের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। এক. রাজতন্ত্রের পতন ঘটানো এবং নেপালকে জনরাষ্ট্রে রূপান্তর; দুই. স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা বিধান করা; তিন. একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে্র অধীনে নেপালের জন্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু করা; চার. আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির বাস্তবতা আমলে নিয়ে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় রূপ দেওয়া যা টিকে থাকতে পারে বা টিকে যায়; কিন্তু যেন একই সঙ্গে রাজতন্ত্র, বর্ণাশ্রম প্রথার মতো প্রাচীন ও সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কগুলোর উৎখাত কিম্বা ক্রম বিলুপ্তির শর্ত তৈরি করা সম্ভব হয়। নেপালের জনগণ একটি উদার গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র বা লিবারেল গঠনতন্ত্রই চেয়েছে। যে রাজনৈতিক ঐক্য তারা অর্জন করতে পেরেছিল তার ওপর দাঁড়িয়ে অবাস্তব কোন চিন্তা দ্বারা তারা তাদের জয়কে দুর্বল করতে চায় নি। জনগণের বিজয়কে সংহত করাই ছিল প্রধান কাজ।
গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় রাজতন্ত্রের পতনের পরপরই। রাজতন্ত্রের পতনের পরপরই রিপাবলিক বা জনরাষ্ট্র হিসাবে নেপালের আবির্ভাব একটি বিশাল বিজয়। এর পর পরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেপালের জনগণ যে রাজনৈতিক কর্তব্য তাদের হাতে তুলে নেয় সেটা হচ্ছে নতুন একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন। অর্থাৎ সমাজের সকলের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় যথাসাধ্য ধারণ করে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তির প্রশ্নে সকলের একমত হওয়া এবং একটি দলিল হিসাবে তা কনস্টিটিউন্ট এসেম্বলিতে গ্রহণ করা। সফল ভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু করতে পারা ছিল রাজতন্ত্রের পতনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাংলাদেশে আমরা মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর এই কাজ করতে পারি নি। আমি মনে করি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের কাজ আরম্ভ করতে পারা এক বিশাল বিপ্লবী পদক্ষেপ। এই ক্ষেত্রে নেপাল সফল হবে, সত্যি বলতে কি, সেটা আগাম প্রত্যাশা করাও ছিল কঠিন। কিন্তু সমাজে যতোই বিভেদ, ক্ষত, পার্থক্য ও ভিন্নতা থাকুক জঙ্গণকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে পরিগঠনের জন্য এই প্রক্রিয়ার কোন বিকল্প নাই। নেপালের সাফল্য প্রমাণ করে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার দিক থেকে নেপালের জনগণের এক বিশাল উল্লম্ফন ঘটেছে যার সুফল নেপালের জনগণ অবশ্যই পাবে।
নেপাল যেখানে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দেখিয়েছে সেটা হোল বিপুল জনগোষ্ঠিকে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা। আগেই বলেছি, এটা নেপালের সাত নম্বর গঠনতন্ত্র। কিন্তু এটা কোন রাজার বা কোন নির্বাহী ক্ষমতার জোরে প্রণয়ন করা হয় নি। এই কাজ নেপাল করেছে একটি গঠনতন্ত্র সভা বা পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়ে। আর সেটা গঠন করা হয়েছে সমাজের সকল শ্রেণি, বর্ণ, গ্রুপ, দল, মতাদর্শিক প্রতিনিধিদের নিয়ে। শুরুতে ধাক্কা খেয়েছিল নেপাল। প্রথম যে কনসটিটুয়েন্ট এসেম্বলি বা গঠনতন্ত্র সভা গঠন করা হয়েছিল তারা নতুন সংবিধান সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেটা ২০১২ সালে ভেঙ্গে যায়, নতুন গঠনতন্ত্রসভা গঠিত হয়। প্রায় আটবছর টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে নেপাল নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ করে ও তা গঠনতন্ত্র পরিষদে (constituent assembly) গৃহীত হয়।
পত্রপত্রিকায় এই ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা নিয়ে কথা উঠেছে। পত্রপত্রিকায় ভারতের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার খবরটাই বিশেষ ভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে। বিস্ময়কর মনে হলেও নেপালের সংবিধান নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে ভারত। সংবিধান হচ্ছে নেপালের, কিন্তু আপত্তি করছে ভারত। গঠনতন্ত্র গৃহীত হবার একদিনের মধ্যেই “নেপালের নেতাদের কাছে সরকারী চ্যানেলে’ ভারত আপত্তি জানিয়েছে। এটা ভারতের পত্রিকারই খবর। ( ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দেখুন)।
যে ইস্যুতেই ভারত আপত্তি করুক সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। নেপালের গঠনতন্ত্র দিল্লীর মনঃপূত না হওয়ায় ভারতের আপত্তি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নতুন গঠনতন্ত্রে ‘ফেডারেল’ ব্যবস্থার চরিত্র নিয়ে তর্ক চলছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খবর হচ্ছে নেপাল ভারতের আপত্তি আমলে নেয় নি। যে রাজনৈতিক ঐক্য নেপালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মতাদর্শ, শ্রেণি, জনজাতি ও বর্ণের মধ্যে গড়ে উঠেছে সেই শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে দিল্লিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পারছে নেপাল। একটি পরদেশ বেষ্টিত দেশ হয়েও নেপালের জনগণ তাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যে ঐক্য ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করছে তাতে নেপালের জনগণের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রশংসা না করে পারা যায় না। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের গঠনতন্ত্রে হস্তক্ষেপ করে ভারত খুবই খারাপ নজির তৈরি করল। কিন্তু ভারত গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রভাবিত করবার কাজেই শধু থেমে থাকে নি। ল্যান্ড-লক নেপালে ভূয়া অজুহাতে জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জরুরি সামগ্রীর প্রবেশও বন্ধ করে দিয়েছে।
আমাদের নেপালি বন্ধুরা আমাদের চিঠি দিয়ে জানাচ্ছেন যে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ভারত বন্ধ করেছে তা নয়, এমনকি হাসপাতালের জন্য জরুরী সামগ্রীও ভারত বন্ধ করে দিয়েছে। যেমন অক্সিজেন, এমনকি ডায়ালাইসিসের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রীও। বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো জ্বালানি নিচ্ছে দিল্লী থেকে। এতে তাদের সময় নষ্ট হচ্ছে খরচও বাড়ছে। ভারতের এই আচরণ অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই ভারত। তবে ভারতের জনগণ আর ভারতের শাসক শ্রেণিকে আমরা যেন আবার একাকার না করি।
ভারতসন্নিহিত নেপালের তরাই অঞ্চলে মধেসীদের বাস। নতুন সংবিধান ‘ফেডারেল’ ব্যবস্থাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছে তাতে তারা খুশি নয়। ভোট ব্যবস্থার প্রস্তাবনাতেও অখুশি। তাদের আপত্তি যে ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব কমে যাবে এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাদের প্রভাব (পড়ুন, দিল্লীর প্রভাব ) কমবে। আজ এখানে এই তর্কগুলো তুলবনা, যদিও নেপালের নতুন সংবিধান পুংখানুপুংখ ভাবে বিচার ও আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দিকগুলো বোঝার দরকার আছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গঠনতন্ত্র প্রণয়ণ প্রক্রিয়া এবং নেপালের জনগণের সেই প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ। যারা বিরোধিতা করছে তারা যে ভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত সেটা স্পষ্ট। কিন্তু নেপালের নতুন গঠনতন্ত্র নিয়ে বিতর্কের গোড়ায় রয়েছে ভারতীয় আধিপত্যের বাইরে নেপালের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা সুরক্ষা। সেটা করতে গিয়ে বিভিন্ন দল, শ্রেণি ও বর্ণের যে গণঐক্য নেপালে গড়ে উঠেছে তা খুবই ইতিবাচক।
নেপালের জনগণের সাফল্য বুঝতে হলে গৃহযুদ্ধের ক্ষত যেমন বুঝতে হবে একই সঙ্গে বুঝতে হবে যে নেপালে কম পক্ষে ১২৫টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি ও ১২৩টি ভাষা রয়েছে। বিভিন্ন ও বিচিত্র জন গোষ্ঠিকে একত্র করে নেপাল যেভাবে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে একটি ফেডারেল ধাঁচের গঠনতন্ত্র ঘোষনা করেছে তাতে নেপালের জনগণকে অভিনন্দন জানাতে হয়। এটা ছিল নেপালের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার একটি প্রান্তিক দেশের জনগণ দেখিয়ে দিল ভুলত্রুটি ও মাঝেমধ্যে পথচ্যূত হওয়ার পরেও রাজনৈতিক চিন্তা ও দূরদর্শিতার দিক থেকে তারা ইউরোপের অর্জনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। নেপালের সাফল্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ণের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা।
আসুন, আমরা নেপালের বিপ্লবী জনগণের পক্ষে দাঁড়াই এবং ভারতীয় আধিপত্যের নিন্দা করি।
সূত্রঃ চিন্তা
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই