আফরোজা সোমার ধারাবাহিক গদ্য
তবু তোমাদের নাম ধরে জপি। মনে মনে । অহর্ণিশ। অবিরাম। হারিয়ে গিয়েছো যারা মাঠে, গোধূলির লালে। আমিও গিয়েছি হারিয়ে। হয়তো তোমাদেরই সাথে। হয়তো একা। হয়তো দুপুররোদে পানির মধ্যে নরসুন্দার ঝিকিমিকি মায়ার ভেতর আমি গিয়েছি হারিয়ে। জানি না কোথায় ঠিক। শুধু জানি আমি নেই। নেই। তাই খুঁজছি তোমাদের। হয়তো তোমরা— গোধূলির লাল, মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটা একা গাছ, বিলের মধ্যে ফুটে থাকা শাপলা ও শালুক ফুলের দল তোমরা— জানো ঠিকানা আমার।
এই নিদানে, এই নিদাঘে আজ ফিরবো গৃহে; ডেরায়; কাঁদাখোচা পাখির নখের মায়ায়। আমাকে ফেরাও। আমাকে ফেরাও আমার কাছে। আমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও কবরের ধার ঘেষে ফুটে থাকা দুধসাদা দলকলস ফুল। আমাকে ফিরিয়ে দাও আগুনলাগা সন্ধ্যা। আমাকে ফিরিয়ে দাও টিনের চালে মাঝরাতে খসখস খচরখচর করতে থাকা সজারুর কাঁটা। তোমাদের বুকের ভেতর চূরচূর হয়ে মিশে হারিয়ে গিয়েছি আমি ঠিকানা না জানা দেশে। তোমরা কোথায়? কোন সুদূরে? একবার দাও সাড়া।
দাও উত্তর জঙ্গলের ঝিঁঝিঁ পোকার মতন মিহিন সুরে। আমি ঠিক শুনতে পাবো। দাও উত্তর রাতের পাতানাড়ানো গাছের মতন মৃদু ভাষায়। দাও উত্তর সুবেহ সাদিকের হাওয়ার মতন মিহি সুরে। অথবা বাঁশঝাড়ে বসে ডাকো হয়ে একটা লক্ষী প্যাঁচা । কিংবা স্বপ্নের ভেতর একটা ময়ূর হয়ে সবুজ একসমতল থেকে হাঁটতে থাকো সবুজতর নিকট এক পাহাড়ের দিকে; স্বপ্নের ভেতর আমি বুঝে নেবো পথনির্দেশনা; শুনে নেবো ডাক; বুঝে নেবো সকল উত্তর।
তবু আমাকে আমার নিকটে ফেরাও; ফেরাও সমূলে; সগোত্রে আমার। এই বিরাট শহর, এই মায়াপুরী আমাকে খেয়েছে গিলে। আমাকে করেছে যক্ষ। আমাকে করেছে কেরাণী। এই অনন্ত নগর এক ল্যাবিরিন্থ— গোলকধাঁধাঁ— জাদুকরের তৈরি এক অনন্ত বিভ্রম। এই গোলকের জটিলতায় আমি হারিয়েছি পথ; হারিয়েছি আমার অবশিষ্টাংশ।
দেয়ালের ওপারে দেয়াল তুলে নিজেকে ভরেছি সিন্দুকে। ছাদের উপরে ছাদ তার উপরে ছাদ তুলে আকাশের কাছাকাছি গড়েছি আবাস; রাজাসম দূরত্বে নিজেকে চেয়েছি নিতে সাধারণের চেয়ে।
দেয়ালের ওপারে দেয়ালের আড়াল রচনা করে গড়েছি আবাস। আর মন নেমেছে নীচে, ক্ররতায়। মন মেতেছে জগৎ শেঠ ও ঘষেটিপনায়। আর এই সুনিপুণ সুউচ্চ ভবন, দুয়ারে দাঁড়ানো প্রস্তুত প্রহরী আমাকে সদা করছে পরিহাস।
আজ আমাকে ফেরাও ঘাস; শীতে সবুজ ঘাসে টলটলায়মান এক রত্তি শিশির। আমাকে ফেরাও পথের ধারে ফুটে থাকা বেগুনি কলাইফুল। রবিশস্যের মতন আমি পড়ে থাকবো ধুলোয়। শুয়ে থাকবো মাঠে। আমার মুখে, শরীরে ও আত্মায় লাগবে রোদ। ধুয়ে-মুছে নিজেকে আবার শুকিয়ে নেবো রোদে। তবু এই ল্যাবিরিন্থ থেকে, এই মায়াপুরী থেকে আমাকে বাঁচাও। আমাকে দাও ফিরিয়ে সেই অপ্রাচুর্যের দিন; ঐশ্বর্যময় সেই রঙীন মূহুর্ত সকল।
পাড়ার একটা কুকুরের সাথে উষারায় বসে-বসে বলবো কথা। দেখবো তার মায়াবী চোখে ঘনায় বিকেল। সোনারোদে মায়াবী চোখের সেই কুকুরের সাথে খেলবো বিকেলভর। তবু এই পাতানো ম্যাচ আর নয়। আমাকে তুমি ডেকে নাও জারমুনি ফুল। তোমার নিকটে বসবো আমি। দেখবো শিকড়ের তলায় কী করে ছোটো-ছোটো পোনা মাছকে তুমি দাও আশ্রয়। পোনা মাছ হয়ে তোমার শেকড়-বাকড়ে আমি হবো শীতল। তবু, এই সুউচ্চ ভবনের আলোহীন কারাগার থেকে আমায় মুক্ত করো।
আমায় মুক্ত করো গোধূলির লাল। আমাকে জানাও ঠিকানা আমার। নিজেকে হারিয়ে আমি বিপন্ন। একা। বিরান মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটা একা গাছ। হাওয়ার মধ্যে তোমার গন্ধ পাঠিয়ে তুমি জানাও ঠিকানা তোমার। ফিরবো নিজের কাছে। একা। খালি হাতে। নিয়ে এই সমর্পিত হৃদয়।
——–