অদ্ভূত চীন,যান্ত্রিক হংকং

প্রকাশঃ আগস্ট ১১, ২০১৬ সময়ঃ ৫:৪১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৫:৪১ অপরাহ্ণ

ইমাম হাসান সৌরভ:

01

তখন অভিনয় করি বিটিভিতে। পাশাপাশি একটি জাতীয় দৈনিকে সাংবাদিকতা। মে উপস্থাপনাও শুরু সেই সময়। আর ছোট ছোট ইভেন্ট আয়োজন। ইভেন্টের সাথে কাজ করতে গিয়ে দেশের অনেক জেলা ঘুরেছি। বলছিলাম ২০০৬ সালের কথা।
এক সন্ধ্যায় এক প্রবাসী বন্ধুর মাধ্যমে চীনে একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রন পেলাম। নিশ্চিত হওয়ার পর বেশ পুলকিত। ছোট বেলা থেকেই বিদেশের প্রতি একটা আকর্ষন ছিল। আকর্ষনটা ব্যাপক। আমার মত এত বিদেশ পাগল কেউ আছে কিনা জানা নেই।
আমাদের মূল অনুষ্ঠান গুয়াংজুতে। যেতে হবে কুনমিং হয়ে। কানেকটিং ফ্লাইটে গুয়াংজু। ভিসা হওয়ার পর যাওয়ার একদিন আগে বাংলা মোটরের এক ট্রাভেল এজেন্সি থেকে টিকেট সংগ্রহ করলাম। ভিসাসহ পাসপোর্ট আর টিকেট পাওয়ার পর মনে বেশ আনন্দ অনুভব করলাম। প্রথমবার বিদেশ যাওয়ার আনন্দ।
সব কিছুই প্রথম। প্রথমবার বিমান বন্দরের ভিতরে যাওয়া। প্রথমবার প্লেনে ওঠা। আনন্দের মাত্রা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। বোর্ডিং কার্ড নেয়ার সময় উইন্ডো সিট চাইলাম। যেন কোন কিছু নজর না এড়ায়। বিমানে উঠার পর, আহারে কি উচ্ছাস। 03
মাত্র দুই ঘন্টায় বিমান কুনমিংয়ের আকাশে। চীনের দুর্বোধ্য ভাষায় কেবিন ক্রুর ঘোষণা। রাতের বেলায় ওপর থেকে নীচে তাকালাম। নানা রকম হাজারো বাতির আলোয় জ্বলজ্বল করছে কুনমিং শহর। অদ্ভ’ত এক অনুভূতি।
ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে যখন কুনমিং এয়ারপোর্টে হোটেল থেকে লোকজন এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমার লক্ষ্য অন্য দিকে। বিমান বন্দর থেকে বের হওয়ার পর আবহওয়া বেশ ঠান্ডা। কিন্তু মনের ভিতরটা বেশ উষ্ণ।
রাতের কুনমিং শহর। আহারে কি সুন্দর। দেশ থেকে একটা পুরনো কমদামী ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। এই ক্যামেরাতেই সবাই অনেক গুলো ছবি তুলে ফেললাম। রাতে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম ফুলের শহর কুনমিং। রেষ্টুরেন্টে দলে দলে ছোট ছোট চোখের চাইনিজ মানুষ খাচ্ছে। আমি আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছি তাদের। আমাদের আগ্রহ দেখে তারাও বেশ অবাক হচ্ছে।

সামনে এগিয়ে দেখি রাস্তার পার্শ্বে একটু ঝোপের মধ্যে দুইজন বসে আছে। আগ্রহ নিয়ে একটু খেয়াল করে দেখলাম তরুন-তরুনী। তীব্র শীতে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে জড়াজড়ি করে বসে আছে। ভালবাসাবাসি চলছে। আমরা সাথে আরেকজন ভাল করে দেখতে একটু দাঁড়ালাম। কিন্তু চাইনিজ ছেলেটা বেশ কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন বললো। কি বললো বুঝলাম না, বোঝার কথাও না। ভয় পেয়ে আমরা দুইজনই সামনের দিকে হাঁটা দিলাম। আর মনে মনে বললাম, রাস্তার পার্শ্বের রোমান্স দেখলে আমাদের মত অনেকেই তাকাবে। তোদেও এত লজ্জ লাগলে এই শীতে বাইরে না থেকে বাসায় যা। আমার মনের কথা ওরা শুনলেতো !

কুনমিংয়ে এক রাত কাটিয়ে পরদিন গুয়াংজুর উদ্দেশ্যে যাত্রা। বিমানে আমার পাশ্বে একজন জাপানি যাত্রী। দুই ঘন্টার যাত্রায় তার সাথে অনেক কথাবললাম। বেশ ভদ্র জাপানি লোকটি। গুয়াংজু এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ঠান্ডার কবলে পড়লাম। সাথে প্রবল বাতাস আর বৃষ্টি। আমাদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সির সাথে কথা বলতে গেলাম। কিন্তু বিস্তর ঝামেলা। একজন ড্রাইভারও ইংলিশ বুঝেনা। ইয়েস নো পর্যন্ত তাদের জ্ঞান ভান্ডারে নেই। মানিব্যাগে একটা চাইনিজ ভিজিটিং কার্ড ছিল। সেটি দেখিয়ে পৌছতে পেরেছিলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
গুয়াংজু অবশ্য কুনমিংয়ের মত এত সুন্দর না। কৃত্রিম শহর। বড় বড় দালান কোঠায় ছেয়ে আছে। গুয়াংজুতে ৪ দিন থেকে একটা জিনিস বুঝলাম। ওরা আল্লাহর দুনিয়ায় সব কিছুই খায়। শুধু আকাশের প্লেন আর মাটির চেয়ার টেবিল ছাড়া ! এইটা একটা কথার কথা। সাপ, ব্যাঙ, কুমির, কুইচ্চা, ফরিং থেকে শুরু করে, কি খায়না? রেষ্টুরেন্টগুলোর সামনে দিয়ে গেলে কি বিচ্ছিরি গন্ধ !
আমাদের অবশ্য খাবার নিয়ে ঝামেলা কম ছিল। এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর বাসায় আমাদের জন্য বিশেষ আয়োজন ছিল। সব কিছুই ফ্রেশ। অসাধারণ সুস্বাদু। ভাল লাগতো বেশী সালাদ। বেশ বড় সাইজের পেয়াজ আর টমেটো দিয়ে সালাদটা অত্যন্ত ভাল লাগতো। আর মাঝে মাঝে সামুদ্রিক মাছের ফ্রাই। বড়ই মজাদার ছিল তা।
সমস্যা বেশী হতো, চাইনিজদের সাথে কথা বলতে গেলে। আমরা চাইনিজ বুঝিনা। ওরা বাংলা বুঝেনা। কিন্তু ইংলিশও বোঝেনা। ওয়ান, টু পর্যন্ত বোঝেনা। কি যন্ত্রনা। দোকানে গেলে দামাদামি করতে গেলে ক্যালকুলেটরে টাকার অংক উঠিয়ে বোঝাতো। আর দামাদামি করতে গেলে পুরাই মাথা নষ্ট।
মাঝে একটা শুক্রবার পড়লো। জুমার নামাজ পড়তে যাব গ্রুপের সবাই। আমাদের গেস্ট হাউসের একটু দূরে একটা মসজিদে নিয়ে গেলেন স্থানীয় আয়োজকরা। গিয়ে দেখি সেখানে আমাদের প্রিয় নবীর সাহাবা সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসের কবর। অনেক মুসলমান এসে উনার কবর জিয়ারত করছেন। জুমার নামাজ পড়ার আগে আমরাও জিয়ারত করলাম। একটা পবিত্র অনূভূতি কাজ করলো। চীন সফরে এসে ভাগ্যবান মনে হল। অনেক মানুষের সাথে জুমার নামাজ পড়তে পারাটা ছিল দারুন ব্যাপার।
একদিন সবাই প্ল্যান করলাম চীন থেকে সেনজেং হয়ে হংকং যাবো। ট্রেনে গেলে সুবিধা। ট্রেনে ওঠার পর আমদের একজনকে খুঁজে পাচ্ছিনা। টেনশনে পড়ে গেলাম। এত মানুষের মধ্যে আবার হারিয়ে গেলে আরেক বিপদ। অনেক খোঁজার পর দেখা মিললো। গল্পে গল্পে আর শহর দেখতে দেখতে দ্রুত পৌছে গেলাম সেনজেং বর্ডারে। 38517_1347654219556_6233070_n
হংকংয়ে ঢুকতে গেলে আলাদা ভিসা নিতে হয়। পোর্ট এন্ট্রি ভিসা। ইমিগ্রেশন অফিসার কত কথা জিজ্ঞেস করে। পছন্দ হলে ভিসা দেয়, নাইলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আমাদের সবার ভিসা হয়েছে, একজন বাদে। ও ফিরে এসেছে গুয়াংজুতে। তাকে ছাড়াই বাধ্য হয়ে আমরা ছুটলাম হংকংয়ের উদ্দেশ্যে।
পাতাল রেলে প্রথমে পৌছালাম ওয়ার্ল্ড হারবার এলাকায়। সেখানে শীত আর বৃষ্টির ঝাপটায় সবাই কাবু। এরপরও নদীর পাড়ে অনেক্ষন ঘোরাঘুরি। হলিউড অভিনেতা ব্রুচ লির মূর্তির পাশে অনেকেই ছবি তুললো।
কেনাকাটা করতে গিয়ে আমি একটা ঝামেলায় পড়লাম। আমাকে বিটিভির এক প্রযোজক বাংলাদেশী বিশ হাজার টাকা দিয়েছিল উনার জন্য একটা ক্যামেরা আনতে। আমি হংকংয়ের চুমকিং ম্যানশনে একটা ক্যামেরার শো রুমে ঢুকলাম। একটা ক্যামেরা হাতে নেয়ার পর সেলসম্যান বললো, এইটা খুব ভাল নিতে পারেন। আমি দাম পরিশোধ করলাম। এর মধ্যে ঐ লোকটা আমাকে অন্য একটা ক্যামেরা দিয়ে বললো, এইটা নাও, এইটা আরো ভালো। আমি বললাম, না আমি ঐটা নিব, যেটা আমি দেখেছি। নাছোড়বান্দা ঐ লোকটা এবার আমার সাথে অযথা খারাপ আচরণ শুরু করলো। ওর সাথে আরো কয়েকজন জড়ো হয়ে গেল। সবাই ওর হয়ে কথা বলছে। বাধ্য হয়ে আমি ওই ক্যামেরাটাই নিলাম। দেশে এসে বিটিভির প্রযোজককে ক্যামেরটা দেয়ার পর উনি পছন্দ করেন নাই। পরে কার কাছে যেন অল্প দামে বিক্রী করে দিয়েছেন।
বিকেলেই গুয়াংজুর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। এবার আর ট্রেন নয় বাসে। বাসের পিছনের দিকে বসেছিলাম। আমার পিছনের দিক থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু রোমা কর। মাথা ঘুরিয়ে দেখি দুইজন যুবক যুবতী। বুঝতে পেরে মাথা ঘুরিয়ে লজ্জায় সামনে তাকালাম। অবাধ্য মন আবার পেছনে তাকাতে চাইলো। পেছনে আর তাকাতে পারিনি। আচ্ছা এই ব্যাপারে আমার কি দোষ। আমার মত অন্য যে কারো এই দৃশ্য পুনরায় দেখতে চাইতো।
পরের দিন দেশের উদ্দেশ্যে রওয়না দিলাম কুনমিং হয়েই। এবার কুনমিংয়ে হোটেলে নয়। উঠেছি এক গেস্ট হাউসে। বাংলাদেশী গেস্ট হাউস। তিন বেলায় আমাদের ভাত মাছ খাওয়ালেন। অপূর্ব রান্না। সবই ফ্রেশ। তারা খাদ্যে ফরমালিনের কথা চিন্তাই করতে পারেনা। কুনমিংয়ে এক রাত থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা। চীনে পরে আবারো গিয়েছিলাম। তবে, প্রথমবার ভ্রমনের স্মৃতিটা এখনো বেশ ভালভাবেই মনে আছে।

লেখক : গণমাধ্যম কর্মী।

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G