সম্ভাব্য আতঙ্কবাদীর প্রতি পুলিশ অফিসারের খোলা চিঠি

প্রকাশঃ জুলাই ১২, ২০১৬ সময়ঃ ১:২৫ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১:২৫ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ

Untitled

সম্প্রতি ফেসবুকে “বাংলাদেশ মেরিন” পেইজে সম্ভাব্য আতঙ্কবাদী বা জঙ্গীর বিরুদ্ধে একজন পুলিশ অফিসারের একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিক্ষণের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

“প্রিয় ভাইয়া,
এ চিঠিটি যদি তোমার চোখে পড়ে, ধরে নিচ্ছি
আমি এ পৃথিবীর সবচাইতে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের
একজন। আল্লাহর সরাসরি রহমতের কারণে
তোমার আর আমার ভেতরে যোগাযোগ
হতে যাচ্ছে- এই ভয়াবহ সময়ে এটাকে মিরাকলই
বলতে হবে!
আমার কথা একটু বলি, পেশায় আমি একজন পুলিশ
অফিসার, প্রায় ছয় বছর ধরে সার্ভিসে আছি। আমি
জানি তুমি আমাদের ঘৃণা করো, এবং এই ঘৃণার
পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ধরে নিচ্ছি
আমাকে তুমি হত্যা করতে চাও- সেক্ষেত্রেও
কিন্তু এই চিঠিটা তোমাকে আমার চিন্তাধারা বুঝতে
সাহায্য করবে। কষ্ট করে পড়তে থাকো প্লিজ!
চাকুরিজীবনে আমি বিচিত্র ধরণের সব অপরাধের
তদন্ত হয় নিজে করেছি নাহলে সহকর্মীদের
করতে দেখেছি। চাকুরির অংশ হিসেবে আমাকে
মুখোমুখি হতে হয়েছে খুনী, ধর্ষক, চোর,
ডাকাত এবং উগ্রবাদীদের। এই সব লোকদের
সাথে গভীরভাবে চলাফেরা করে আমি একটা
সত্য তীব্রভাবে বুঝতে শিখেছিঃ এই
পৃথিবীতে কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায়না।
কেউ না।
পুলিশ অফিসার হিসেবে আমাকে ভীষণ কড়াভাবে
চলতে হয়।আমি প্রায় সর্বক্ষণ প্রিয় বেরেটা
নাইন্টিটু পিস্তলটি সাথে রাখি, সেই সাথে থাকে
প্রচন্ড ধারালো কমান্ডো ছুরি- মেজর ফেরদৌস
ভাই ওটা উপহার দিয়েছিলেন।
প্রয়োজনের সময় ট্রিগার টিপতে এক
সেকেন্ড দেরি করাও আমাদের মানায় না। এই
কঠোর জীবনের ভেতর থেকে আজ
তোমাকে এমন কিছু কথা বলব যা আগে কাউকে
বলিনিঃ
জানো, এ পর্যন্ত যতগুলো অপরাধীর
মুখোমুখী হয়েছি, – আমি এদের
প্রত্যেককে গভীরভাবে অনুভব করি। যে
পরিস্থিতিতে এরা জন্মে এবং যেসব অভিজ্ঞতার
মধ্যে দিয়ে এরা যায়- এই একই অভিজ্ঞতাগুলোর
ভেতর দিয়ে আমি গেলে আমাকেও হয়ত আজ
পুলিশের বদলে অপরাধী হিসেবে দেখতে
পেতে।
এই যে গুলশানের জঙ্গী হামলার ঘটনা- সবাই
এখানে প্রশ্ন করছে, ধনী পরিবারের সন্তান
হয়েও কেন ওরা এই কাজগুলো করল? এরা যদি
মাদ্রাসার ছাত্র হত, তাহলে হয়ত খুব সহজেই একটা
স্টেরিওটাইপ ধারণা বসিয়ে দেয়া যেত।
এই যে অল্পবয়ষ্ক ছেলেগুলো এরকম
ভয়ঙ্কর দানবে পরিণত হচ্ছে- এই ঘটনাগুলো
তাদের মাদ্রাসা বা ইংলিশ মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড ছাপিয়ে
একটা নির্মম সত্য সপাটে চড় মেরে আমাদের
বুঝিয়ে দেয়-
We failed them. All of us.
কাউকে আমরা উচ্ছন্নে ঠেকে দিয়েছি তার
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না দিয়ে, বাকিদেরকে ধ্বংস
করেছি তাদেরকে সুস্থ্যভাবে বড় হবার পরিবেশ
না দিয়ে। পাজির পা ঝাড়া আতঙ্কবাদী মাস্টারমাইন্ডগু
লো এই অসুস্থ্য পরিবেশের সুযোগ নিচ্ছে
মাত্র।
গুলশানের সুরক্ষিত এলাকায় এরকম একটা আক্রমণ
চালাতে দরকার প্রচন্ড সাহস, দৃঢ় সংকল্প, বুদ্ধিমত্তা
এবং আগ্রহ। এ চারটি গুণই কিন্তু একটা মানুষকে
জীবনে সফল করে তোলে। কি মর্মান্তিক
ব্যাপার- এই একই গুণগুলো ব্যবহার করা হল
নৃশংসভাবে নিরীহ মানুষদের খুন করতে!
তোমাদের বয়েসে আমি মাত্র দশ বছর আগে
পার করেছি।অস্ত্রহাতে দুর্ধর্ষ কোন কাজ হাতে
নিলে নিজেকে ঠিক সুপারম্যানের মত লাগে,
তাইনা?!
এবার মুদ্রার উলটো পিঠের কথা বলি। যাদেরকে
হত্যা করার কথা ভাবছো, ভুলে যাও তাদের কথা-
ভুলে যাও সারা পৃথিবীর কথা। সারাজীবন বয়ে
বেড়াতে হবে এরকম কোন কাজ করে ফেলার
আগে একবার নিজের কথা গভীরভাবে ভাববে,
প্লিজ!
নীচের কিছু বিষয় তুলে ধরি, কেমন?
# এক ) গুলশানের জঙ্গীদের বুলেটবিদ্ধ, বিকৃত
লাশগুলো দেখেছো তো, তাইনা? কল্পনা
করতে পারো তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে
তোমার মায়ের কেমন লাগবে? “আমার ছেলে
একটু আগে বিশজনকে জবাই করে হত্যা
করেছে, আর এখন লাশ হয়ে পড়ে আছে”- কি
অধিকার আছে তমার তাঁকে এই নরক যন্ত্রনার
ভেতর দিয়ে যাওয়ানোর?
# দুই) কোনকিছু প্রমাণ করতে কি আসলেই
কাউকে খুন করা লাগে? সতের বছর বয়েসে
ধরা যাক বিশজন কাফেরকে খুন করে সারা বিশ্বকে
তুমি তাক লাগিয়ে দিলে, নিজেও মরলে। এর
বদলে চিন্তা করো তো, তুমি একজন ইসলামিক
স্কলার হলে, আশি বছর পর্যন্ত বেঁচে লক্ষ
লক্ষ মানুষের কাছে শান্তির বানী পৌঁছে দিচ্ছ!
এভাবে চিন্তা করা যায় ব্যাপারটা?
# তিন ) ধরে নিচ্ছি তুমি অস্ত্রশস্ত্র আর অভিযান
পছন্দ করো। পুলিশে/মিলিটারিতে যোগ দিচ্ছনা
কেন? হ্যাঁ, পুলিশ খারাপ ধরে নিলাম। আরে বাবা, এই
জন্য তো আরো বেশি করে এই বাহিনীতে
আসতে হবে! একটা দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমের
ভেতরে থেকেও তুমি বুক চিতিয়ে সৎভাবে
অসহায় মানুষের জন্যে কাজ করে যাচ্ছ- চিন্তা
করো তো আল্লাহ পাক এটা কত ভালবাসবেন!!
একজন পেশাদার পুলিশ অফিসার হিসেবে একটা কথা
বলি, কেমন?
ট্রিগার টেপাটা খুব কঠিন কিছু না। সার্ভিস ইস্যু যে
বেরেটা পিস্তলটা আমি চালাই, এটা দিয়ে ঘন্টা
দুয়েক সময় দিলে তোমাকে আমি মোটামুটি
মানের শ্যুটার বানিয়ে দিতে পারব। সত্যিকারের
কঠিন কাজ হচ্ছে মানুষকে সাহায্য করা, তার মাথায়
বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া তো দুই সেকেন্ডের
ব্যাপার!
অপরিচিত একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি
হেসে তার মন ভালো করে দিয়েছো
কখনো? অস্ত্র দেখিয়ে তাকে ভয়ে আধমরা
করে ফেলার চাইতে ওটা অনেক বেশি
বীরত্বের কাজ। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
মূর্খ, কাপুরুষের দলই সহজ পথ বেছে নিয়ে
নিরীহ মানুষ হত্যা করে। যারা সত্যিকারের দুর্ধর্ষ
মানুষ- এরা কঠিন পথটা বেছে নেয়। নিজের
জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব আর মানবিক আচরণ দিয়ে অচেনা
মানুষকে আরো ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে
তোলাটাই হচ্ছে কঠিন পথ। ওটা অনেক বেশি
বীরত্বপুর্ণ।
ট্রিগার না টেনে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে দেখবে
একবার? মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর “মসনভী”, খলিল
জিবরানের “দি প্রফেট” ? আচ্ছা, নেইল
গেইম্যানের গ্রাফিক নভেল “দি স্যান্ডম্যান?”
সেবা প্রকাশনীর মাসুদ রানা?
তোমার মেধা আর বুদ্ধিমত্তার তুলনায় আমি হয়ত
কিছুই নই, তবুও আমি চাই এই মেধা তুমি ধ্বংস নয়,
সৃষ্টির কাজে লাগাও।
কিছু বলতে চাও আমাকে? নাহ, গোপন তথ্যই শুধু
দিতে হবে এটা বলছিনা। চাইলে আমাকে যা ইচ্ছে
করে বলতে পারো। “এই ছেলেটা এত খারাপ
কেন” বলে তোমার বিচার করবোনা, তোমার
পরিবারকেও ঝামেলায় ফেলবোনা।
মাথায় চড়ে বসা হিংসা, খুনোখুনি আর ধ্বংসের চিন্তাটা
সময় থাকতে ঝেড়ে ফেলো। ফিরে আসো,
প্লিজ! এমন কিছু কোরনা, যা চরম পরিণতি বয়ে
আনে…
আমার ইমেইল এড্রেসঃ [email protected]
তোমাকে ফিরিয়ে আনার অপেক্ষায় রইলাম…
মাসরুফ হোসেন
সিনিয়র এএসপি
বাংলাদেশ পুলিশ
(জাপানে শিক্ষাছুটিতে অধ্যয়নরত)

প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G