ইনকাদের যত কথা
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
ইনকা সভ্যতার কথা ছোটবেলায় সমাজ বিজ্ঞান বইয়ে পড়েনি এমন লোক খুজে পাওয়া মুশকিল।এই সভ্যতার কথা প্রায় সবাই জানলেও মাত্র গুটি কয়েক লোক আছে যারা এটার রহস্যময় তত্য সম্পর্কে জানে।
ইনকা বর্তমান পেরুর কোস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল একটি উপজাতি হিসাবে। দ্বাদশ শতাব্দিতে মধ্য আমেরিকা থেকে আগত একদল ভাগ্যান্বেষি পেরুর কুজকো (Cuzko) উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করে।
আগত এই জনগোষ্ঠির মধ্যে ছিল কৃষক, কারিগর, কামার ইত্যাদি। স্থানীয় লোকেদের পরাভূত করে হাতুন তামাক নামক এক সাহসী যোদ্ধা ১৩৯০ সালের দিকে কুজকো উপত্যকায় একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রাজত্বের নাম হয় ইনকা এবং রাজা তাপাক নিজেকে ভিরাকোচা ইনকা (জনগণের ঈশ্বর) নামে ভূষিত করেন। বলা যেতে পারে ইনকা সভ্যতার সূচনা কিছুটা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে হয়েছিল।
ইনকা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এই আন্দীয় সভ্যতায় টাকার প্রচলন ছিল এবং ভোগ্যপণ্য ও বিলাসপণ্যের ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই সভ্যতায় কর ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। বলা হয়ে থাকে যে কর উত্তোলকরা বিভিন্ন পশু, বৃদ্ধ বা দাসের বলি উৎসর্গ হিসেবে গ্রহণ করত।
মাচুপিচু হচ্ছে ইনকাদের সবচেয়ে বিষ্ময় নগরীর নাম। মাচুপিচু শব্দটি আমেরিকান কেচুয়া জাতির ব্যবহৃত শব্দ। আর এর অর্থ প্রাচীন পর্বত। মাচুপিচুর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭,৫০০ ফুট উচ্চতায়। অধিকাংশ সময় মাচুপিচু নগরী মেঘের আড়ালে ঢাকা থাকে বলে একে মেঘের দেশের নগরী বলে। এমনকি উপর দিয়ে চলাচল করা বৈমানিকদেরও এটি চোখে পড়ে না। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন ২০০৭ সালের ৭ জুলাই মাচুপিচুকে আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি বলে ঘোষণা দেয়। মাচুপিচু নগরীটি কোনো ধ্বংসাবশেষ নয় বরং একেবারে অব্যয় ও অক্ষত অবস্থায় কী এক অজ্ঞাত কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। বর্তমান বিশ্বের কাছে ইনকা সভ্যতা বলতে মাচুপিচুর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। তাই প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ পর্যটক মাচুপিচু দেখতে ছুটে যায় পেরুর রাজধানী লিমা থেকে ৩৫৭ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কুসকো শহরে।
মূলত ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পেরুর উচ্চ ভূমি কুজবেন অঞ্চলে ইনকা সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমান ইকুয়েডর, পেরু, বলিভিয়া, উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়াও ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইনকারা সভ্যতায় ধর্মভিত্তিক কুসংস্কারের কোনো শেষ ছিল না। সূর্য দেবতা ‘ইনটি’ ছিল ইনকা ধর্মের মূল কেন্দ্র। তবে এর পাশাপাশি তারা স্থানীয় অনেক দেব-দেবীকে মেনে নিয়েছিল। প্রজারা এসব দেব-দেবীর পূজা করত, যারা ‘হুয়াকাস’ নামে পরিচিত ছিল। যদিও ইনকারা মেক্সিকোর আজটেক্সাদের মতো রক্তপিপাসু ছিল না, তবুও তারা নরবলি পছন্দ করত। বিশেষ করে ‘কাপাকচা’ নামের বিশেষ অনুষ্ঠানে শিশুদের বলী দেওয়া হত। দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার আগে ইনকারা কিভাবে তাদের সন্তানদের মোটাতাজা করত, তার নির্মম প্রমাণ পাওয়া গেছে কিছু মমি আবিষ্কারের মাধ্যমে।
আগ্নেয়গিরিকে কিংবা অন্য দেবদেবীকে শিশু উৎসর্গ করা ইনকা সভ্যতার একটি বর্বরতম দিক। দেবদেবীদের উৎসর্গের আগে ইনকারা তাদের সন্তানদের মোটা-তাজা করে নিত। আর এই কাজটি তারা কিভাবে সম্পাদন করত, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে ক’দিন আগেই। প্রাচীন ইনকা সভ্যতার নিকটবর্তী লুলাইলাকো নামের একটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় সংরক্ষিত ৫০০ বছরের পুরনো মমীর চুল পরীক্ষার মাধ্যমে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত জানা গেছে। সেখানে ‘লুলাইলাকোর কুমারী’ নামে পরিচিত ১৫ বছর বয়সী এক বালিকা এবং ‘লুলাইলাকোর বালক’ নামে সাত বছর বয়সী এক বালকের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। মমীকৃত দুটি দেহের সঙ্গে ছয় বছর বয়সী আরেকটি ছোট মেয়ের মমির সন্ধান পাওয়া যায়। উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনায় চিলির সীমান্তবর্তী লুলাইলাকো পাহাড়ে এসব মমী ১৯৯৯ সালে আবিষ্কার হয়। ওখানকার প্রতিটি দেহই সূক্ষ্মভাবে সংরক্ষিত ছিল। যদিও বজ্রপাতে ছোট মেয়েটির দেহাবশেষ ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে তার ডাকনাম হয় ‘বজ্রের মেয়ে’। লুলাইলাকোর কুমারী বা ‘লা ডনচেলো’কে বিবেচনা করা হচ্ছে আন্দিজের সব মমীর মধ্যে সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত। কিছুদিন আগে এটি জন সমক্ষে প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এটি ‘হাই মাউন্টেইন আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম’-এ রাখা আছে, যেটি সাল্টার নিকটবর্তী একটি শহরে অবস্থিত।
তাদের দেহাবশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে, মৃত্যুর পূর্ববর্তী ১২ মাসে তাদের খাদ্যাভ্যাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছিল। গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন একজন ব্রিটিশ গবেষক। গবেষকরা জানান, পর্বতশৃঙ্গে অবস্থিত একটি ধর্মীয় সমাধি স্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রার আগে বাচ্চাগুলোকে বিশেষ ধরনের আনুষ্ঠানিক পথ্য দেওয়া হতো। লুলাইলাকো আগ্নেয়গিরির উচ্চতা ২২,১১০ ফিট (৬,৭৩৯ মি.)। সমাধি স্থলটি এর ৮২ ফিট (২৫ মি.) উঁচুতে অবস্থিত। সেখানে তাদের শ্বাসরোধে হত্যা করা হতো অথবা আগুনের উত্তাপে মৃত্যুর জন্য রেখে আসা হতো। সম্ভবত ইনকাদের বিজিত জনগোষ্ঠীদের মাঝ থেকে এ ছেলে-মেয়েকে বেছে নেওয়া হতো। যে তথ্য এ সম্ভাবনা বৃদ্ধি করছে তা হলো, ‘বলির পাঁঠা’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আগে এ ছেলে মেয়েরা সাধারণত কৃষি খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত ছিল। শুধু পাহাড়ের দেবতাদের তুষ্ট করতেই তাদের বলি দেওয়া হতো না, বরং একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পর্কে বিজিতদের মনে ভয় ও সম্মান ঢুকিয়ে দেওয়াও এর একটি উদ্দেশ্য ছিল বলে গবেষকরা মনে করেন।
এ গবেষণা দলের অন্যতম একজন গবেষক ইউনিভার্সিটি অব ব্রাডফোর্ডের টিমোথি টেইলর। তিনি বলছেন, দেখে মনে হচ্ছে বছর ব্যাপী ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাচ্চাগুলোকে প্রধান সমাধি স্থলের দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। এ সময় তাদের ওষুধ দিয়ে মাতাল করে আগুনের মুখে ঠেলে দেওয়া হতো। তিনি আরও বলছেন, অবশ্য কেউ কেউ এ নির্মম হত্যাকাণ্ডকে আদিম বিশ্বাস ব্যবস্থার আলোকে বিচার করতে পছন্দ করবেন। কিন্তু আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ইনকারা ছিল সাম্রাজ্যবাদী। সম্ভবত দুর্গম এলাকায় ভয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃষিজীবীদের সন্তানদের প্রতি এ নির্মম আচরণ ভালো কৌশল হিসেবে কাজ করেছিল।