অনলাইন সংবাদ মাধ্যম : এক ভবিষ্যমুখী যাত্রা

প্রকাশঃ জানুয়ারি ১৩, ২০১৯ সময়ঃ ২:৫২ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৮:১৫ অপরাহ্ণ

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় একবিংশ শতকে এসে সাংবাদিকতার প্রচলিত ধ্যানধারণা এবং কৌশল বদলে যাচ্ছে নাটকীয়ভাবে।

কাগজ-কলম, নোটবুক, প্যাড আর প্রচলিত ক্যামেরার জায়গা দখলে নিচ্ছে মোবাইল, আইপ্যাড, ডিএসএলআর, ল্যাপটপ কম্পিউটার। এছাড়া ড্রোন, ব্যাকপ্যাক ছাড়াও মাল্টিমিডিয়া নির্ভর নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রকৌশল এই পেশাকে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতা আর সীমাহীন গতিময়তা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, প্রযুক্তিগত এই কৌশলের সর্বোচ্চ ব্যবহারে দৈনিক সংবাদপত্র এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো শক্তিশালী মাধ্যমকে ছাড়িয়ে গেছে অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। মুহূর্তের সংবাদ মুহূর্তেই দর্শকের কাছে পৌঁছে যাবার কারণে অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন কেবলই অনলাইন। তাৎক্ষণিক সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে সংবাদ প্রকাশ পর্যন্ত এই গতিময় বাস্তবতা ছাপানো সংবাদপত্রকে অবশ্য আরো আগেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে; সেকারণে বিশ্বজুড়ে মুদ্রণ সাংবাদপত্র তাদের কৌশল পাল্টে অনলাইনে ভার্সনে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। ইতমধ্যে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী বড় বড় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোও মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির দারস্থ হয়ে দর্শক চাহিদার সাথে তাল মেলাতে অনলাইন ভার্সনে টিকে থাকার লড়াইয়ে বেশ ভালোভাবেই শামিল হয়েছে। শুধু সকালে যে তারা ছাপা পত্রিকা নিয়ে হাজির হচ্ছে এমন নয়। যখনই কোনো ঘটনা ঘটছে তখনই তারা নিজস্ব ওয়েব পোর্টালে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অডিও, ভিডিও দিচ্ছে; এমনকি সরাসরি সম্প্রচারও করছে; করতে বাধ্য হচ্ছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ২৪ ঘন্টার মাল্টিমিডিয়া নিউজরুম থেকে সম্প্রচার শুরু করেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের এই যাত্রার নাম দিয়েছে ‘ভবিষ্যমুখী যাত্রা’। নতুন এই নিউজরুমকে তারা দ্বাবিংশ শতকের নিউজরুম বলে অভিহিত করেছে। যেখানে একেকজন সাংবাদিক হবেন সাংবাদিক কাম প্রযুক্তিবিদ। ভিডিও এবং অডিও স্টুডিও আর অসংখ্য ডিজিটাল মনিটরসহ ওয়াশিংটন পোস্টের নতুন নিউজরুমে ঢুকলে যেকারো সন্দেহ হতে পারে যে তিনি কী টেলিভিশনের বার্তাকক্ষে ঢুকেছেন নাকি সংবাদপত্রের বার্তাকক্ষে!! রিপোর্টারদের মতো সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গা দখল করে আছেন ভিডিও এডিটর, ফটোগ্রাফার, ডিজাইনার আর সোশ্যাল মিডিয়া এডিটর। বলা যায় সেখানকার সাংবাদিকরা একেকজন প্রযুক্তিবিদ। তারা একইসাথে প্রিন্ট, অনলাইন এবং ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সংবাদ প্রকাশের স্বার্থে প্রযুক্তিগত সব কিছুর দক্ষতা অর্জন করছেন। তাদের বার্তাকক্ষে এখন ডিজিটাল অপারেশনে পারদর্শী সাংবাদিকদেরই জয়জয়াকার।

আরেক প্রভাবশালী পত্রিকা দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমসও সেদিকেই এগুচ্ছে।ডিজিটাল জার্নালিজমের উপযোগি করে তারা নিজেদের ঢেলে সাজাচ্ছে। একই সাথে অনেক কাজে পারদর্শী হিসেবে তারা তাদের সাংবাদিক এবং এডিটরদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।২০২০ সালকে টার্গেট করে তারা ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ’ অথার্ৎ সব কাজের কাজী হিসেবে এই পত্রিকার সাংবাদিকদের তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

একদিকে পত্রিকাগুলো যেমন মাল্টিমিডিয়া হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে টেলিভিশন নিজেও পত্রিকার মতো উপস্থিত হচ্ছে। টেক্সেটের সাথে অডিও, ভিডিও আর গ্রাফিক্স জুড়ে মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব অনলাইন ভার্সনে জানান দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হচ্ছে না; একইসাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়ে এন্ড্রয়েড সেটের দর্শকদের টানতেও সচেষ্ট হচ্ছে।

রেডিও এবং টেলিভিশনের জন্য বিখ্যাত বিবিসিরও এখন প্রথম অগ্রাধিকার অনলাইন ডিজিটাল কনটেন্ট। বিবিসির নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে যে ৩৯ টি ল্যাঙ্গুয়েজ সার্ভিস আছে সেখানেও মূল ফোকাস এর জায়গা হচ্ছে অনলাইন।

দৈনিক পত্রিকা আর স্যাটেলাইট টেলিভিশন যেখানে নিজেদের রুপান্তর ঘটিয়ে অনলাইন স্রোতে ঝাঁপ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে; সেখানে সেই স্রোতেই জন্ম নেয়া নিউজপোর্টাল স্রোতের অগ্রভাবে থেকেই নেতৃত্ব দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এই বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণ করে গণমাধ্যম গবেষকরা ইতমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ২০১৯ সালে অনলাইন সংবাদমাধ্যম স্যাটেলাইট টেলিভিশনসহ সব মাধ্যমকে পেছনে ফেলে দিয়ে শীর্ষস্থানে চলে যাবে। মূলত প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত এসব পরিবর্তনের কারণেই সাংবাদিকতা পেশার গতানুগতিক ধ্যানধারণা ও চর্চার ধরণ বদলে গিয়ে এই পেশার এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটবে।

একটা সময় ছিলো যখন সাংবাদিকতা ছিলো বর্ন জার্নালিস্টদের নিয়ন্ত্রণে। জন্মগত প্রতিভা নিয়ে তখন একেকজন সাংবাদিক মহীরুহ হিসেবে সাংবাদিকতার জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সাংবাদিকতার ইতিহাসে তারা একেকজন নক্ষত্রের মর্যাদা পেয়েছেন কিংবা পথিকৃৎ হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছিলেন। বলা যায়, সাংবাদিকতা ছিলো বর্ন জানালিস্টদের নিয়ন্ত্রণে।কিন্তু সেসময়ের সাথে বর্তমান সময়ের যোজন যোজন দুরত্ব। সেকারণে বর্ন জানালিস্টদের স্থান এখন দখল করছে ‘মেড জার্নালিস্টরা’। এ যুগে সাংবাদিক হতে গেলে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই তেমনি তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক এবং প্রাযুক্তিক এ তিনটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন ও সমন্বয় সাধন ব্যতীত কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোও অসম্ভব। সঙ্গত কারণেই বলতে হয়- সাংবাদিকতা এখন আর সহজাত নয়, বরং অর্জিত। আর এই অর্জনে প্রযুক্তিই হবে অন্যতম চালিকাশক্তি।

 

রাকিব হাসান
সম্পাদক, প্রতিক্ষণ ডট কম
[email protected]

 

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G