আল্লাহর ওপর আস্থায় সফলতা বেশি
তাওয়াক্কুল আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো নির্ভর করা, ভরসা করা, আস্থা রাখা, নির্ভরশীলতা (আরবি বাংলা ব্যবহারিক অভিধান)। ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’ অর্থ হলো আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করা। কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজের জিম্মাদারি প্রদান করা, প্রতিনিধি বানানো।
তাওয়াক্কুল করার কারণে কঠিন বিপদও মোকাবেলা সহজ হয়। হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে মূর্তি ভাঙার মিথ্যা অভিযোগে জালিম শাসক নমরূদ যখন আগুনে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে তখন ইব্রাহিম (আ.) পূর্ণভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করার কারণে সেই আগুন ফুলের বাগানে পরিণত হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইব্রাহিম (আ.) কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হলো, তখন তিনি বললেন, হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক) আর লোকেরা যখন মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাথীদের বলল, শত্রুবাহিনীর লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে, তাই তোমরা তাদের ভয় কর, তখন তাদের ঈমান বেড়ে গেল এবং তারা বলল, হাসবুনাল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক) (বুখারী)।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বুখারির আরেকটি বর্ণনায় আছে, আগুনে নিক্ষেপকালে ইব্রাহিম (আ.)-এর শেষ কথা ছিল, হাসবিআল্লাহু ওয়া-নি’মাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক)। হাসবুনাল্লাহ আর হাসবিআল্লাহ-এর পার্থক্য হলো এক বচন ও বহু বচনের। প্রথমটির অর্থ আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট আর দ্বিতীয়টির অর্থ হলো আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট। এক বচনে হাসবিআল্লাহ, আর বহু বচনে হাসবুনাল্লাহ বলতে হয়। ইবরাহিম (আ.) ছিলেন একা। তাই তিনি হাসবিআল্লাহ বলেছেন (ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদি আরব)
তাওয়াক্কুল, তাকদির ও প্রচেষ্টার কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে- প্রত্যন্ত অঞ্চলে, মধ্যরাতে, যাতায়াত সুবিধা নগণ্য, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই-এমন স্থানে কেউ অসুস্থ হলে, সে ক্ষেত্রে তাওয়াক্কুল হলো জ্ঞান ও সামর্থের মধ্যে রোগ নিবারণের যে উপায় জানা আছে তা অবলম্বন করে সুস্থতার জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করা। তেমনি শহরে অবস্থিত অসুস্থ ব্যক্তি চিকিত্সার সব সুবিধা নিয়ে সুস্থতার জন্য আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করাই শ্রেষ্ঠ পন্থা [কিমিয়ায়ে সাদাত-ইমাম গাযযালী (রহ.)]। হাসান বসরী (র.) বলেন, রিজিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে কোনো উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা তাওয়াক্কুল পরিপন্থী নয়। কোনো যানবাহনে আরোহণ করেই গন্তব্যস্থলে কেউ নিরাপদে পৌঁছে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই, বরং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করবে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, তাওয়াক্কুল হলো ঈমানের অর্ধেক।
আর দ্বিতীয় অর্ধেক হলো আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য শরিয়ত সমর্থিত জায়েজ কোনো উপায়-উপকরণ বা পন্থা না করা তাওয়াক্কুল নয়। যেমন কেউ বলল, যদি আমার তাকদিরে ধনী হওয়া লেখা থাকে, তবে কোনো ধরনের চেষ্টা ছাড়াই ধনী হয়ে যাব। আর যদি তাকদিরে ধনী হওয়া না থাকে তাহলে যত চেষ্টা করি না কেন তাতে সফল হব না। প্রকৃত অর্থে এটি তাওয়াক্কুল নয়। ইরানের বিখ্যাত লেখক ও চিন্তাবিদ ড. হোসেইন এলাহি কুমশেরি তার কিমিয়া বা পরশমণি নামক বইয়ে লিখেছেন- আমি শক্তিহীন এক পরগাছা, আমার নিজের কোনো শেকড় নেই, যতক্ষণ আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করি ততক্ষণ আমার ভেতর কোনো ভয়ভীতি থাকে না। উল্লেখ্য যে, আল কুরআনে তাওয়াক্কুল ৯ বার, বহুবচনে মুতাওয়াক্কিল ৪ বার, বিভিন্ন ক্রিয়াপদে ৩৩ বার এবং ওয়াকিল ২৪ বার ব্যবহৃত হয়েছে। (কুরআনের পরিভাষা : ড. মুস্তাফিজুর রহমান)
ইসলামী শরিয়তে তাকদিরে বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব। তাই তাকদিরে বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সফল হলে যে কোনো ব্যাপারে শোকর আদায় করতে হবে। আর সফল না হলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। প্রচেষ্টা ও তাওয়াক্কুল উভয়টাই থাকতে হবে। তাকদিরের দোহাই দিয়ে রোগ হলে চিকিৎসা না করা, শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা না করা ইসলামসম্মত নয়। সুতরাং সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করে আল্লাহর ওপর ভরসা করাই তাকদির। লা হাওলা অলা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ …।
মুহাম্মদ আবদুল কাহ্হার
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক