সাদিয়া এইচ. তানহাঃ
নীলমনি, সীতাহার, তালিপাম, কুরচি, সোনালী বাঁশ, উদর পদন, অশোক কিংবা অর্জুন। একেকটি বিরল প্রজাতির সব বৃক্ষ। এদেরকে সহজে দেখার সৌভাগ্য হয় না নগরবাসীর। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গেলে এমন সব বিরল প্রজাতির গাছ-পালার দেখা মেলে খুব সহজেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি জায়গায়ই রয়েছে এমন চমকপ্রদ সব ফলজ, ভেষজ ও বনজ বৃক্ষের সারি ও অপূর্ব সুন্দর ফুলের বাগান। বাগান আছে কেন্দ্রীয় মসজিদে, শহীদ মিনারে। বাগান আছে রোকেয়া হল থেকে নীলক্ষেত আইল্যান্ড পর্যন্ত; বাগান আছ উপাচার্যের বাসভবনে, মলচত্বরে, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে, টিএসসি এবং সাইন্স এনেক্সে।
কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগান এলাকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কার্জন হলে রয়েছে উদ্ভিদ বিজ্ঞান উদ্যান ও ভেষজ উদ্যান। এ দুটি উদ্যানই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অন্তর্গত। ভেষজ উদ্যানে কালোমেঘ, মহাভৃঙ্গরাজ, সবুজ গোলাপ প্রভৃতি দেশী-বিদেশী বিচিত্র সব ভেষজ উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। অপরদিকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান উদ্যানেও রয়েছে গাছ-পালার সমৃদ্ধ সংগ্রহ, এমনকি ছোট জলাশয় ভর্তি শাপলা ফুল ও কচুরিপানাও রয়েছে উদ্ভিদ বিজ্ঞান উদ্যানে। কার্জন হলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ কার্জন হলে ভীড় জমায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পুরনো গাছটিও কার্জন হলে অবস্থিত। এই গাছটি হলো ৮০ বছর বয়সী একটি মেহগনি গাছ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বুকে নিয়ে এই গাছটি কার্জন হলের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কার্জন হলে কর্মরত মালী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দুবার গাছ লাগানো হয়। একবার শীতকালে, আরেকবার গ্রীষ্মকালে। গ্রীষ্মকালীন উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেনা (কলাবতী), সূর্যমুখী, জারবেরা, দোঁপাটি, ছোট ঝাঁউ, অরকোরিয়া, ম্যাগনোলিয়া, সিলভারা, মন্দারজাউ, পাম, নাগেশ্বর, দেবদারু, কাঁঠগোলাপ, নীলমনি, কুল, কচি, জেবরোবা, টগর, ক্যাকটাস, আমেন্ডা, রঙ্গন, মাইমেন্ডি, পঞ্চপাথর, রাঁধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া। আর শীতকালীন উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে ডালিয়া, আস্টর, কেলেন্ডোরা, গাঁদা, কসমস, সেলফিয়া, বারবিনা, হলিহক্স, ফ্লক, চন্দ্রমল্লিকা, অগ্নিশ্বর, ঝাঁউগাছ। আবার বর্ষায় ফুটে থাকে কেনেল, নয়নতারা, দোঁপাটির মতো কিছু সুন্দরী ফুল। অন্যদিকে পেঁপে, নারকেল , আমগাছের মতো ফল গাছ লাগানো হয় উপাচার্য, বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট এবং আবাসিক শিক্ষকদের বাসভবনে।
উপাচার্যের বাসভবনে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে একটি বিশাল ইউক্যালিপটাস গাছ। সাথে বড় বড় গাছের মধ্যে রয়েছে কেননবল, মষন্ডা, দেবদারু, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি গাছ। উপাচার্যের বাসভবনে কর্মরত মালী শ্রীকৃষ্ণ জানান, এসব গাছ স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকে এখানে বিরাজমান। তিনি স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, স্বাধীনতার আগে রেজিস্টার্ড বিল্ডিং এলাকা, সূর্যসেন হল এলাকাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জায়গাই ছিল অপরিকল্পিত জংলার মত। কিন্তু পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে বাগান করার মাধ্যমে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারাই বদলে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি জানান, কার্জন হল এলাকাটিতে সবসময়ই পরিকল্পিত বাগান ছিল। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আলাপচারিতার এক ফাঁকে এটাও জানা যায় যে, কলাভবনের যে দুটি বটগাছ এখন মাতৃস্নেহে ছায়া বিলিয়ে যাচ্ছে ঢাবিতে অধ্যয়নরত তার সন্তানদের, তার একটিকে স্বাধীনতার পর পুরোপুরি কেটে ফেলে সেখানে নতুন করে আরেকটি বট গাছ লাগানো হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন ও বাগান করা এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে বেশ কিছু সংগঠন। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সংগঠন হচ্ছে আরবরি কালচার দপ্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৃক্ষায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন কমিটি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন ও বাগানের দায়িত্বে কর্মরত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ন সংগঠন হচ্ছে আরবরি কালচার দপ্তর। এক কথায় বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সকল বাগান ও গাছপালা আরবরি কালচার দপ্তরেরই নিয়ন্ত্রানাধীন। এই দপ্তর বিশ্ববিদ্যালয়ের খালি জায়গায় ফুল গাছ দিয়ে বাগান করা, মল চত্বরকে সাজিয়ে তোলা, কার্জন হলের সৌন্দর্য বর্ধন, এমন কি হল ও ভিসির বাসভবনের বাগান সংক্রান্ত নির্দেশনা দানের কাজগুলোও করে থাকে। আরবরি কালচার দপ্তরের পরিচালক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ডঃ মিহির লাল সাহা। এই দপ্তরের নিজস্ব বাজেট রয়েছে।
আরবরি কালচার দপ্তরের টেকনিক্যাল অফিসার ফেকুলাল ঘোষ কমলের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবুজায়নের জন্য আরবরি কালচার দপ্তরের বাজেট হচ্ছে বাৎসরিক সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য এই বাজেট যথেষ্ট না হওয়ায় প্রতি বছরই বাজেট ঘাটতি দেখা দেয়।
তিনি আরো জানান,পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাগানগুলোতে মালীর সংখ্যা শতাধিক। মালী ও বাগানসংশ্লিষ্ট সকলের বেতন-ভাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঠিক করে থাকে।
অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৃক্ষায়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন কমিটি ১৯৯১ সাল থেকে পুরোদমে কাজ করে চলেছে যার প্রধান হিসেবে পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য নিযুক্ত হন। ২৭ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশ রক্ষা করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজায়ন করা, সুশৃংখলভাবে বৃক্ষরোপন করা এবং ক্যাম্পাসের ঝুঁকিপূর্ণ গাছ কাটাসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকে। আর এই কাজ তারা করে আরবরি কালচার দপ্তরের সহায়তায়।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও সারা বিশ্বে অপরিকল্পিত বৃক্ষ নিধনের ফলে সবুজের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। কিন্তু শত সমস্যা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সবুজ সৌন্দর্যের অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছে। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে, তেমনি দেশকে সবুজ ও সুন্দর রাখার ক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই গড়তে পারে উদাহরণ , নিতে পারে অগ্রণী ভূমিকা।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া