অবিরাম ছুটে চলেছেন রমা চৌধুরী

প্রকাশঃ মে ১৭, ২০১৫ সময়ঃ ৯:৫৭ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ২:০৩ অপরাহ্ণ

ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডট কম:

ramachowdhary-কোনো এক বিবর্ণ বিক্ষিপ্ত দুপুরে, অবিরাম হেঁটে চলেছেন পায়ের তলায় তপ্ত মাটিকে উপেক্ষা করে। কাঁধে ঝুলানো চটের ব্যাগ, মাথার ওপর চড়া সূর্যের হাতছানী। তবুও বইয়ের বোঝা কাঁধে নিয়ে চলেছেন অবিরত। তিনি রমা চৌধুরী, একাত্তরের বীরাঙ্গনা, মুক্তিযুদ্ধের ঝাপটায় ঘরবাড়ি, নিজের সৃষ্টি সর্বোপরি দু’সন্তান হারানো বিপর্যস্ত জীবনসংগ্রামী।

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মা, বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, রমা চৌধুরী তাদেরই একজন। শুধু সম্ভ্রমই হারাননি তিনি, এরপর থেকে সামাজিক গঞ্জণা সয়ে আর কখনোই মাথা তুলেও দাঁড়াতে পারেননি। সেদিন যারা শহীদ হয়েছিল, তাদের তালিকায় হয়ত তার দু’সন্তানের নাম যুক্ত হয়নি। কিন্তু রমা চৌধুরীর কাছে তারা মুক্তিযুদ্ধের বলি।

১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে মাস্টার্স করা রমা চৌধুরী পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতাকে। বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়ায়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশু সন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন রমা চৌধুরী, স্বামী ছিলেন ভারতে। ঐদিন এলাকার পাকিস্তানি দালালদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে হানা দেয়। নিজের মা আর পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তাকে ধর্ষণ করে এক পাকিস্তানি সৈনিক।

হানাদারদের হাত থেকে কোনমতে মুক্ত হয়ে রমা চৌধুরী পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন ভয়ে। তার বর্ণনায়, চারদিক থেকে দলে দলে হানাদাররা দেশীয় দালালদের সহযেগিতায় প্রবেশ করতে লাগল তাদের বাড়িতে। হানাদাররা গান পাউডার দিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। চোখের সামনে ঘরের ভেতর রাখা মূল্যবান মালামাল, নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম পুড়ে যেতে থাকল। কিন্তু হানাদার বাহিনীর ভয়ে কেউ আগুন নেভাতে এগিয়ে এলনা। এক পর্যায়ে রমা চৌধুরী নিজেই ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে আসেন। চেষ্টা করেন, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ছিঁটেফোটা রক্ষা করার, কিন্তু ব্যর্থ হন।

ramachowdhary-1পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পর কেউ কেউ হয়ত সহযোগিতার হাত নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু নিকটজনসহ সমাজের লোকদের কাছে শুরু হয়েছিল তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্চিত হবার পালা।

হানাদারদের কাছে নির্যাতিত হয়ে সমাজের লাঞ্চনায় এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন রমা চৌধুরী। পোড়া দরজা-জানালাবিহীন ঘরে শীতের রাতে থাকতে হচ্ছে মাটিতে। গরম বিছানাপত্রও সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দিনের শেষে ভাত জুটছেনা। অনাহারে, অর্ধহারে ঠান্ডায় দু`সন্তান সাগর আর টগরের অসুখ বেঁধে গেল।

বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সাগরের। ছেলেকে সুস্থ করতে পাগলপ্রায় অবস্থা রমা চৌধুরীর। গ্রাম্য চিকিৎসক দু`একজন অবশেষে আসলেন। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা গেল সাগর। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর।

মুক্তিযুদ্ধে নিজের সতীত্ব, দু`সন্তান হারানো, সমাজের লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অভাব, জীবন সংগ্রাম- সব মিলিয়ে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি রমা চৌধুরী। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।

স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখাকেই নিজের পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তার জীবনজীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। সেই পেশা এখনো বর্তমান। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে বর্তমানে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পড়েননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পড়া শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর গত ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী।

প্রতিক্ষণ/ এডি/ পাভেল

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G