“ হেলু ” এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সংস্কৃতি
সত্যজিত রায়ের “ পরশ পাথর “ ছবির সব থেকে উল্লেখযোগ্য দুটো দৃশ্য আছে। এক. পরেশ চন্দ্র দত্ত ( যিনি সামান্য একজন ব্যাংক কেরনী থেকে পথে কুড়িয়ে পাওয়া একটা পরশ পাথরের জোরে মহা সম্পদশালী হয়ে যান ) যখন শহরের ধনীদের আমন্ত্রণ করে পার্টি ডাকেন এবং সেই পার্টিতে ধনীদের সঙ্গে কিছুতেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেন না।
দুই. শেষ দৃশ্য, যখন পরেশ চন্দ্র একটা ট্যাক্সি বা টানায় উঠে নিশ্চিন্ত চিত্তে সিগারেট ধরান। পরশ পাথর ছবির মূল মেসেজটা হলো, পরেশ চন্দ্র নামের লোকটা পরশ পাথরের গুনে বা জোরে, হঠাৎ ধনী হয়ে উঠলেও, টাকার ভারে ধনশালী হয়ে পড়েন ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই তার সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটাতে পারেননা। আর তাই সেই পার্টিতে পরেশ বাবু ধনীদের সঙ্গে একাত্মা হতে পারছিলেন না, কারণ, গরিব এই কেরানীটি কখনো এমন পার্টি দেয়া দূরে থাক, কখনো অংশগ্রহণ করারই সাহস করেননি। তাই শেষ দৃশ্যে, সেই পরশ পাথরের বিষয়টা পুলিশকে অবহিত করে এবং অন্যের হাতে তুলে দিয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। তাই সেই সিগারেটা ধরানো। ততদিনে তিনি বুঝে গেছেন, টাকা শুধু টাকাই তৈরি করতে পারে, তার আর কোনো ক্ষমতা নেই। যদিও বা থাকে, সেই ক্ষমতা বাস্তবায়নে দীর্ঘ এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১৯৭৩/৭৪ সালের কথা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এমন অনেক পরেশ চন্দ্র দত্ত এই দেশে হঠাৎ গজিয়ে উঠেছিলো। রাতারাতি তারা ধনী হয়ে উঠেছিলেন, পরশ পাথর নামক ক্ষমতার জোরে। সেসব ধনীদের মাঝে একজনকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিলো। তিনি, কোনো এক মন্ত্রীর ভাগ্নি ছিলেন। সেই মন্ত্রী এবং ভাগ্নির সম্মানার্থে ( সেই ভাগ্নি এখনও বেঁচে আছেন ) তাদের কারো নাম প্রকাশ করলাম না।
প্রায়ই সেই ভাগ্নির বাড়িতে আমার এবং আমাদের পরিবারের যাতায়াত ছিলো। যখনই যেতাম, তখনই লক্ষ্য করতাম, সেই ভাগ্নি ( আমরা তাকে খালাম্মা বলে ডাকতাম ) টি.এন.টি. ফোনে যখন কথা বলতেন, তখন এই “ হেলু “ শব্দটা ব্যবহার করতেন। ছোট বয়সের সেই অবুঝ কানেও, “ হেলু ” শব্দটা খুব কানে বাজতো। কারণ, ছোট হলেও, শব্দটা যে “ হেলু ” নয়, “ হ্যালো ” সেটা ঠিক ঠিক ধরতে পারতাম। তার সেই “ হেলু ” র মর্মার্থ সেদিন বুঝতে না পারলেও, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বোঝার ক্ষমতাটা বেড়েছে।
সেই সময়ে, সেই খালাম্মা তার মন্ত্রী মামুর জোরে, আঙ্গুল ফুলে গাছ হয়ে পড়লেও, “ হেলু ” শব্দটাকে বিতাড়িত করতে পারেননি। কারণ, এই শব্দের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিকাশের সম্পর্ক ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে আছে। তার পরিবারের যে সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিলো, তা ঐ “ হেলু ” স্তরেরই ছিলো, “ হ্যালো ” র পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। কিন্তু টাকার জোরে তিনি তখন অনেক উচ্চস্তরে অবস্থান করছেন ( মন্ত্রীর ভাগ্নি বলে কথা !! )।
টাকার জোর উপরে ওঠালেও, তার সংস্কৃতি তাকে উপরে ওঠাতে পারেনি। কারণ, সাংস্কৃতিক বিকাশ একদিনে হয়না। দীর্ঘ দিনের শিক্ষা, ভাষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দার্শনিক মূল্যবোধ, আচার, আচরণ, ব্যবহার, রুচি,পোশাক, খাদ্যাভাস, চলাফেরো, অপরের প্রতি সহানুভূতি, সমমর্মিতা ইত্যাদি আরো অনেক কিছু সংশ্লিষ্ট থাকে সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে। তাই ক্ষমতার জোরে একদিনে কোটি টাকার মালিক হওয়া যত সহজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠা তত সহজ কাজ নয়।
বর্তমানে সেই সময়ের চেয়েও আরো অধিক সংখ্যায় দুনীর্তি, ক্ষমতা, ঘুষ ইত্যাদির জোরে পরেশ চন্দ্র দত্ত হয়ে উঠছেন ঠিকই, কিন্তু সমাজ থেকে খুন, হত্যা, গুম, ধর্ষণ, অন্যায়, অবিচার ইত্যাদির মতো চরম অপসংস্কৃতিকে দূরীভূত করতে পারছেন না। যে অত্যাচিরত হচ্ছে তাকেই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যে ক্রসফায়ারে খুন হচ্ছে তাকেই দোষারোপ করা হচ্ছে। মেডিকেল কলেজের পুণঃপরীক্ষা গ্রহনের মতো ন্যায্য দাবী আজ রাষ্ট্রের চোখে অন্যায্য দাবী। কাজেই যারা ভাবছেন, টাকার জোরে সব করা যায়, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কারণ, টাকা দিয়ে আর যা-ই কেনা যাক, সংস্কৃতি কেনা যায়না। আর একবার যদি সংস্কৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবক্ষয় শুরু হয় তা কেবল অবক্ষয়ের দিকেই নিয়ে যায়।
আমরা আশা করবো, যারা এসব অন্যায় করে বেড়াচ্ছেন তাদের যেন পরেশ চন্দ্রের মতো উপলব্ধি বা বোধদয় ঘটে। কালো টাকা নয়, একমাত্র “ উপলব্ধি” ই পারে সবকিছুর সমাধান করে দিতে। এনে দিতে পারে সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশ।
ফ্লোরা সরকার
লেখিকা
ই মেইল[email protected]
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই