এক নজরে মসজিদের শহর ইস্তানবুল
দুটি মহাদেশে দুই পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকা মহানগরী ইস্তানবুল যার বুক চিরে চলে গেছে বিখ্যাত প্রণালী বসফরাস সেই ভুবনমোহিনী শহরে একদিন আগন্তুক হিসেবে এসে হাজির হলে দেখতে পাবেন, হাজার বছরের কয়েকটি সাম্রাজ্যের ইতিহাসের শহর ইস্তানবুল।
এক জন্মে গ্রীকরা তাদের রাজা বাইজাসের নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রেখেছিল বাইজ্যানটাইন, সাড়ে ছ’শ বছর পর রোমানরা এসে যখন গ্রীকদের হঠিয়ে দিল লোকে তাকে ডাকতে শুরু করল নতুন নামে, কন্সট্যানটিনোপোল, মানে এ শহর সম্রাট কন্সট্যানটিনের। আরেক জন্মে, তাও প্রায় হাজার বছর পর, পুব দিকে থেকে অটোম্যানরা এসে যখন দখল করে নিল এ শহর, কন্সট্যানটিনোপোল ভোল পালটে হয়ে গেল ইস্তানবুল।
দুনিয়া চাপিয়ে দিয়েছে তার গায়ে কত কত নাম, অথচ শহরের লোকেরা ভালবেসে তাকে ডাকে অন্য আরেক নামে। বেয়োগলু। এক পারে ইউরোপ আর অন্য পারে এশিয়াকে রেখে মহানগরীর মাঝখান দিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বয়ে চলেছে মোহনীয় বসফরাস। মর্মর সাগরের হাওয়া নিয়ে ছুটে যায় সে কৃষ্ণসাগরে দিনরাত। দুটো আপাত বিপরীত সংস্কৃতির মানুষের পদভারে মুখরিত আশ্চর্য সে শহর,ওরহান পামুকের ইস্তানবুল।
এ শহরের এক ভাগ পড়েছে ইউরোপে আর অন্য ভাগ এশিয়ায়। তার মানে ইস্তানবুল হল নির্জন, উদার ইউরোপীয় আর কোলাহলমুখর, রক্ষণশীল এশিয় সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র।ইস্তানবুল নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত অভূত;পূর্ব সব নির্মাণশৈলী, সুউচ্চ তাদের মিনারেটগুলো, বিশালকায় তাদের সুগোল ডোমগুলো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় নীল আর লালের আবছায়া ঢেকে আছে অনুপম এই স্থাপত্যগুলোকে। আয়া সোফিয়া কিংবা ব্লু মস্ক যাদের নাম।
ইস্তানবুলের সাথে যার যোগাযোগ হয়ত সরাসরি নেই, সেটি হল আধুনিক তুরস্কের স্থপতি কামাল আতার্তুক, যার কারণে ধর্মীয় গোঁড়া অটোম্যান তুরস্ক হয়ে উঠতে পেরেছিল ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক তুরস্কে। সেই কৈশোরের নায়কের দেশে একদিন গিয়ে এগলি ওগলি ঘুরে গ্রীক, রোমান, অটোম্যানদের রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নের পাশে বসে দু’দণ্ড জিরোতে পারেন।
দু’হাজার বর্গমাইলের চেয়ে বড় এই মহানগরীর দশটি দ্রষ্টব্য স্থানেও যাওয়া সম্ভবপর ছিলনা। আর ইউরোপের সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে যেহেতু ঘোষিত হয়েছে এই শহরের নাম, সুতরাং গ্রীষ্মের ইস্তানবুল কোন অংশেই প্যারিস বা লন্ডনের চেয়ে কম নয়। ইস্তানবুল নগরীর সাড়ে তের মিলিয়ন মানুষের মিলনমেলায় যোগ দিতে আসে এই সময় সারা দুনিয়া থেকে লাখে লাখে পর্যটক।
ইস্তানবুল নগরীর ইউরোপীয় অংশটাই মূলতঃ এর প্রধান আকর্ষণ।
এখানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ঐতিহাসিক এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যগুলো। বসফরাসের পাড় ধরে একে একে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সবগুলো ট্রাম, মেট্রোলাইন, পর্যটকের দল মোটামুটি যে বিশাল অঞ্চলটার দিকে ধাবমান তার নাম ‘সুলতান আহমেদ’। এখানেই একটু পরপর দেখা মেলে আয়া সোফিয়া, মিউজিয়াম, ব্লু-মস্ক, তোপকাপি প্যালেস, হারেম, সুলেইমানিয়া মস্ক, ইউনিভার্সিটি, গ্র্যান্ড বাজার, ঈজিপ্সিয়ান ওবেলিস্ক, আন্ডারগ্রাউণ্ড ব্যাসিলিকাসহ শত শত দর্শণীয় স্থান।
আয়া সোফিয়া /হাজিয়া সাফিয়া
যেকোন একটাতে ঢুকে পড়লেই দিনের অর্ধেকটা সেখানে ঘুরে ফিরে কাটিয়ে দেয়া যায় কারণ প্রতিটা জায়গার সাথে জড়িয়ে আছে ইতিহাস। ইস্তানবুলকে আক্ষরিক অর্থে মসজিদের শহর বললেও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবেনা।
এই শহরে আপনাকে আপ্যায়ণ করা হবে তাদের ট্র্যাডিশনাল টার্কিশ মেন্যু দিয়ে। যেমন ধরুন কুনাফা, বাকলাভা, সুগার কিউব দিয়ে বানানো চা।
সুলতান আহমেদ স্কয়ারের কাছেই ইস্তানবুলর সব বিখ্যাত জায়গা রয়েছে। যেমন ব্লু মস্ক, হাজিয়া সোফিয়া, হিপোড্রম আর টপকাপি প্যালেস। একসময়ের কনস্ট্যান্টিনোপল হিপোড্রমকেই সবাই এখন সুলতান আহমেদ স্কয়ার নাম ডাকে। ব্লু মস্কে ঢুকতে গেলে আপনাকে আগে টিকেট কেটে নিতে হবে। যদিও এই মসজিদ এর নাম ব্লু মস্ক কিন্তু বাইরে থেকে নীল রঙের আবার ছিটেফোঁটাও আপনি দেখে না পেয়ে নিরাশ হবেন না কিন্তু!
ভেতরে গিয়ে টাইলসের নীল রঙ আর বাইরের আলো মিলে নীলাভ আভার দেখা পাবেন। এখানে সব মিলিয়ে নয়টি গম্বুজ- আটটি ছোট, একটি বড়; সঙ্গে ছয়টি মিনার। শুধু নামাজের সময় বাদে অন্য সময় যাওয়া যায়। স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের মসজিদের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এই সুলতান আহমেদ স্কয়ারে আগেও অসংখ্য মানুষের ভিড় জমতো। আর এখন চোখ জুড়ানো স্থাপত্যশৈলী, চমৎকার আবহাওয়া আর সুন্দর পরিবেশের জন্য সব সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। ব্লু মস্কের উল্টো দিকে তাকালে হাজিয়া সোফিয়া বা আয়া সোফিয়া। কথিত আছে, এটি গির্জা ছিল কনস্ট্যান্টিনোপলের আমলে। অটোমানরা ক্ষমতায় আসার পরে এটিকে মসজিদের রূপ দেয়। পরে কামাল আতাতুর্ক এই মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। ভেতরে ঢুকলে বিভিন্ন রকমের মূর্তি, ছবি আর চিত্রকর্ম দেখতে পাবেন। একই সঙ্গে ভেতরে ইসলামের ইতিহাস, যিশু ও মেরির ছবিরও দেখা মিলবে।
অটোমান সুলতানদের সময়ে তৈরি হলেও বাইজানটাইন সাম্রাজ্য থেকে এর ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। জায়গাটার উচ্চতা বেশি, তাই এখান থেকে তাকালেই বসফরাস প্রণালি দেখা যায়। কাছেই গোল্ডেন হর্ন আর সি অব মারমারা। বিশাল এলাকাজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা টপকাপি প্যালেসের দিকে তাকালে একটা ছোটখাটো শহরের মতো মনে হয়।
সব মিলিয়ে তিনটি কোর্ট ইয়ার্ড আছে, এর দুটিতে সবাই যেতে পারত আর একটিতে শুধু সুলতানের কাছের লোকজন ঢুকতে পারতেন। একটা জায়গায় সুলতানেরা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সম্পদ এনেছিলেন, সেগুলো দেখতে পাওয়া যায়। এর মাঝে হীরা, সোনা, মুক্তা, চুনি, পান্না- সবই রয়েছে।
এখানে আরও দেখতে পাবেন বিভিন্ন সাইজের কাফতান। পাথর বসানো বড় বড় তলোয়ার দেয়ালে ঝোলানো। পৃথিবীর চতুর্থ বড় হীরার দেখা পাওয়া যাবে পরের ঘরটিতে।
শোনা যায়, এটা নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মায়ের হীরা ছিল। চতুর্থ ঘরটিতে সুলতান মাহমুদের সিংহাসন, এটিও দামি দামি পাথরখচিত।
এখানে একটি ঘরে মুহাম্মদ (সা.)-এর তীর, ধনুক, দাড়ি, চুল ও দাঁত রাখা আছে।
এ ছাড়া মুসা (আ.)-এর লাঠি, আলী (রা.)-এর জামা, কাবা শরিফের চাবি এসব মূল্যবান জিনিসপত্র ও দেখতে পাবেন।
এখানে না এলে ধারণাও করতে পারবেন না যে কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে। জানা যায়, এটি তৈরি হয়েছিল পনেরো শতকের দিকে সুলতান মাহমুদের আমলে। এমাথা-ওমাথা হিসাব করলে প্রায় ৬০টি গলি আর ১৫০০-এর কাছাকাছি দোকান।হাজারো রকমের সওদাপাতির পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানীরা এখানে।
অধিকাংশই স্যুভনিরের দোকান। ঝাড়বাতি, সিরামিকের তৈজসপত্র, ব্যাগ, কাপড়, মসলাপাতি, আনাজ, তুর্কি টুপি, ছবি- কী নেই এখানে! বিভিন্ন মানের কার্পেট, চামড়ার কোট, পোর্সেলিনের বাসনকোসন, রকমারি জুতা, রংবেরঙের বাতি- কী নেই! তবে কিনতে হলে দরদাম করতে হয়।
‘তুর্কি নাচন’ বলে যে কথাটা শুনেছেন তা ছবিতে দেখবেনঢের। লম্বা একটা আলখাল্লা, মাথায় ফেজ টুপি পড়ে দু’হাত বিশেষ ভঙ্গিমায় শূন্যে তুলে অধ্যাত্মবাদী সুফিরা চরকির মত ঘুরে ঘুরে বলে ‘আনাল হক’। এটাই তুর্কি নাচন। তবে নাচের এই আয়োজন এখন আর শুধুমাত্র ঈশ্বরকে ডেকে আনার জন্যই করা হয়না, নগদ-নারায়নকে ডেকে আনাটাই মনে হবে এখন এই নাচের প্রধানতম উদ্দেশ্য। এখানে ওখানে প্রায়শঃই দেখা মেলে সুবেশী ছাত্ররা বিজ্ঞাপণ বিতরণ করছে, ‘ আমাদের শোতে আসুন, আমরাই ইস্তানবুলের শ্রেষ্ঠ সুফি নাচ দেখিয়ে থাকি, ইত্যাদি ইত্যাদি।’ আলো আঁধারিতে ঢাকা গ্র্যান্ড বাজার যেন একটা গোলক ধাঁধা। যে পথ দিয়েই যান না কেন বেরুবার সময় দেখবেন এসে পড়েছেন অন্য একটা পথে।
যা ইউরোপ আর এশিয়াকে দুই ভাগ করে রেখেছে। এখানে ভ্রমণের জন্য অসংখ্য বেসরকারি ট্যুর অপারেটর আছে, যারা সবকিছু করে দেয়। তবে মূল্য চড়া, চল্লিশ থেকে কয়েক শ ইউরো নিতে পারে। ‘সেহির হাটলারি ফেরি’ এখানে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করে। সুলতান আহমেদ থেকে জায়গাটা খুব দূরে নয়, তবে ট্রামে করে ‘এমিননো’ চলে গেলে ফেরির টার্মিনাল পেতে সুবিধা হয়। ডাবল ওয়ে বা ওয়ান ওয়ে টিকিট নেয়া যায়। মাঝপথে কোথাও নেমে তুরস্কের ছবির মতো গ্রামে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ানো যায়। ফেরার সময় ফেরিতে আবার উঠে গেলেই হয়। সকাল ১০.৩৫-এ ছেড়ে বেলা তিনটায় ফেরত চলে আসে। যেতে যেতে চোখে পর্বে দুপাশের ছোট-বড় পাহাড়, পাশেই সবুজ মাঠ আর দুর্গ।
লঞ্চের হালকা দুলুনি, সন্ধ্যের দিকে গড়িয়ে যাওয়া বিকেলের সোনালী আলো, ওপারের এশিয়া, বসফরাসের বোতল-সবুজ রঙ এসব দেখতে দেখতে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ লাগে গায়ে। ‘আয়া সোফিয়া’র ভেতরে ঢুকে যে অনুভূতি হবে তা ফিরে আসবে আবার। তখন গায়ে চিমটি কেটে দেখে নিতে ইচ্ছে করবে সত্যিই আপনি আছেন কিনা বসফরাসের উপরে।
এসব উল্টো-পাল্টা ভাবতে ভাবতেই দেখবেন ইউরোপে এশিয়ায় নেমে গেছে সন্ধ্যা। দু’পারের অজস্র দালানগুলোতে জ্বলে উঠেছে হলুদ, লাল, নীল, সাদা বাতি। বসফরাসের ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে আসতে থাকে রেস্তোরাঁ আর পানশালাগুলোর কোলাহল। মাঝদরিয়া থেকে দেখা যায় ঝালর-পরা নৃত্যশিল্পীর মত দাঁড়িয়ে আছে ‘ আয়া সোফিয়া’রা।
আরও একটু পর নজরে আসে পাহাড়ের উপর থেকে প্রণালীর উপর হলুদ চোখে তাকিয়ে থাকা পনেরশ শতকে নির্মিত দূর্গ ‘রুমেলি হিসার’। তার সাথে লাগানো ‘রুমেলি প্রাসাদ’।আর একটু এগুলেই দেখতে পাবেন নোনা জল এসে তার হাত বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ‘দোলমাবাসে প্রাসাদ’কে।
সন্ধ্যার আলোয় সেজে ওঠা কোন অপ্সরী যেন বসফরাসের জলে পড়া তার দীর্ঘ ছায়া দেখছে একমনে। আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পাবেন দু’টো মহাদেশকে এক করে করে দেওয়া সেতুদ্বয়ের প্রথমটিকে।বসফরাস ব্রীজ বা বোগাযিসি কোপরুসু। তার গায়ে আলোর ফুল ফুটে আছে হরেক রঙের। কখনও কখনও মনে হচ্ছিল বর্ণিল কতগুলো জোনাকী কিছু পরপর উড়ে গিয়ে বসছে সেতুর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
প্রতিক্ষণ/এডি/তাজিন