ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপানের বিপদ

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫ সময়ঃ ২:৫১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ

ধর্ম চিন্তা ডেস্ক, প্রতিক্ষণ ডটকম:

image_105982_0ধূমপান সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি মহাবিপদ। তাই আজ গোটা বিশ্ব জুড়ে ধূমপানের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ ধূমপানের শিকার হয়ে দিনের পর দিন সুন্দর স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলছে।

লক্ষ লক্ষ লোক ধূমপান জনিত ক্যান্সার সহ অনান্য রোগে মারা যাচ্ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন ঘাতক রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসহায় অবস্থায় অতি কষ্টে মানব সমাজে বেঁচে আছে। তাই সমগ্র পৃথিবীর সর্বস্তরের জ্ঞাণীগন মানুষকে ধূমপানের করাল গ্রাস হতে বাচাবার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাই ইসলামেও ধূমপানের ব্যাপারে রয়েছে নির্দেশনা।

ইসলামের দৃষ্টিতে ধূমপানঃ

ধূমপান মানব সমাজের অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধন করে। তাই নিঃসন্দেহে ইসলামের দৃষ্টিতে তা হারাম। এই প্রসঙ্গে বর্তমানে যুগের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ সাউদী আরবের সর্বোচ্চ ফতোয়া বোর্ডের প্রধান মুফতি আল্লামা শেখ ইবন বায বলেছেন: ‘‘ধূমপান হারাম, যেহেতু তা অপবিত্র ও নিকৃষ্ট জিনিস এবং অসংখ্য ক্ষতির কারণ।’’ আল্লাহ্ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য শুধু পবিত্র পানাহার হালাল করেছেন। আর তাদের উপর অপবিত্র জিনিস হারাম ঘোষণা করেছেন।

পবিত্র কুরআনে আছে: ‘‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে, কোন জিনিস তাদের উপর হালাল করা হয়েছে? আপনি বলুন, তোমাদের জন্য পবিত্র জিনিস গুলোই শুধু হালাল করা হয়েছে।’’ (আল-মায়েদা: ৪)

7768158692_4e59c945f2_zআল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল-আ‘রাফে তার নবী মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: ‘‘তিনি তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ দেন আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করেন এবং তাদের জন্য সর্বপ্রকার পবিত্র জিনিস হালাল করেন ও তাদের উপর সর্বপ্রকার অপবিত্র জিনিস হারাম করেন।’’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৫৭)

সকল প্রকারের ধূমপান কখনই পবিত্র জিনিসের অর্ন্তভুক্ত নয়। বরং তা মারাত্মক ক্ষতিকর ও অপবিত্র জিনিস। তাই ধূমপানের ব্যবসাও মাদক দ্রব্যের ব্যবসার মতো নাজায়েয।

অতএব, যারা ধূমপান করে ও ধূমপানের ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের জন্য ওয়াজিব দ্রুত তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা এবং অতীত কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হওয়া ও ভবিষ্যতে এ কাজ না করার অঙ্গীকার করা। আর যে ব্যক্তি সত্যিকারভাবে তওবা করে আল্লাহ্ তা‘আলা তার তওবা কবুল করেন।

যেমন: আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন: ‘‘হে মুমিন বান্দারা! তোমরা প্রত্যেকে আল্লাহর নিকট তওবা কর, নিশ্চয়ই তোমরা সফলকাম হবে।’’

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন, ‘‘এবং নিশ্চয়ই আমি ক্ষমাশীল ঐ ব্যক্তির জন্য যে তওবা করে ও ঈমান আনে এবং নেক ‘আমল করে অতঃপর সত্য সঠিক পথ অবলম্বন করে।’’ (ত্বাহা: ৮২)

আজ মুসলিম জাহানের ওলামায়ে কেরামের ঐক্যবদ্ধ মত হলো, ‘‘ধূমপান হারাম, এমনকি তা ক্রয় বিক্রয়ের জন্য দোকান ভাড়া দেওয়াও হারাম।’’ কোনো হারাম কাজের সহযোগিতাও হারাম।

ধূমপান হারাম হওয়ার আরেকটা বড় দলীল হলো, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ‘‘তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।’’ (আল-বাকারা: ১৯৫)

ধূমপায়ী যেমন নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তেমনি সে ধীরে ধীরে নিজের জীবনী শক্তি নষ্ট করে আত্মহত্যার মত অপরাধ করছে। অর্থের অপচয় বা অর্থ নষ্ট ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই অপচয়কারী শয়তানের ভাই।’’ (ইসরা: ২৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’’ (আল-আ‘রাফ: ৩১)

ধূমপান কেবল অপচয় নয়, সম্পূর্ণ ক্ষতিকর কাজে অর্থ নষ্ট ছাড়া আর কিছুই না।

আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখে দূর্গন্ধ হয় এমন সবজি বা কাচা পেয়াজ, রসুন খেয়ে মসজিদে আসতে নিষেধ করেছেন, যেমনটি সাহীহ আল-বুখারীর (৯/১১০)

নিম্নের হাদীছটিতে রয়েছে:

এতে ফেরেশতা ও মানুষের কষ্ট হয়ও হয়, হাদীসে আছে: “যে ব্যক্তি পিয়াজ, রসুন এবং পিয়াজের মতো গন্ধ হয় এমন কোনো সবজী খাবে, সে যেন আমাদের মসজিদের ধারে কাছেও না আসে, কেননা; মানুষ যে খারাপ গন্ধ দ্বারা কষ্ট পায়, ফিরিস্তারাও তদ্রূপ কষ্ট পায়।” (সাহীহ মুসলিম: ১/৩৯৫)

অন্য হাদীসে আছে, ‘‘যে কেউ আল্লাহ্ তা‘আলা ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’’ (বুখারী: ৭/২৬)

আরেক হাদীসে আছে, ‘‘ঐ লোক প্রকৃত মুসলিম, যার মুখ ও হাত হতে অন্য মুসলিম নিরাপদে আছে।’’ (বুখারী: ১/১১)

স্বাস্থ্যগত ক্ষতি:

ধূমপানের প্রতি টানে মানুষের দেহে যতটুকু ধোঁয়া প্রবেশ করে তাতে রয়েছে দেহের জন্য কতোগুলো বিষাক্ত পদার্থ। এগুলোর প্রভাবে দেহের প্রতিটি তন্ত্রের কার্যক্ষমতা ক্রমশঃ বিপন্ন হয়ে পড়তে থাকে এবং এর ফলে জন্ম নেয় হাজারো রোগ। মানব দেহে এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যেখানে ধূমপান কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। ধূমপানের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে:

(১) অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা তেমন সু-স্বাস্থের অধিকারী হয় না এবং আয়ু বেশী পায় না।

(২) ধূমপান পঙ্গু ও অসমর্থ করে দেয় এমন কিছু রোগের জন্য দায়ী।

(৩) ধূমপানের ফলে মুখের ক্যান্সার সহ সব ধরনের ক্যান্সার রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।

(৪) ধূমপানের অভ্যাস থেকে ব্রংকাইটিস, এম.কাই.সেমা, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ, স্ট্রোক, মস্তিস্কের রক্তনালী ছিড়ে যওয়া, বার্জাস ডিজিজ, গ্যাষ্ট্রিক, আলসার ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে।

(৫) হজমশক্তি বিনাশ, কিডনী, মুত্রাশয়, চোখ ও প্রজননতন্ত্রের গুরুতর গোলযোগ ও যৌন দুর্বলতার মূলে রয়েছে তামাকের বিষাক্ত ছোবল।

পরিবেশগত ক্ষতিঃ

(১) বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়া অফিস-আদালত, দোকান-পাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাস্তাঘাট এবং বাড়ীঘরের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দুষণ করে। এতে সার্বিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং রোগ বিস্তার ঘটে ব্যাপক হারে।

(২) ধূমপানে যেমন পরিবেশ নষ্ট হয় ঘরে, তেমনি গর্ভের পরিবেশও নষ্ট হয়ে ক্ষতি করে গর্ভস্থ শিশুর।

নৈতিক ও সামাজিক ক্ষতিঃ

ধূমপানের সাথে সামাজিক অবক্ষয়ের সংযোগ আছে। নেশা ও নৈতিকতার দ্বন্দ আছে। এক সাথে দুটো চলতে পারে না। নেশার দাসত্ব এক অর্থে মানবিক পরাজয়।

(১) বিড়ি সিগারেট একটি নেশা জনিত বাড়তি খরচ। এ খরচ যোগাতে ব্যক্তির পদস্খলন আরম্ভ হয়।

(২) প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যারা ধূমপান করেন তাদেরকে সিগারেটের মাধ্যমে প্রভাবিত করা খুব সহজ। আপ্যায়নের নামে সিগারেট অনেক সময় উৎকোচের (ঘুষের) পর্যায়ে পড়ে।

(৩) শিক্ষক ও ডাক্তারদের জন্য ধূমপান একটি মারাত্মক অবক্ষয়। বয়স্ক ও গুরুজনরা ধূমপান করলে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়। তাদের প্রতি আর শ্রদ্ধাবোধ থাকে না, এতে এক পর্যায়ে পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ধ্বসে পড়ে।

(৪) হুক্কা, শিশা যেমন মূখে মূখে ঘুরে, একই ভাবে বিড়ি সিগারেটও মূখে মূখে জ্বলে। ফলে একজনের মূখের জীবানু অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে সামাজিকভাবে রোগ বিস্তার ঘটায়।

(৫) ধূমপানের ফলে অনেকের মূখেই বিশ্রী ও উৎকট দূর্গন্ধ হয়। যা কিনা সভা সমিতি, মসজিদ-মাদ্রাসা, অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই ঘৃণা ও বিরক্তির উদ্রেক করে। অনেক সময় দেখা যায় শিশু ও নারীরা এ দূর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে ধূমপায়ীকে এড়িয়ে চলে এবং পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। ধুমপায়ীর গাড়ী বা ট্যাক্সিক্যাবে উঠে বিড়ি-সিগারেটের গন্ধে অনেকের মাথাব্যথাও শুরু হয়। অনেকে বমি করেও দিয়েছে এমন হাজারো নজির আছে। ধুমপানকারীর টেক্সীতে যাত্রীরা উঠতে চায় না, আর সে ইচ্ছা করেই সবার ঘৃণার পাত্র হচ্ছে।

আর্থিক ক্ষতিঃ

ধূমপানের ফলে কষ্টার্জিত অর্থের বিরাট অপচয় হয়। আল্লাহর দেওয়া আমানত আগুনে পুড়িয়ে শেষ করা হয়।

(১) প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা এ ক্ষতিকর খাতে ব্যয় হচ্ছে।

(২) ধূমপানের ফলে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় কত মানুষ সর্বহারা হচ্ছে।

(৩) ধূমপান একটি অগ্নিকাণ্ডের মতো, যে অগ্নিকাণ্ডে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও আল্লাহর দেওয়া মানুষের অসংখ্য হার্ট (heart) ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিক্ষণ/এডি/ ইসলাম

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G