আফরোজা সোমার ধারাবাহিক গদ্য
চারিদিকে রোদের ফল্গুধারা। গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে মায়াদুপুর। এমন দুপুর যেনো একটা বুদ্বুদ। তার উদরের ভেতর ঘোরতর মায়া হয়ে বয়ে চলে সংসার। গাছের পাতায় গলে পড়ে সূর্যালোক। রক্তাভ জবাফুলের পাপড়ীকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে জাদুর মতন ঝুলে থাকে স্বর্নাভ রোদের চাদর। বসন্তবৈরি পাখির পাখায় আততায়ীর ছুড়ির মতন ঝলকে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় অরুণাভা।
এমন বর্ণনাতীত ঘোরের ভেতর নেশাশক্ত, কালো, নোংরা, চোখে পিঁচুটিওয়ালা, ফুটপাতে শুয়ে থাকা ময়লা দাঁতের লোকটাকেও মনে হয় আপনার জন; লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অনাত্মীয় ট্র্যাফিক পুলিশের ঘর্মাক্ত মুখটাকেও মনে হয় যেনো কোমলতর; হাওয়া লেগে গাছে গাছে দুলতে থাকা পাতায় পাতায় মনে হয় যেনো বাজে অপার্থিবের গান।
এমন বুদ্বুদের ভেতর কোনোদিন আমাদের দেখা হয়নি পরস্পর। এমন ঘোরতর সময়ে ধানমণ্ডি লেকের হাওয়া তোমার গায়ের গন্ধ কোনোদিন উড়িয়ে আনেনি আমার দিকে। স্বেচ্ছায় মরে যাবার মতন এমন সুন্দর দিনে আমরা কোনোদিন দেখিনি পরস্পরের চোখের তারা।
তবু, এই দুপুরের খামে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিই তোমার নামে। তবু, এই দুপুরের প্রার্থনালয়ে আমার কিছু কয়েন জমা হয়। তবু, এই দুপুরের বুদ্বুদের ভেতর পাশাপাশি দু’টো টিকিট কেটে একটি আসন শূন্য রেখে আমি বসে থাকি অনন্তকাল।
রোদগ্রস্থ পাশের লোকটার সঙ্গে আমার কথা হয়। বাদামওয়ালার সাথে হয়ে লম্বা আলাপ। কোথায় তার বাড়ি, কোথায় তার ঠিকানা, এইসব জানা হয়; জানা হয় আসছে বৈশাখেই তার বিয়ে। দুপুরগ্রস্থ একটা যুবক গাছের ছায়ায় বসে তন্ময় হয়ে বাঁশিতে বাজায় ‘সোনার ময়না পাখি’; সেই সুরে পাশের একটা মানুষের মুখ কেমন যেনো ম্লান মনে হয়; মনে হয়, তার চোখ বুঝি করছে ছলছল। একটা তরুনী, সাদা জামার মধ্যে যার ছোটো ছোটো নীল ফুল, খোঁপায় একগুচ্ছ দোলনচাপা গুঁজে আনমনেই ইতি-উতি দেখে, টুনটুন করতে থাকা একটা চড়ুইয়ের দিকে মনোযোগ দেয় আর গুণগুণ করে গায় একটা লোকগানের কলি।
এমন সময়ে আমার পাশের আসন ফাঁকা। বহুদিন। মাঝে মাঝে আমাকে চোখ ইশারা দেন স্বয়ং দুপুর। তার ইশারা আমি বুঝি। বিশেষত, হাওয়া যখন উতলা হয়, পাখিরা যখন গাইতে থাকে ঐকতানে, হাওয়ায় যখন ছড়ায় একটা অসহনীয় সুখ, রোদে যখন বাড়তে থাকে বর্ণনাতীত মায়া, ধানমন্ডি লেকের ঢেউয়ের মাথায় যখন জ্বলতে থাকে ঝিলিমিলি আলো তখন আমি বুঝি যে, স্বয়ং দুপুর চাইছেন আজ এই বুদ্বুদের ভেতর ড্যান্সফ্লোরে আমি তার নাচের সাথী হই।
এই মায়াঘোর কেউ দেখে কেউ দেখে না। এটা জাদু নয়। বাস্তব। এর দিকে দিল্ দিয়ে তাকাতে হয়; তাকিয়েই থাকতে হয়। তবেই এখানে প্রস্ফুটিত হয় রক্তগোলাপ; তবেই, কিছু না-এর ভেতর একটা লালবউ হেসে উঠে খিলখিল; তবেই এর ভেতর একটা পাগল পুরুষ তার প্রণয়ীর দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়।
জাদু নয়; ঘোর নয়; এটা বাস্তব। পাশের এই চেয়ারটা তাই খালি রয়ে যায়। আমি জানি, মরে যাবার মতন এমনি সুন্দর দপুরে একদিন সে আসবে। দুপুরের হাওয়ায় আমার চুলের গন্ধে কেঁদে উঠবে তার মন। তার গায়ের গন্ধে আমার কেমন উছলে উঠবে আনন্দ।
তেমন দিনে যখন পত্র-পল্লবে বাজবে সংঙ্গীত, যখন আকুল হয়ে ডাকবে বসন্তবৈরি, গাছের পাতায় যখন পেলব হয়ে ছড়িয়ে থাকবে স্বর্ণাভ রোদ, তখন মায়াদুপুরের বুদ্বুদের ভেতর আমরা তাকাবো পরস্পরের চোখে। আমাদের বুক ঢিবঢিব করবে। এমন ঘোরতর সময়ে চোখে চোখ আর ধরে রাখতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিতে গিয়েও আমরা পারবো না; আবার তাকাবো চোখে। আমাদের দিকে তাকিয়ে গুণগুণিয়ে একটা লোকসংঙ্গীত গেয়ে উঠবেন স্বয়ং দুপুর।
========