সাম্প্রদায়িকতা ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১) ; তিনি নন্দিত-নিন্দিত-সমালোচিত । যেভাবেই হোক না কেন তিনি আলোচিত । তাঁকে ছাড়া আলোচনা চলতেই পারে না । হোক সেটা সমাজনীতি, রাজনীতি , অর্থনীতি, জমিদার প্রথা বা সাহিত্য যে বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হোক না কেন কোনো না কোনো ভাবে তিনি উপস্থিত হবেনই । এমন কোনো বিষয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে রবীন্দ্রনাথের মেধার আঁচড় পড়েনি । তিনি অজস্ত্র দেখেছেন , অজস্ত্র ভেবেছেন, অজস্ত্র লিখেছেন । তিনি কবি, তিনি সাহিত্যিক, তিনি শিল্পী, তিনি বৈয়াকরণিক, তিনি সমাজ সংস্কারক, তিনি দার্শনিক, তিনি ঋষি, তিনি জমিদার , তিনি মানুষ । মানবতার জয়ধ্বনিতে মুখরিত তার সাহিত্য । মানুষের অন্তর্গত রুপকেই তিনি বেশি বাঙময় করে তুলেছেন তাঁর সাহিত্যে । এজন্য অনেক সমালোচক তাঁকে বাস্তবতা বিবর্জিত কল্পনার কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন । তাতে কোনো ভাবেই রবীন্দ্রনাথের জাত যায় নি । রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প পড়লেই ঐ সব সমালোচক তাদের উত্তর পেয়ে যাবেন । অথবা ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘শেষ লেখ’ পর্যন্ত কাব্য গ্রন্থ গুলো পড়লেও সেসব সমালোচকদের মুছে ছাই পড়বে । রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া ভারতবর্ষ নিয়ে আলোচনা করা যায় না । অখন্ড ভারতের শিরোমনি তিনি ।
কিছু গোঁড়া মুসলমান রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক বলে গালি দিয়ে থাকে । এটা রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িকেও হয়েছে এখনো হচ্ছে ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা আছে । রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক তাতে মুসলমানদের সমস্যা থাকার কথা নয়, কারণ পৃথিবীতে কোনো না কোনো ভাবে সবাই সাম্প্রদায়িক । সাম্প্রদয়িকতা যদি জাতি নিয়ে হয় তাহলে বাঙালি অথবা বাংলাদেশি হিসেবে আপনিও সাম্প্রদায়িক । সাম্প্রদায়িকতা যদি ধর্ম নিয়ে হয় তাহলেও আপনি সাম্প্রদায়িক । সাম্প্রদায়িকতা যদি মননের ক্ষেত্রে হয় তাহলেও আপনি সাম্প্রদায়িক । যদি মানবতাবাদের কথা বলেন তাহলে মানবতাবাদী হিসেবে আপনি একজন সাম্প্রদায়িক । যারা অসাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়া তুলছেন তাদের জানা উচিত অসাম্প্রদায়িকরাও এক প্রকার সাম্প্রদায়িক। অসাম্প্রদায়িক বলে আলাদা যে মতবাদের জন্ম দেয়া হচ্ছে তা কি প্রকারান্তরে সাম্প্রদায়িকতা নয় ? সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে মানুষকে বের করে এনে অসাম্প্রদায়িকতার অনলে দাহ করার প্রচেষ্টা কতোটা মানব সমাজের জন্য উপযোগী তা চিন্তার বিষয় । মুসলমানদের আক্ষেপ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কিছুই লিখেননি অথচ নজরুল হিন্দু ধর্মের সব দেব-দেবিদের এমনকি হিন্দু ধর্মাবলম্বী সব বড় মানুষদের নিয়ে লিখেছন । রবীন্দ্রনাথ বেড়ে উঠেছেন হিন্দু পরিবারে । হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখবেন কেন ? নজরুল হিন্দু দেব দেবিদের নিয়ে লিখেছেন আবার তাদেরকে কটাক্ষও করেছেন । তাছাড়া হিন্দু দেব-দেবি কিংবা হিন্দু ধর্মাবলম্বী বড় মানুষদেও নিয়ে লিখতে খুব বেশি সচেতনতার দরকার হয় না কিন্তু হযরত মুহাম্মদ(সা.) কে নিয়ে লিখতে হলে অনেক বেশি সচেতন হওয়া দরকার । একটু এদিক সেদিক হলেই ধর্মীয় দিক থেকে সমস্যা আছে । আমার কাছে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে না লিখে ভালোই করেছেন । তিনি তাঁর ধী-শক্তির পরিচয় দিয়েছেন । তিনি মুসলমানদের পক্ষেও লিখেন নি বিপক্ষেও লিখেন নি ।
আমাদের জানা থাকা দরকার ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদার হয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন তখন সেখানকার পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথই প্রথম হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ তুলে দেন । রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দারকানাথের আমল থেকে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে সম্ভ্রম ও জাতিবর্ণ অনুযায়ী বসার বন্দোবস্ত থাকত । হিন্দুরা চাদরঢাকা সতরঞ্জির উপর একধারে , তার মধ্যে আবার ব্রাহ্মণের স্থান আলাদা এবং চাদর ছাড়া সতরঞ্জির উপর মুসলমান প্রজারা বসত অন্যধারে । সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরাও নিজ নিজ পদ মর্যাদা মত বসতো পৃথক আসনে । আর বাবু সাহেবের জন্য ছিল ভেলভেটমোড়া সিংহাসন । বরণের পর রবীন্দ্রনাথ সিংহাসনে বসার কথা কিন্তু তিনি বসলেন না । তিনি নায়েবকে জিজ্ঞাসা করলেন : নায়েব মশাই পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে এমন পৃথক পৃথক ব্যবস্থা কেন ? নায়ব বললেন : বরাবরই এই নিয়ম চলে আসছে । রবীন্দ্রনাথ বললেন না শুভ অনুষ্ঠানে এই নিয়ম চলবে না । সব আসন তুলে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান , ব্রাহ্মণ-চাঁড়াল সবাইকে একইভাবে একই আসনে বসতে হবে । নায়েব মশাই সেটা করতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন । তখন রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ দিলেন : আমি বলছি তুলে দিতে হবে । এ রাজ দরবার নয় , মিলনানুষ্ঠান । নায়েবের একই জবাব : অসম্ভব, নিয়ম ভাঙা চলবে না । নায়েব রবীন্দ্রনাথকে আবার অনুরোধ করলেন আসনে বসার জন্য কিন্তু তিনি বসলেন না এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন , আসনে জাতিভেদ দূর না করলে তিনি কিছুতেই বসবেন না, সাধারণ দরিদ্র প্রজার অপমান তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। সদর নায়েব জমিদারের হুকুম অমান্য করায় রবীন্দ্রনাথ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন : “ প্রাচীন প্রথা আমি বুঝি না, সবার একাসন করতে হবে । জমিদার হিসেবে এই আমার প্রথম হুকুম । ”
জমিদারি সম্ভ্রম আর প্রাচীন প্রথায় আস্থাবান সদর নায়েব এবং অন্যান্য সব হিন্দু আমলারা এক সঙ্গে হঠাৎ ঘোষণা করে বসলেন প্রথার পরিবর্তন হলে তারা সবাই একযোগে পদত্যাগ করবেন । রবীন্দ্রনাথ এতেও বিচলিত হলেন না । তিনি বরং প্রজাদের বললেন; প্রিয় প্রজারা তোমরা সব পৃথক আসন পৃথক ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে বসো । আমিও বসব । আমি তোমাদেরই লোক । অপমানিত নায়েব গোমস্তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সব প্রজারা নিচে বসেছে আর রবীন্দ্রনাথ তাদের মাঝখানে; এ এক অপরুপ দৃশ্য । তারপর রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের পাঠালেন নায়েব গোমস্তাদের ধরে আনার জন্য । তারা আসলেন রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে পদত্যাগ পত্র পত্যাহার করার অনুরোধ করলেন । উঠে গেল জাত-পাতের প্রথা । ঐ দিনই রবীদ্রনাথ ঘোষণা করলেন “ সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে । এটাই আমার সর্বপ্রধান কাজ ।” আমরা সবাই জানি সাহা হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায় আর শেখ হল মুসলিম । রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের অত্যাচার থেকে মুসলমানদের বাঁচানোটাকে তাঁর সর্বপ্রধান কাজ বলে মনে করেছেন।
মুসলমানদের আরেকটা অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন -ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বিরোধী সমাবেশে সভাপতি ছিলেন । আমাদের মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ মহামানব ছিলেন না, তিনি রক্তে মাংশে গড়া মানুষ ছিলেন । তিনিও দু’ একটা ভুল করতে পারেন। হয়তো এটা তাঁর ভুল ছিল । যেখানে একটা পুরো জীবন মানবতার কল্যাণে ব্যায় হয়েছে সেখানে দু’একটা ভুলকে বড় করে তোলা কতটা যুক্তিক ? রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য চেয়েছিলেন এজন্য তিনি রাখিবন্ধন অনুষ্ঠানেরও চালু করেছিলেন ।
বাঙালির মননের বিকাশে রবীন্দ্রনাথের দান অনস্বিকার্য । রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িকও নন অসাম্প্রদায়িকও নন, তিনি একজন আধুনিক মনন সম্পন্ন ব্যক্তিত্ববান মানুষ ।
নির্ঝর আহমেদ প্লাবন
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ