কার্তিক ১৩৯২, নভেম্বর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হুমায়ুন আজাদের লেখা ”ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা” শুধুমাত্র একটি বই নয় একটি অসম্ভব ধরনের সুন্দর ও আকর্ষনীয় কিশোর সাহিত্য যার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে লেখকের ফেলে আসা শৈশব জীবনের চারপাশের মানুষের হাসি, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, ভালোবাসা, কিয়ৎ ঘৃণা, অপরুপ নয়ন জুড়ানো রাড়িখাল গ্রামের বর্ণনা, সর্বোপরি বইটি যেন শৈশববেলার ধারাবিবরনীর এক টুকরো খণ্ডচিত্র।
মোট ১৭ টি শিরোণামের কোলে লুকিয়ে থাকা ১৭ টি অংশে বিভক্ত এ বইটিতে হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহীভাবে তুলে ধরেছেন মন আকুল করা গাঁয়ের ডাক, ফুলের গন্ধের নমুনা, আড়িয়ল বিলের জলে প্রদীপ জ্বলার কথা, খেজুর ডালে প্রিয় শাদা বেলুন ফুঁটো হওয়ার কথা, টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার ছন্দের সুরলহরী, গ্রামের সহজ সরল মুন্নাফ ভাইদের শিংয়ের পোকা ধরা সহ পূকপুকুরে মানুষের ঢলের কথা…..
“মৌলি, তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি এক সময় ছিলাম-ছোট, ছিলাম গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে শাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর গাছের ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলদে ফুল।
একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার উপর একটি কাঠের সাঁকো। নিচে সাঁকোর টলোমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম” বড় মেয়ে মৌলিকে বলার ঢঙ্গেই শুরু করেছেন ফুলের গন্ধ অধ্যায়টি, এঁকেছেন গাঁয়ের ছবি। ছবিখানা এখনকার কোন ছবি নয় আজ থেকে পাক্কা বছর পঞ্চাশেক পূর্বের ধ্রুবতারার মতোন মনের আবেশে ভর করা আশ্বিনের সাদা মাখন জোৎস্না আর হিম মাঘের ওশ-মাখা বাতাসে ভরপুর কোন গাঁয়ের ছবি।
যে গাঁয়ে ছিল শিশিরের আস্তরণ, কচুরি ফুলের শোভা, নালি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়া খেজুর রসের ঘ্রাণ, লেবুতলার গন্ধ, সরপুঁটির মন উজাড় করা অপূর্ব লম্ফ-ঝম্ফ, শাঁই শাঁই করে ছুটে আসা রাগী বোশেখের তান্ডব, পুকুরে জ্বলা শতোশতো প্রদীপ-ঝাড়বাতি, ঢল ঢল কাঁচা লাউডগার অনেক দূরে যাবার স্বপ্ন, ছিল শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে দিগন্তের দিকে ছুটে চলা এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদূরপিয়াসী স্বপ্ন।
দারুনভাবে বর্ণিত হয়েছে পৌষের কুয়াশার চুলোর পাড়ের ওম, খেজুর রস জ্বাল দেয়ার মধুময় সন্ধেটার অপূর্ব হাতছানির দুলুনি, সঙ্গে পিঠে শিল্পী মা, পানু আপা আর নুরু আপাদের দুর্দান্ত কারুকাজ: “পৌষের কুয়াশায় চুলার পাড়ে কি যে সুখ! আমার চোখ পড়ে চুলার ভেতরের দৃশ্যের ওপর। চারপাশ তখন স্বাদে ভরা-রসের ঘ্রাণ, নারকোলের সুগন্ধ,ঘন দুধের গাঢ় ঘ্রাণ। আর ঐ চুলার ভেতরে দাউ দাউ জ্বলছে সৌন্দর্য।
চুলার ভেতরে কি ফুটেছে একলক্ষ গোলাপ? লাল হয়ে উঠেছে কৃষ্ণচূড়ার বাগান? না, চুলার ভেতরে দাউদাউ জ্বলছে সুগন্ধি আমকাঠের চলা; আর তার টুকরোগুলো বিশাল দামি হীরকখণ্ডের মতো দগদগ করছে” যে-দিন পুকুরে মানুষ নামে শিরোনামের কোলজুড়ে এসেছে চৈত্র মাসের কোন একদিন হৈ-হুল্লোড় করে পুবপুকুরে আশপোশের গ্রাম থেকে আসা মানুষদের পল দিয়ে একসঙ্গে মাছ ধরার বর্ণনা।
লেখক আশ্চর্য দক্ষতায় এঁকেছেন মাছ মেরে চলে যাওয়ার পর ভীষণ বিষন্ন দেখানো পুবপুকুরের অদ্ভুত হয়ে থাকা ঘোলা জলের দৃশ্য। এ অধ্যায়টি ভীষনভাবে মন খারাপ করে দেয় যেখানে প্রিয় আজাদ ছিঁড়েফাড়া কচুরিপানাগুলোকে তুলনা করেছেন সাতাশে মার্চ, ১৯৭১ এ নিরুদ্দেশ পথে যাত্রা শুরু করা ভীত, ছন্নছাড়া মানুষদের দলের সঙ্গে। যারা ছুটে চলেছে দিক সীমানা বিহীন। বইটিতে লেখক আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন গ্রাম আর শহরের মধ্যবর্তী বিস্তর ফারাক, শৈশবের নিষ্পাপ চোখে দেখেছেন ক্ষুধায় কাতর জোলাবাড়িসহ তার আশপাশ।
ক্ষুধায় কাতর মানুষদের ভাতের প্রতি মুগ্ধতা দেখে তুলনা করেছেন হীরে-পান্না-মণি-মাণিক্য সদৃশ। গ্রাম কবিকে ডেকেছে, সেই সঙ্গে আমাদেরও। ভরা বর্ষার মুগ্ধতার পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন তার নানা বাড়ি কামারগাঁয়ের কথা, কীর্তিনাশা পদ্মার বুকে ইলশা মাছের নাওয়ের ভীষণ কাটালের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার কথা, ফাগুন-চৈত্র-বৈশাখে ধূসর ও হাহাকার ভরা সময়ে জলধিকুটিরে সময় ক্ষেপন করার কথা।
পড়তে পড়তে শুধুমাত্র মনে হয় এটা শুধু সাবলীল বর্ণনাই নয় আরো বেশী কিছু হয়তোবা কিছু ছাপছিত্রের অপূর্ব সমন্বয়। লেখক তার আশেপাশের সময়কে ব্র্যাকেটবন্দী করে আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছেন তার প্রিয় রাড়িখালে, জগদীসচন্দ্র বসুর রাড়িখালে, তার পানু আপার রাড়িখালে। “গ্রাম মরে যাচ্ছে। গ্রামেরা মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে রাড়িখাল। ছিলো একটি মিষ্টি মেয়ের মতো-খুব রূপসী-চাঁদের মতো।
কোন মড়কে ধরলো তাকে! তার চোখ বসে যাচ্ছে, কালচে দাগ চোখের চারপাশে। সে গোলগাল মুখটি নেই, কেমন শুকনো। এখনি ঢলে পড়ে যাবে যেনো। গ্রাম মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে রাড়িখাল। তার বুকের ভেতর কোন অসুখ বাঁধলো বাসা? খুঁটেখুঁটে কুরেকুরে খাচ্ছে তাকে কোন অসুখ? সে কি একেবারে মরে যাবে? ঢুকবে কবরে? তাকে ঘিরে রাতভর চিৎকার করবে কয়েকটা লালচে শেয়াল?”
আমাদেরকে গ্রামের অপূর্ব মাদকতাময় কিছু হাতছানির বর্ণনা দেয়ার পাশাপাশি শেষদিকে লেখক বইটিতে কিছু ঘৃণার বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন শকুন আর শেয়ালের প্রতি, কষ্টের প্রকাশ ঘটিয়েছেন প্রিয় বাবার প্রতি। কষ্টের আখ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো বইটি জুড়ে, ঝরেছে দীর্ঘশ্বাস। অসাধারন বইটিতে রাড়িখাল শুধু প্রিয় হুমায়ূন আজাদের গ্রাম এ পরিচয়ে আর আবদ্ধ থাকে না, অসাধারন বর্ণনার মাধ্যমে হয়ে ওঠে সর্বজনীন, হয়ে ওঠে সকল পাঠকের গ্রাম।
প্রিয় রফিকুন নবীর অসাধারন স্কেচ আর প্রিয় হুমায়ুন আজাদের অনন্ত ইচ্ছার সঙ্গে তাই সুর মিলিয়ে বলে উঠি: “আমি কত ডাক পারি। তুমি হুমইর দ্যাওনা ক্যান? তোমারে ভুলুম ক্যামনে? তুমি ভুইলা যাইতে পার, আর আমিতা পারুমনা কোনো কাল। আমি আছিলাম পোনর বচ্ছর ছয় মাস তোমার ভিৎরে। থাকুম পোনর শ বচ্ছর….রাড়িখাল। রাড়িখাল। তুমি ক্যান হুমইর দ্যাওনা ”