ইসলামে প্রতিবন্ধীদের সমাদর
ধর্ম চিন্তা ডেস্ক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
এতে কোন দ্বীমত নেই যে, প্রতিবন্ধীগণ মানব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ধারণা করা যায়, যখন থেকে মানব জাতি বিস্তার লাভ শুরু করেছে, ঠিক তখন থেকে কোন না কোনরূপে প্রতিবন্ধীও অস্তিত্বে এসেছে।
তাই তাদের উপেক্ষা করা হলে সমাজের একাংশকে উপেক্ষা করা হবে। যার ফলে সমাজ ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন ও সমন্নোতিতে ব্যাঘাত ঘটবে, যা সুসভ্য ও আদর্শ সমাজে অশোভনীয়।
মহান আল্লাহর মনোনিত ধর্ম ইসলামে রয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে কিছু সুন্দর বিধান। রয়েছে তাদের মর্যাদা ও অধিকার, যা আমরা অনেকে জানিনা।
আমরা এই প্রবন্ধে তারই কিছুটা আলোচনা করার প্রচেষ্টা করবো ইন্ শাআল্লাহ।
প্রতিবন্ধী কাকে বলে ?
আভিধানিক অর্থে প্রতিবন্ধী হচ্ছে, দৈহিক শক্তির একান্ত অভাব বা অঙ্গহানি হেতু যাহারা আশৈশব বাধাপ্রাপ্ত, মূকবধির, অন্ধ, খঞ্জ ইত্যাদি। [ সংসদ বাংলা অভিধান/৩৮২]
পারিভাষিক অর্থে প্রতিবন্ধীতা হচ্ছে, দেহের কোন অংশ বা তন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষনস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। [উইকিপিডিয়া, বাংলা]
অস্বাভাবিক সৃষ্টির রহস্যঃ মহান আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ভাল-মন্দেরও সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকুলের মধ্যে কিছু সৃষ্টিকে আমরা অনেক সময় অস্বাভাবিক ও বিকৃত দেখতে পাই। অনেকে এর দোষটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে দেয়; অথচ তিনি পুত-পবিত্র দোষমুক্ত, আবার অনেকে সেই সৃষ্টিকেই দোষারোপ করে। এর পিছনে তাঁর উদ্দেশ্য ও রহস্য মহান । সেটা এক মাত্র তিনিই জানেন। তবে কিছু কারণ অনুমান করা যেতে পারে যেমনঃ
[১]- যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে, তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম।
[২]- আল্লাহ যাকে এই আপদ থেকে নিরাপদে রেখেছেন সে যেন নিজের প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে, অতঃপর তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও সেইরকম করতে পারতেন।
প্রতিবন্ধীর প্রতি শারয়ী কর্তব্যঃ
[১]- যেন সে ধৈর্যধারণ করে এবং সন্তুষ্ট থাকে কারণ এটি ভাগ্যর লেখা,যা ঈমানের অঙ্গ।
মহান আল্লাহ বলেনঃ অর্থঃ ( পৃথিবীতে এবং ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগৎ সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। নিশ্চয় এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এ জন্যে, যাতে তোমরা যা হারাও তাতে দুঃক্ষিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে উল্লসিত না হও। আল্লাহ উদ্ধত ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।) [ হাদীদ/২২-২৩]
[২]- যেন সে বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ যখন কোন মুমিনকে পরীক্ষায় ফেলেন, তখন তিনি তাকে ভালবাসেন এবং অন্যান্যদের থেকে তাকে বেশি অগ্রাধিকার দেন। তাই তিনি নবীগণকে সবচেয়ে বেশি বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন।
নবী (সাঃ) বলেনঃ “ নবীগণ সব চেয়ে বেশি পরীক্ষিত হন, অতঃপর তাদের থেকে যারা নিম্ম স্তরের। মানুষকে তার দ্বীন অনুযায়ী পরীক্ষা নেওয়া হয়, যদি তার দ্বীনী অবস্থা প্রবল হয়, তাহলে তার বিপদও কঠিন হয়। আর যদি তার দ্বীন দুর্বল হয়, তাহলে তার পরীক্ষা সে অনুপাতে হয়। বিপদ বান্দার পিছু ছাড়েনা পরিশেষে তার অবস্থা এমন হয় যে, সে পাপ মুক্ত হয়ে যমীনে চলা-ফেরা করে। [সহীহ তিরমিযী নং১৪৩,ইবনু মাজাহ]
[৩]- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেন মনে রাখে যে, দয়াবান আল্লাহ মুমিনকে তার প্রত্যেক বিপদের বদলা দেন, যদিও সেই বিপদ নগণ্য হয়, এমনকি কাঁটা বিধলেও।
নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘মুসলিম ব্যক্তিকে কষ্ট, ক্লান্তি, দুঃখ, চিন্তা, আঘাত, দুশ্চিন্তা গ্রাস করলে এমন কি কাঁটা বিধলেও আল্লাহ তাআলা সেটা তার পাপের কাফ্ফারা করে দেন’’। [ বুখারী, মুসলিম]
প্রতিবন্ধীদের জন্য আমাদের করণীয়ঃ
[১]- নিজের সুস্থতা ও আরোগ্যতার কারণে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য দুআ করা।
[২]- যথাসম্ভব প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। সেটা অন্ধ ব্যক্তিকে রাস্তা চলায় সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের শিক্ষাদানে সহযোগিতা হোক। সুস্থদের সামান্য সাহায্যে তাদের জীবন-যাপন সহজ হতে পারে, তাদের মুখে ফুটতে পারে হাসি এবং তারা দাঁড়াতে পারে সমাজের সবার সাথে এক লাইনে।
মনে রাখা দরকার, প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা তার উপর জরূরী, যে তার অভিভাবক। আর সমষ্টিগত ভাবে সকল মুসলিমের জন্য ফরযে কিফায়া। অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক তাদের দেখা-শোনা করলে বাকি লোকেরা গুনাহগার হবে না।
[৩]- বিশেষ করে তাদের এমন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া যার ফলে তারা নিজের প্রয়োজনীয় কাজ নিজে করতে পারে এবং নিজে রোজগার করে স্বয়ং সম্পন্ন হতে পারে।
ইসলামে প্রতিবন্ধীর মর্যাদাঃ
[১]- সবাই সমান, আর তাক্বওয়াই হচ্ছে মানুষ মর্যাদার মান-দন্ডঃ ইসলামে মানব মর্যাদার মাপ-কাঠি রং, বর্ণ, ভাষা, সৌান্দর্য্যতা, সুস্থতা, ইত্যদি নয়। বরং মান-দন্ড হচ্ছে তাক্বওয়া তথা আল্লাহ ভিরুতা। যে যত বেশি মুত্তাকী আল্লাহ তাকে তত বেশি ভাল বাসেন। এই মাপ-কাঠির মাধ্যমে ইসলাম প্রতিবন্ধী ও অপ্রতিবন্ধীর মাঝে ভেদাভেদ দূরীভূত করেছে এবং উভয়কে সমমর্যাদা দান করেছে।
আল্লাহ বলেনঃ অর্থঃ ( হে মানুষ ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী।) [হুজুরাত/১৩]
নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের শরীর ও আকৃতির দিকে দেখেন না বরং তোমাদের অন্তরের দিকে দেখেন।’’ [মুসলিম]
[২]- নর-নারী যেন এক অপরের উপহাস না করেঃ প্রতিবন্ধীর সমস্যা প্রতিবন্ধীই বেশি জানে কিন্তু যখন কোন সুস্থ ব্যক্তি তাকে উপহাস করে তখন সে দারুণ ভাবে মর্মাহত হয়। তাই ইসলাম সুস্থ হলেও এক অপরের উপহাস করা নিষেধ করেছে।
আল্লাহ বলেনঃ ( হে মুমিনগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে; কেননা, যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।) [হুজুরাত/১১]
ইসলামের এই মনোরম বিধানে প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে সহজতা ও সহনশীলতা। তাই এমন প্রতিবন্ধী, যে ইসলামের বিধান পালনে একে বারে অক্ষম যেমন পাগল ও জ্ঞানশূন্য ব্যক্তি, তার উপর ইসলাম কোন বিধান জরূরী করে না।
আর আংশিক প্রতিবন্ধী যে কিছুটা করতে সক্ষম তার প্রতি অতটুকুই পালনের আদেশ দেয়। যেমন যদি কারো অর্ধ হাত কাটা থাকে তাহলে যতটুকু অংশ বাকি আছে অযুর সময় ততটুকু ধৌত করতে আদেশ দেয়। অনুরূপ প্রতিবন্ধকতার কারণে নামাযে দাঁড়াতে না পারলে বসে আদায় করার আদেশ দেয়। এইভাবে অন্যান্য অবস্থা।
প্রতিক্ষণ/এডি/ ইসলাম