আইন কখন নাগাল পায়

প্রকাশঃ অক্টোবর ২১, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:১৩ অপরাহ্ণ

শাহাদত হোসেন বাচ্চু

litonঅবশেষে আইন তার নাগাল পেল। তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্ট পার হয়ে। গত বুধবার ১৪ অক্টোবর পর্যস্ত পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই শিশু হত্যা প্রচেষ্টা মামলার আসামীকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়ার বদলে আদালতে আত্মসমর্পনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদের একজন ‘মাননীয় আইন প্রণেতা’ মনজুরুল ইসলাম লিটন হাইকোর্ট-সুপ্রীম কোর্ট কোথাও জামিন না পাওয়ায় সম্ভবত সরকারের সবুজ সংকেতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

গাইবান্ধার আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করার পাশাপাশি রিমান্ডের আবেদনও নাকচ করেছে। যে দেশে নিম্ন আদালতগুলি যে কোন মামলায় পুলিশ চাইলেই আসামীদের রিমান্ডে দিয়ে দেয়, সেখানে এরকম একটি স্পর্শকাতর মামলায় রিমান্ড আবেদন নাকচ করেছে, এটি এখন বাস্তবতা। নিম্ন আদালতগুলিতে সরকারী নিয়ন্ত্রন ও প্রভাব নিয়ে রয়েছে বিস্তর আলোচনা। কিন্তু একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি যখন এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন তখন আলোচনাগুলি একটি আকার লাভ করে। এমপি লিটনের গ্রেফতার ও জেলে যাওয়ার পরে গুলিবিদ্ধ শিশু সৌরভের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পাশাপাশি পরিবারটি স্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার আশংকায় পতিত হল।

কিন্তু আইন টাঙ্গাইলের এমপি আমানুর রহমানসহ আরো অনেকের নাগাল এখনও পায়নি, বলা যেতে পারে পেতে চায়নি। আমানুর একটি হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে হত্যার ২০ মাস পরে দেয়া চার্জশিটে এমপি আমানুর আসামী। হলে কি হবে, পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। এই খুনের ঘটনায় এমপির তিন ভাই, পৌর মেয়র, চেম্বার সভাপতি ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি জড়িত বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে মামলায় গ্রেফতারকৃত দুই আসামী।

গেল বছরগুলিতে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এক বা একাধিক খুনের অভিযোগ থাকলেও আইন-বিচার তাদের কব্জা করতে সক্ষম নয়। ফলে নারায়নগঞ্জের মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যার সমস্ত তথ্য-প্রমান এবং চার্জশিট তৈরী থাকলেও র‌্যাব আদালতে দাখিল করছে না, অথবা করতে পারছে না। কথিত রয়েছে, ত্বকী হত্যাকাণ্ডকে আড়াল রাখতে ও অপরাধ সাম্রাজ্যের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ানো নজরুল এবং নুর হোসেনকে নিকেশ করতে নারায়নগঞ্জে পরিকল্পিত সাত খুনের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ওই খুনের আপাত: একটি কিনারা হলেও নেপথ্যের ব্যক্তিটির নাগাল আইন পায়নি, নাকি পেতে দেয়া হয়নি- প্রশ্ন থেকেই যাবে।

দলীয় প্রতিপত্তি ও অর্থের মাধ্যমে র‌্যাবকে ব্যবহার করে এই হত্যাকান্ডের বাস্তবায়ন ঘটে। মামলা তদন্তে র‌্যাব অধিনায়কসহ ১৮-২০ জন অভিযুক্ত হলেও মূল পরিকল্পনাকারী নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল নির্বিঘ্নে। অচিরেই তাকে দেশে ফেরত আনা হতে পারে। খুন হয়ে যাওয়া কাউন্সিলর নজরুল, আইনজীবি চন্দন সরকার ও এই হত্যা মামলার প্রধান আসামী অপর কাউন্সিলর নুর হোসেন- এরা সকলেই ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠজন।

ভারতে পলায়নের পূর্বে নুর হোসেনের সাথে শামীম ওসমানের টেলিফোন আলাপের একটি অডিও সে সময়ে মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। হত্যার অন্যতম আসামী র‌্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদ মন্ত্রী মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরীরর জামাই। অভিযোগ ছিল, মন্ত্রীপুত্র ঘটনায় জড়িত। কিন্তু হত্যার পুলিশি বা প্রশাসনিক কোন তদন্তেই এসব ক্লুকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে মনে হতে পারে, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ধামাচাপা দেবার কাজটি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করা হয়। বিচারহীনতার কারনে অপরাধের ধারাবাহিকতার একটি উদাহরন দেয়া যাক। ২০০১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিএনপির মিছিলে আওয়ামী লীগের এমপির নেতৃত্বাধীন মিছিল থেকে গুলিবর্ষণের ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন পুলিশ কনেষ্টেবলসহ চারজন। সাংবাদিকরা দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ধারন করেছিলেন এবং তা পরেরদিন জাতীয় দৈনিকগুলিতে প্রকাশিত হয়েছিল। এ ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলার অন্যতম আসামী ছিলেন তৎকালীন এমপি ডা. এইচ বি ইকবাল ও বর্তমান এমপি সে সময়ের ছাত্রনেতা নুরন্নবী চৌধুরী শাওন। দশকের ব্যবধানে এমপি শাওন ২০১০ সালে তার গাড়িতে দলীয় কর্মী ইব্রাহীম হত্যা মামলায় ছিলেন এজাহারভুক্ত আসামী। পরে দাখিলকৃত চার্জশিটে এমপি শাওনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে।

২০১৪ সালের ২১ মে নোয়াখালীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা একরামকে খুন করা হয় গুলি করে, কুপিয়ে ও পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে। স্থানীয় এমপির নির্দেশে এই হত্যা সংগঠিত হয়েছিল বলে অভিযোগ থাকলেও এজাহারে বা তদন্তে কোথাও তার নাম আসেনি। আলোচিত বিষয় হচ্ছে, যদি কখনও ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয় তাহলে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে ঐ এমপি আসামী হতে পারেন এবং মামলার প্রধান আসামী বিএনপি নেতা হয়তো অব্যাহতি পেয়ে যাবেন। এভাবেই নারকীয় সব হত্যাকান্ডের বিচার চলে যায় অনিশ্চিত গন্তব্যে।

২০১৪ সালের ১৪ জুন মীরপুরের বিহারী ক্যাম্পে ১০ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বিহারীদের উচ্ছেদ করে জায়গার দখল নেয়াই ছিল এই হত্যাকান্ডের মূল উদ্দেশ্য। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় এমপির নির্দেশে দলীয় ক্যাডাররা পুলিশের সামনে পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আসলাম মীরপুরে বাস চাপায় নিহত হয়। অভিযোগ রয়েছে, এটি ছিল একটি পরিকল্পিত খুন। এ মামলাটির তদন্ত-বিচারও চলে গেছে অনিশ্চিত গন্তব্যে।

২০০৯ সালের ১১ জুলাই খুলনায় খুন হন যুবলীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহীদ ইকবাল বিথার। নিহত বিথারের স্ত্রী রুনু রেজা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাত পেতে সক্ষম হন এবং তার দাবি অনুযায়ী খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও বর্তমান এমপি মিজানুর রহমান মিজান এই খুনের সাথে সম্পৃক্ত। ৪ বছর দীর্ঘ পুলিশী তদন্ত শেষে মিজানুর রহমানকে চার্জশিটভুক্ত আসামী করা হয়। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে মিজানুর রহমান দলীয় মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। স্বাভাবিকভাবেই মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধীর গতি আসে এবং পুণ:তদন্তের পরে চার্জশিট থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়। এমপি মিজান দাবি করেন, তাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং এখন প্রকৃত সত্য প্রকাশিত হয়েছে।

২০১১ সালে নরসিংদী পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন তার কার্যালয়ে গুলিতে নিহত হন। সে সময়ে মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদের ছোট ভাইকে এই মামলার প্রধান আসামী করা হয় এবং অভিযোগ ওঠে মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও। আটমাস তদন্তের পরে পুলিশের দাখিলতৃত চার্জশিটে এজাহারভুক্ত মন্ত্রীর ছোট ভাইসহ ১১ জনকে বাদ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রীর প্রভাব উপেক্ষা করতে না পেরে পুলিশ এরকম কাণ্ড ঘটিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর একটি সাম্প্রতিক বক্তব্য এই নিবন্ধের জন্য খুবই প্রাণিধানযোগ্য। তিনি চাঁচা-ছোলা কথা বলেন দ্বিধাহীনভাবে, এমনকি তা যদি স্ব-বিরোধীও হয়। নিরাপত্তার অজুহাতে ক্রিকেট অষ্ট্রেলিয়া যখন বাংলাদেশ সফর বাতিল করলো তখন বিদেশেই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন,‘তারা না আসলে না আসবে। অষ্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় নানারকম হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেখানেও বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় বিদেশী নাগরিক হত্যা হয়েছে। তাই বলে কি সেখানে সবাই যাওয়া বন্ধ করেছে’? একেবারেই সত্য ও বাস্তব উচ্চারন এবং প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু এর সাথে অনেকগুলি অনুক্ত কথা আছে। যেগুলি প্রধানমন্ত্রী জানেন, কিন্তু বলেন না। অষ্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় খুন বা অপহরণের ঘটনা ঘটলে ন্যায্য-নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারিক ব্যবস্থা নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠে না। বিচারের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা আছে। সেখানে স্পর্শকাতর খুন-গুম-অপহরণের মামলাগুলি হিমাগারে পাঠানোর কোন ব্যবস্থা বা চর্চা নেই। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক তদন্তের আগেই রাষ্ট্রের নির্বাহীরা কাউকে প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করতে পারেন না বলেই জানা আছে। আইনের শাসনের বিষয়ে সে সব দেশের মানুষ এবং বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রশ্ন বা আশংকা থাকে না।

রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হচ্ছে, ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির সুবিধা দিয়ে সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের কোন নৈতিকতার সাথে যায় না। রাষ্ট্রের কাজ সামষ্টিক কল্যাণের লক্ষ্যকে সমুন্নত রাখা। রাষ্ট্র যদি সংবিধান ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে না চলে, কারো প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব ও বিশেষ সুবিধা দিলে অন্যায্যতা সৃষ্টি হয়। এটি একসময় পুরো রাষ্ট-ব্যবস্থাকেই ভঙ্গুর ও বিপর্যস্ত করে তোলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, অষ্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় একেবারেই বলতে গেলে নজিরবিহীন দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া রাষ্ট্র কখনই কারো প্রতি পক্ষপাত দেখায় না বা বিশেষ সুবিধা দেয় না। দিলে সে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দায় নিজ স্কন্ধে নিয়ে চলে যেতে হয়।

মুশকিল হচ্ছে, এত কথা বলতে গিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অতুলনীয় নির্বাচনের কথা চলে আসছে। এই নির্বাচনের নেপথ্যের কাহিনী বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)। নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সিভিল আমলাতন্ত্র ব্যবহার করে কিভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা মোটামুটি খোলসা করে দিয়েছিলেন তিনি, ছাত্রলীগের এক আলোচনা সভায়। এরকম একটি নির্বাচন দিনে দিনে জনগণের জন্য হয়ে উঠছে বিপদজ্জনক। জনগণের জন্য যেমন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে যেসব সৎ-নিরপেক্ষ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ কর্মচারী রয়েছেন-তাদের জন্য। প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত অনেক সংসদ সদস্য ও রাষ্ট্রের কিছু আমলা-কর্মচারী এখন এতটাই বেপরোয়া যে, আইন-বিচার কোন অবস্থায় তাদের নাগাল পাচ্ছে না, অন্য কথায় পেতে দেয়া হচ্ছে না।

জনগণের সাথে দাঁড়িয়ে এই অন্যায্যতা-অন্যায় প্রতিহত করার জন্য দেশে কোন রাজনৈতিক শক্তি অবশিষ্ট নেই ও রাখা হয়নি। জনগণের জন্য নয়, ব্যক্তি স্বার্থে এবং ক্ষমতা কব্জা করতে সরকারের বিরুদ্ধে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছে। যা দল হিসেবে তাদের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে অতল খাদের কিনারে নিয়ে যেতে ক্ষমতাসীনদের তারা একরকম সহায়তাই করেছে। ফলে বিবাদমান ও নিশ্চিহ্নকরণের রাজনীতি রাষ্ট্র-সরকার-সমাজে এখন এক নীতিহীন, শক্তিনির্ভর ও দায়মুক্তিপ্রবণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। এর অনিবার্যতায় গণতন্ত্র-সুশাসনের সম্ভাবনা চলে গেছে জনভাবনার আড়ালে।

সূত্রঃ আমাদের বুধবার

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G