অমর-অক্ষয়-অম্লান হোক শহীদ বুদ্ধিজীবীগণ
শারমিন আকতার
যেই না আঁকা শেষ
অবাক চোখে দেখি এ যে
আমার বাংলাদেশ’।
সময়টা ছিল অসীম আনন্দের। এভাবে কবিতায়, গানে আর আড্ডায় মেতে উঠেছে লক্ষ-কোটি জনতা।কখন বাড়ি ফিরবে সে ভাবনায় মশগুল সবাই।কারো মুখ থেকে যেন হাসি আর থামছেই না।লাগামহীন অপরিসীম বাধভাঙা উচ্ছাস সবার মনে। কেউ বিরক্ত হয়ে বলছে না, এত আনন্দ কিসের? কোথারে সে তীর, কোথা আশ্রয় শাখা? এ যে অজাগর গরজে সাগর ফুলিছে। আমাদের বিজয় যে হাতের মুঠোয় এসে গেছে। অনেক রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের লাল-সবুজের বিজীত পতাকাটি আজ আমরা ইচ্ছেমতো এদিক-সেদিক উড়াতে পারবো। এ এমন এক পরম আনন্দানুভূতি যা ভাষায় প্রকাশের চেয়ে অনুভূতি দিয়ে বুঝে নেয়া সহজ।সবাই আনন্দ উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত।
তখন, ‘কবিতায় আর কী লিখব
যখন বুকের রক্তে লিখেছি একটি নাম বাংলাদেশ’।
সবকিছু সেভাবেই চলছিল যেভাবে আমরা চেয়েছিলাম। কিন্তু এক কাক ডাকা ভোরে শুনতে পেলাম,
‘আকাশ থেকে চিলের ঝাঁক
শকুন পাহাড় থেকে
সবুজ এদেশ রেখেছিল
লাল চাদরে ঢেকে’।
সেসময় হঠাৎ বাংলার আকাশ থেকে এক একটি তাঁরা উত্তপ্ত মাটিতে উদভ্রান্তের মতো হুড়মুড় করে একে একে খসে পড়তে শুরু করল।এদিকে পুবাকাশে যে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের সূর্যটা মাথার উপর উঠেছিল; কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দিগ্বিদিক গম্ভীর রক্তিম আভা ছড়াতে লাগল। সবার মনের ভেতর সত্যি হতে চলা নীল আকাশটা গভীর আতঙ্কে কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল।চারদিক হৈহৈ রব, কী হল কী হল? অবশেষে সবার সামনে তপ্ত রোদে ক্ষিপ্তবেগে আকাশ থেকে এল এক মস্ত বড় শকুন। সাথে ছিল বেনামী উড়ো চিঠি।এক বিকট হুঙ্কার দিয়ে সমস্ত পাড়া মাতিয়ে মাটিতে আঁচড়ে পড়ল এই মাংসখেকোর পদচিহ্ন।মুহূর্তেই সমস্ত পাড়া এক উদ্ভট গুমট নিরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে?
শোন শোন সমগ্র বাঙ্গালবাসী, ‘আজ তোমাদের গর্বের ধন সবেধন নীলমণি সূর্য সন্তানদের আমরা তিলতিল করে কষ্ট দিয়ে অবশেষে মেরেছি। তাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত অনৈতিক পরাজয়ের একটা সমুচিত জবাব দিলাম তোমাদের। আজ আমরা সফল। আর তোমরা কোন অতল সমুদ্রে ডুবতে যাচ্ছ তা কিছু সময় পরে জানতে পারবে। তবে ততক্ষণে কূলে আসার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। এদেশ আর কখনও গর্ব করার সুযোগ পাবে না। মাথা উঁচু করে আর দাঁড়াতে পারবে না এই বঙ্গবাসী। সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ইতোমধ্যে করে ফেলেছি। অদূর ভবিষ্যতে এদেশ হবে জ্ঞানশূন্য-মেধাহীনদের আখড়া।সেই দিন দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
১৪ই ডিসেম্বর বাংলার বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক সেলিনা হায়াত, লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেক অনেক মেধাবী সন্তান। বিজয় যখন দড়জায় কড়া নাড়ছিল তখন এই হিংস্র হায়েনার দল আমাদের সূয সন্তানদের রক্ত দিয়ে হলি খেলায় মেতে উঠেছিল। তারা আমাদের জ্ঞানের মশাল নিভিয়ে দিয়ে রক্তের আনন্দযজ্ঞে ব্যস্ত ছিল।
যুদ্ধের ৪৪ বছরে পৌঁছেও আমরা সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আজও ভুলতে পারিনি। বাংলাদেশের মানচিত্র যতদিন থাকবে ততদিন; হয়ত তারও অধিক দিন অমর অক্ষয় আর অম্লান হয়ে থাকবে এই শহীদ জ্ঞানীগুণীজন। এই নক্ষত্ররা রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আর দিনের বেলায় সূর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আর আমাদের মনের আয়নায় প্রতিদিন চুপিচুপি ধরা দেয়:
‘সবকটা জানালা খুলে দাওনা
আমি গাইব গাইব বিজয়েরই গান
ওরা আসবে চুপি চুপি যারা এই দেশটাকে
ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’।।