আশ্চর্য হীরক খণ্ড কোহিনূরের ইতিহাস
ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:
ঘোড়া ছুটিয়ে এসে পৌঁছান যুবক। প্রবেশ করেন পিতার তাবুতে। হাতে তুলে দেন উজ্জ্বল পাথরটি। বলে উঠেন, “আব্বাজান এটা একটা হীরক খণ্ড এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে গোলকুন্ডার খনিতে পাওয়া যায়- এত বড় হীরকখণ্ড আগে দেখেনি।
গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের রত্নাকর একবার এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিল যে, পুরো পৃথিবীর অর্ধদিনের ব্যয় নির্বাহ করা যাবে এটা দিয়ে”। কথাগুলো বলছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের ২য় সম্রাট হুমায়ূন তাঁর পিতা সম্রাট বাবর কে। আর এই হীরকখণ্ড টি হচ্ছে পৃথিবীর বিখ্যাত হীরা কোহ-ই-নূর।
ব্রিটেনের রাজপরিবারের ধনরত্নের মধ্যে এর স্থান একেবারে প্রথম কাতারে। কয়েকদিন আগে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারত সফরে এলে এক সাক্ষাতকারে তাকেও প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ব্রিটেন ভারতকে কোহিনূর ফিরিয়ে দেবে কিনা। তবে ডেভিড ক্যামেরন মোটামুটি পরিষ্কার করেই বলেন যে কোহিনূর যেখানে আছে সেখানেই থাকবে।
১০৫.৬ ক্যারেটের এই হীরার ইতিহাস কিন্তু বহু আগের। নানা ঘটনা জড়িত রয়েছে এর সাথে। কারো মতে এই হীরার বয়স ৫ হাজার বছর। কারো মতে কর্ণাটকের কয়লার খনি থেকে কেউ বা বলে গোয়ালিয়রের খনি থেকে এসেছে কোহিনুর। হিন্দু মিথলোজিতে আছে এই হীরাটার কথা। চন্দ্র গুপ্ত মৌর্যের হাতেও এসেছিল এই হীরাটা এইরকম শোনা যায়। কিন্তু শক্ত কোনও ভিত্তি নেই এই কথাগুলোর।
যাই হোক ইতিহাসবিদদের মতে ১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে মালওয়ার শাসক কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের শাসকের হাতে তুলে দেন কোহিনুর কে। কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের হাত থেকে এই হীরা আসে দিল্লীর পাগলা সুলতান বলে খ্যাত মুহম্মদ বিন তুঘলকের হাতে সম্ভবত ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে। পরে লোদী সাম্রাজ্যের শাসকরা এটার মালিক হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।
সম্রাট বাবরের লিখিত বাবর নামাহর মতে গোয়ালিয়রের সেই নাম না জানা রাজপরিবারের হাত থেকে তারা কোহিনুর হীরাটি পান। প্রসঙ্গত সেই রাজপরিবার আর ইব্রাহিম লোদি এক সাথে লড়েছিলেন পানিপথের প্রথম যুদ্ধে। সম্রাট বাবরের হাত ধরে সেই হীরা আসে সম্রাট হুমায়ূনের হাতে। ইতিহাসবিদরা বাবারনামাকে শক্তিশালী রেফারেন্স হিসেবে গণ্য করেন।
আবার হাতবদলঃ
সম্রাট হুমায়ূন রাজ্যহারা। আশ্রয় নিয়েছেন পারস্যের অধিপতি শাহ তামাস্পের কাছে। কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে কিংবা উপহার বিনিময়ের রেওয়াজ হিসেবে পারস্যের সম্রাটের হাতে তুলে দেন এই মহামূল্যবান হীরাটি। পরবর্তীতে পারস্যের শাহর সহযোগিতায় দিল্লীর মনসদ ফিরে পান হুমায়ূন। কিন্তু মোঘল সম্রাটদের হাতছাড়া হয়ে যায় কোহিনূর। সম্রাট আকবর দ্য গ্রেট এবং তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্যের সময় এই হীরা তাদের কাছে ছিল না।
পারস্যের শাহ আহমেদনগরের শাসক বুরহান নিজাম শাহ কে উপহার হিসেবে দেন কোহিনুর। মূলত নিজাম শাহ শিয়া ছিলেন বলেই এই উপহার দেওয়া। প্রায় ১০৯ বছর এই হীরা ছিল আহমেদনগরের নিজাম শাহ এবং গোলকুন্ডার কুতুব শাহ দের কাছে। পরে সুলতান আবদুলা কুতুব শাহের প্রধানমন্ত্রী মির জুমলা এই হীরা সম্রাট শাহজাহানের হাতে তুলে দেন।
শাহজাহান এই হীরাটা কে বসান তাঁর বিখ্যাত ময়ূর সিংহাসনে। সম্রাট শাহজাহান পর সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে ছিল এই হীরা। এই সময় কোহিনুরের স্থান ছিল মুঘল কোষাগারে। পরে মুহম্মদ শাহ রঙ্গিলার কাছে ছিল এই হীরাটা। ( উইকির মতে আওরঙ্গজেব তাঁর রাজধানী লাহোরে নিয়ে আসেন, কোহিনুর হীরার স্থান হয় তাঁর নিজ হাতে গড়া লাহোরের বাদশাহি মসজিদে)
অতঃপর হাত ছাড়াঃ
পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমন করে লুঠ করে নেন ময়ূর সিংহাসন সহ এই কোহিনুর হীরা। কিন্তু বেশিদিন ভাগ্যে সইল না তাঁর। আততায়ীদের হাতে খুন হয়ে যান নাদির শাহ। হীরা চলে যায় নাদির শাহ্র আফগান জেনারেল আহমেদ শাহ দুররানীর কাছে। নাদির শাহর লাশ দেখার সময় কায়দা করে তাঁর সিল টা আহত করের দুররানী এবং সেই সূত্রে মালিক হন কোহিনুরের।
তাঁর মৃত্যুর পর হীরা আসে তাঁর সন্তান তিমুর শাহর কাছে। তিমুরের কাছ হতে জামান শাহর হাতে আসে সেখান থেকে সেখান হতে সুজা উল মূলকের কাছে। তিমুর শাহর ছোট সুজা উল মূলক তাঁর সৎ ভাই মাহমুদের কাছে পরাজিত হয়ে কাশ্মীরের গভর্নর আতা মুহাম্মদ খানের কাছে বন্দী হন ১৮১১ সালে। কিন্তু পাঞ্জাবের শিখ রাজা মহারাজ রঞ্জিত সিং সুজা কে উদ্ধার করেন এবং তাকে পরিবার সমেত লাহোরে পাঠিয়ে দেন। বদলে সুজা উল মূলক ১৮১৩ সালে রঞ্জিত সিং এর হাতে তুলে দেন কোহিনুর হীরা।
পাঞ্জাব থেকে ইংরেজদের হাতেঃ
রঞ্জিত সিং মারা গেলে হীরার মালিক হন তাঁর ১১ বছরের ছেলে মহারাজ দিলীপ। কিন্তু ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় পাঞ্জাব আর বলা চলে দিলীপের হাত থেকে কেড়ে নেয় কোহিনুর হীরাটি। এইভাবে এই উপমহাদেশের কাছ হতে হাতছাড়া হয়ে যায় তাদের অন্যতম মহামূল্যবান সম্পদটি। লর্ড ডালহৌসি ১৮৫০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেন হীরাটি। এই আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন করার জন্য তাঁরা দিলীপ কে নিয়ে যান লন্ডনে। সেই থেকে কোহিনুর শোভা পাচ্ছে রানীর মুকুটে। টাওয়ার অফ লন্ডনে দেখানোর জন্য মুকুটটি রয়েছে।
প্রতিক্ষণ/এডি/পাভেল