সীমানা পেরিয়ে বসন্ত
প্রতিক্ষণ ডেস্ক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
বসেন্ত এলে প্রকৃতির মতোই রঙিন হয়ে ওঠে মানুষের মন। উৎসবের বিনোদনে চাঙা হতে কে না চান!
শীতের কনকনে ঠান্ডার পর বসন্তে প্রকৃতি তার রূপের ডালি মেলে ধরে। তা মানুষের অনুভব ও চিত্তকে ছুঁয়ে যায়।
মন চায় বিনোদনে মজে যেতে, প্রাণের উৎসবে মেতে উঠতে। একসময় দেবী দুর্গার পূজা-অর্চনা বসন্তকালেই হতো। এখন তা হয় না।
তবে বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কালের আবর্তে সেই প্রাচীন উপাসনা এখন আর আগের মতো নেই, তবে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ঋতু পরিবর্তনের এই উৎসব এখন সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে উৎযাপন করে তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত ভাবে চলুন দেখে অাসি অান্তর্জাতিক অঙ্গনে বসন্ত।
ভারত: দেশের বাইরে বসন্ত উৎসব বেশ ঘটা করে উৎযাপিত হয় শান্তিনিকেতনে।
‘ওরে গৃহবাসী, খোল্ দ্বার খোল্, লাগল যে দোল’- এই গান গেয়ে প্রতিবছর শান্তিনিকেতনে উৎসব উৎযাপিত হয়।
ভারতের অন্য প্রদেশগুলোতে এটা হোলি নামে পরিচিত। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী, একদিন অসুর হিরণ্যকশিপু আক্রমণ করে বসলো স্বর্গলোক।
অবতার বিষ্ণু নরসিংহের রূপে এসে হত্যা করলেন এই অপদেবতাকে। রক্ষা পেলো স্বর্গ। সেই শুভদিনকে এই অঞ্চলে স্মরণ করা হচ্ছে স্মরণাতীতকাল থেকে। অপদেবতাকে বধ করার পর থেকে বছরের ওই দিনটি হোলি উৎসব হিসেবে উৎযাপন করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।
চীন: চীনেও এই উৎসব বেশ ঘটা করে উৎযাপন করা হয়। কারণ, চৈনিক পঞ্জিকা অনুযায়ী পিনইন মাসের প্রথম দিন তাদের নতুন বছর শুরু হয়।
এখানেও সেই অপদেবতার গল্প শোনা যায়। নিয়ান নামের এক অপদেবতা শীতনিদ্রা শেষে গ্রামে এসে গরু-ছাগল, শস্য ও ছেলেমেয়েদের ধরে খেয়ে ফেলত। তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মজাদার বিভিন্ন খাবার তৈরি করে চীনারা নিজেদের দরজায় ফেলে রাখত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই খাবার খেয়ে নিয়ান আর কোনো অনিষ্ট করবে না। একদিন গ্রামবাসী অবাক হয়ে লক্ষ করল, নিয়ান লাল রঙের পোশাক পরা এক বাচ্চাকে দেখে ভয় পাচ্ছে।
পরে গ্রামবাসী আবিষ্কার করে, সে লাল রঙ ভয় পায়। এর পর থেকে শীতের শেষে গ্রাম সাজানো শুরু হয়ে যায় লাল রঙের লন্ঠন, ব্যানার দিয়ে। পরে আর কখনো নিয়ানকে দেখা যায়নি। এই উৎসবে চীনারা ঘরে তৈরি করে মজার সব খাবার। চৈনিক নববর্ষের এই উৎসব শুধু চীনারাই নয়, উৎযাপন করে অধিকাংশ মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠী।
ইরান: ইরানে বসন্তের আলাদা মহিমা রয়েছে। শাহনামা আর জরথ্রুস্ত্রিয়ান লোকগাথা থেকে জানা যায়, রাজা জামশিদের আমলে এই উৎসবের প্রচলন হয়।
এখানেও সেই অপদেবতা বধের গল্প। জামশিদ এমন এক অপদেবতা বধ করেন, যে সব প্রাণীর জন্যই হুমকি হয়ে ছিল। বধের সেই দিনটি নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে উৎযাপিত হয়ে আসছে ইরানি সমাজে। মূলত সৌর পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনটি উদ্্যাপন করা হয়। ইরানে এর নাম নওরোজ, মানে নতুন দিন।
প্রায় তিন হাজার বছর ধরে উৎযাপিত এই উৎসবের উৎপত্তি ইরানে হলেও ‘নওরোজ’ আজ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, চীনের উত্তর-পশ্চিম ও ইউরোপের বলকান অঞ্চলে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক নওরোজ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
জাপান: জাপানিরা চেরি ফুলকে বলে সাকুরা। বসন্তে ফোটে এই ফুল। জাপানিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও সৌভাগ্যের প্রতীক সাকুরা।
সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে এই ফুল ফোটার উৎসবে গা ভাসানো শুরু করে জাপানিরা। এ সময় পুরো দেশটাই যেন ছেয়ে যায় চেরি ফুলে। প্রকৃতি অপরূপ হয়ে ওঠে।
এই উৎসবকে বলা হয় হানামি। চেরি ফুল কোরিয়া, চীনসহ অনেক দেশে জন্ম নিলেও জাপানে এর রয়েছে প্রায় চার শরও বেশি প্রজাতি। হানামিতে আয়োজন করা হয় নানা রকম অনুষ্ঠানের। ঐতিহ্যের সঙ্গে এতে মিশেছে আধুনিক উপাদানগুলো। জাপানের বিভিন্ন অঞ্চলে সাকুরা জানুয়ারিতে ফুটতে শুরু করলেও হানামির মূল আয়োজনটা শুরু হয় মার্চ থেকে।
থাইল্যান্ড: সক্রান বা জল ছিটানো উৎসবে থাইল্যান্ড জেগে ওঠে নতুন চেহারায়। এটি শুরু হয় ১৩ এপ্রিল। চলে তিন দিন।
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে এর রয়েছে ব্যাপক মিল। বাংলা ‘সংক্রান্তি’ শব্দটিই সেখানে ‘সক্রান’। আর জল ছিটানোর এই উৎসব আমাদের দেশের মারমা সম্প্রদায়ও উৎযাপন করে।
প্রথা অনুযায়ী, এই উৎসবে জল ছিটানো হয় শরীর ও মনের কালিমা দূর করার বাসনা নিয়ে। জলে ভিজে মানুষ নিজেকে পবিত্র করে নেয়। ধুয়ে ফেলে গেল বছরের গ্লানি। এই উৎসবের সঙ্গে যুগে যুগে যোগ হয়েছে বিভিন্ন আচার। তবে নিয়ম করেই যাওয়া হয় প্রার্থনাগৃহে। তবে শুধু ধর্মের ভেতরেই আবদ্ধ নেই এই উৎসব।
বসন্তের উৎসব যে শুধু এশিয়াতেই হয়, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। ইউরোপেও বেশ ঘটা করে উৎযাপন করা হয়। আয়ারল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি, স্পেন ও ক্রোয়েশিয়ায় সাজ-সাজ রবে করা হয় এই উৎসব। মজার ব্যাপার হলো, কেবল খানাপিনা করেই তা শেষ হয়। তবে স্পেনে খানিকটা ব্যতিক্রম। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে ছেলেমেয়েরা ঘুরতে বের হয়। ট্রাডিশনাল ষাঁড়ের লড়াই আইনিভাবে বন্ধ করা হলেও, এই দিনে কৃত্রিম লড়াই উপভোগ করে স্থানীয়রা।
প্রায় পুরো পৃথিবীতে বসন্ত মানে নতুন জীবনের বার্তাবাহক। জাতি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও দেশভেদে উৎসব পালন করা হয় সেই বার্তাকে মূর্ততা দেয়ার জন্য।
প্রতিক্ষণ/এডি/আকিদুল