আফরোজা সোমার ধারাবাহিক গদ্য

প্রকাশঃ মার্চ ১৫, ২০১৬ সময়ঃ ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ

golpo
 

এইরকম বিকেলগুলো গাঢ় হয়ে যখন ছড়িয়ে পড়ে টবের মরিচ গাছে, বারান্দায় শুকোতে দেয়া ভেজা গামছায়, প্রতিবেশী বাড়ির কাঁচের জানালায় পশ্চিমের সূর্যের প্রতিবিম্ব উজ্জলতর আলো হয়ে যখন খুনির মতন ঢুকে পড়ে ঘরে তখন গুমরে-গুমরে উঠে তার বুকের ভেতর।

বিকেলগুলো যখন ফাল্গুনে আমের মুকুলের সুবাস নিয়ে, চৈত্রে ইটের দেয়াল তাঁতানো গন্ধ নিয়ে জীবানুর মতন ঢুকে গেছে নিঃশ্বাসে, মাঘে কুয়াশার ঘ্রাণ নিয়ে শেষ বিকেলেরা যখন মিশে গেছে চায়ের কাপে তখন বহুদিন ডুকরে উঠতে ইচ্ছে হয়েছে; কোনো দুঃখ ও সন্তাপ ছাড়াই, অকরাণেই, মাঝে মাঝে মনে হয়েছে গলায় দড়ি দেবার এই বুঝি ব্রাহ্ম মুহূর্ত।

 একদিন গলায় দড়ি দেয়ার ঝোঁক নিয়ে সে ঘর ছেড়ে বেরোয়— অকারণে; বেরোয় হাওয়ার চক্রান্তে আর বিকেলের কণে-দেখা-আলোর নেশায়। বেরিয়ে সে ধানমণ্ডি লেকে যায়। এরপর থেকে নিয়মিতই, সে একা একা ধানমন্ডি লেকে হাঁটে। নিয়মিত হাঁটার উছিলায় বাড়িতে সে নিজের জন্য রুটিনে লিখে রাখে ‘ইভিনিং ওয়াক’।

 কিন্তু সে আসলে ইভিনিং ওয়াকে যায় না। যায় ইভনিং কল্-এ। এক বিকেল তার জানালায় ডাক দিয়ে যায়; বারান্দার মরিচ গাছের সাদা ফুলে চিঠি লিখে এক বিকেল বলে যায়: এসো। ধানমণ্ডি লেকের ওয়াটার প্ল্যাটফর্মে আমি থাকবো দাঁড়িয়ে।

 এই চিঠি তাকে উতলা করে। সংসার ছেড়ে বিকেলের ইশারায় সে ‘ইভিনিং ওয়াক-এ যায়। মাঝে মাঝে পানির উপর ছড়ানো স্টিলের পাটাতনে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে, দীর্ঘক্ষণ। কখনো কখনো সন্ধ্যা যখন সবে ঘন হয়ে আসতে শুরু করে, তখনো আকাশে নেই তারার আভাস, এমন সময় সে চোখ বন্ধ করে। তারপর যেনো একযুগ কেটে যাবার পর যখন সে চোখ খোলে তখন আকাশে তারার ঝাঁক; তখন সপ্তর্ষিমণ্ডলের ঋষিরা মাটির পৃথিবীতে তাকিয়ে দেখে, ক্ষেত ভরে পেকে লাল হয়ে থাকা মরিচের গন্ধমাখানো হাওয়ার ভেতর দিয়ে দশ কি এগারো বছর বয়সী এক কিশোরী গ্রামের আলপথে কেমন দৌড়ুছে ভীষণ; হাওয়ায় উড়ছে তার ফ্রকের সোনালি কুঁচি।

 এভাবেই ধানমণ্ডি লেকে হাঁটতে গিয়ে আরেকটা পাগলের সঙ্গে তার দেখা। সে-ও এক কোণায় একা একা দাঁড়িয়ে থাকে; তারার নিচে; অন্ধকারে। তার হাতে থাকে বাদামী রঙের একটা চামড়ার ব্যাগ। মাঝে মাঝে হাতে থাকে জ্বলন্ত সিগেরেট। কিন্তু সিগেরেটটা সে টানে না। আঙুলে ধরিয়েই রাখে শুধু।

একদিন এক মেঘলা সন্ধ্যায় আর কেউ নেই, বৃষ্টি শেষের খানিক্ষণ পর ইভনিং কল-এ যাওয়া মাঝবয়সীর ভেতরে আটকে যাওয়া এক কিশোরীকে সিগেরেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের ভেতরে আটকে থাকা এক কিশোর বলে: হ্যালো।

 হ্যালো, হেসে বলে কিশোরী।

 আপনাকে অনেকদিন দেখেছি এখানে আসেন। দাঁড়িয়ে থাকেন। কখনো কথা বলা হয়নি।

 জ্বী, আপনাকেও দেখেছি। হাতে সিগেরেট জ্বালিয়ে রাখেন কিন্তু টানেন না।

 দু’জনের আলাপ হয়। গল্প হয়। তারপর একদিন সেই কিশোর ও কিশোরী বেরোয় বিকেলের সোনারোদে মাঠের মধ্যে পেকে লাল হয়ে থাকা কাঁচামরিচের ক্ষেত দেখার উদ্দেশ্যে।

 আর কিছু নয়। তারা দু’জনেই হাওয়ার ষড়যন্ত্রে পড়া মানুষ। তারা দু’জন বিকেলের সোনারোদের মদীরতায় সংসারের নিয়ম ভোলা দুই শিশু— গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে বিল পাড় হয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একদিন চলে যায় আরেক গাঁয়ের সীমানায়।

 গ্রামের পর গ্রাম ডিঙিয়ে তারা যায়; নিয়ম মেনে সন্ধ্যের আগেই তাদের ফেরা হয় না বাড়ি; বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় তাদের মা খুব বকেন। বকে বকে পড়ার টেবিলে বসান। তবু, দুই কিশোর–কিশোরী তেঁতে উঠা ইটের দেয়াল ছেড়ে বেরিয়ে যায়; তারা খোঁজে সোনারোদে লাল হয়ে থাকা কাঁচামরিচের সবুজ, মায়াবী এক ক্ষেত।

 ====

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G