একজন বাঙালি ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’

প্রথম প্রকাশঃ জুলাই ১৩, ২০১৫ সময়ঃ ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ৪:৪৯ অপরাহ্ণ

shohidullah

 

 

“আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য,
তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।”

আলোচ্য উক্তিটি ছিল উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক হিসেবে পরিচিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাবিদ, গবেষক, লোকবিজ্ঞানী, অনুবাদক, পাঠসমালোচক, সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যিক, কবি, ভাষাসৈনিক এবং একজন খাঁটি বাঙালি মুসলিম ও দেশপ্রেমিক।

তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে ১০ জুলাই ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন

১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে সম্মান-সহ বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক দর্শনতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) ডিগ্রী অর্জন। এছাড়াও, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরবন বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিস থেকে পি.এইচডি ডিগ্রী (১৯২৫) লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করার পূর্বেই কিছুকাল তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

কর্মজীবন
এন্ট্রান্স পাশের সময় থেকেই মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বিভিন্ন ভাষার প্রতি অতি উৎসাহী ও আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং একাধিক ভাষা শিক্ষা শুরু করেন। ১৯১৫ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চব্বিশ পরগণার বশিরহাটে আইন ব্যবসা করেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পাশাপাশি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯২২ থেকে ১৯২৪ সালে পর্যন্ত আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে পি.এইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখান থেকে ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারী আজিজুল হক কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ – ১৯৫৫ সালে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগদান করে ১৯৫৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

বিভিন্ন ভাষায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র দখল ছিল অসাধারণ ও অসামান্য। উর্দু ভাষার অভিধান প্রকল্পেও তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পরে পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৬১ – ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই দেশের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যে ক’জন ব্যক্তি জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তাঁর এই ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ অনেকখানিই প্রশস্ত হয়।

সাহিত্য
শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –

ভাষা ও সাহিত্য
বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত
দীওয়ানে হাফিজ
রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম
বিদ্যাপতি শতক
বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড)
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ
বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়।

উপমহাদেশের এই বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক হাবীব আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই। তার ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায়।
প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

সর্বাধিক পঠিত

20G