এক বিশাল মসজিদ যা কাদামাটির তৈরি
প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ
মালির কেন্দ্রে অবস্থিত জেনে শহরটি ৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা সাব-সাহারা আফ্রিকার প্রাচীণতম শহরগুলোর একটি। এক সময় নাইজার নদীর ব-দ্বীপে অবস্থিত জেনে শহরটি লবণ, সোনা, দাস প্রভৃতি বিক্রয়ে উৎসাহী বণিকদের আনাগোণার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। অনেক বছর ধরে জেনে ইসলামি পান্ডিত্যের কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত ছিল। এর মার্কেট চত্বর এখনো সুন্দর একটি মসজিদ দ্বারা সজ্জিত। এই মসজিদটি “দ্যা গ্রেট মস্ক অব জেনে” নামে পরিচিত যা ১৯০৭ সালে নির্মিত হয়েছে।
অনেক স্থপতিই একে সুদানো-সাহেলিয়ান স্থাপত্যশৈলীর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেন যা নিশ্চিতরূপেই ইসলামি স্থাপত্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এছাড়া এই মসজিদটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মাটি দ্বারা নির্মিত ভবন। এই এলাকায় আরেকটি পুরাতন মসজিদ রয়েছে যা ১৩শ শতাব্দীর দিকে নির্মিত। কিন্তু উনিশ শতকের দিকে মসজিদটি অব্যবহার্য হয়ে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং হাজার হাজার সোয়ালোদের হাতে চলে যায়, যেখানে তারা বাসা তৈরি করে। যখন টুকুলুর যুদ্ধের সময় সেকু আমাদু জেনে দখন করেন, তখন তিনি মসজিদের এই দুরবস্থা অপছন্দ করেন এবং এটি বন্ধ করে দিয়ে এর কাছেই আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর ১৮৯৩ এর এপ্রিলে যখন লুইস আর্চিনান্দের ফরাসি বাহিনী জেনে দখল করে, আর্চিনান্দ সেকু আমাদুর মসজিদটি ধ্বংস করে দেন এবং সেখানে একটি স্কুল তৈরি করেন। কিন্তু আসল মসজিদটিকে তিনি বর্তমান রূপে পুনঃনির্মান করেন।
গ্রেট মস্কের দেয়ালগুলো সূর্যরশ্নি দ্বারা পোড়া মাটির ইট দ্বারা তৈরি যা ফেরে নামে পরিচিত। এই মাটি চুন, বালি ও পানির মিশ্রণের উপর ভিত্তি করে তৈরি, এবং মসজিদটি মাটির প্লাস্টার দ্বারা সজ্জিত, যার ফলে ভবনটি মসৃন, স্থাপত্যশৈলীমন্ডিত চেহারা পেয়েছে। ভবনের দেয়ালগুলো ৪১ সে.মি. থেকে ৬১ সে.মি. পর্যন্ত পুরু। এছাড়া অসংখ্য তালগাছের শাখা ভবনটিতে অন্তর্ভূক্ত যা আদ্রতা এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে ভবনটিতে ফাটল ধরার হাত থেকে রক্ষা করে। দেয়ালগুলো দিনের বেলা তাপমাত্রা বাইরে বের করেদেয় এবং রাতের জন্য মসজিদটিকে গরম রাখার মতো যথেষ্ট তাপমাত্রা সঞ্চয় করে রাখে।
মসজিদের ছাদে লাগানো পানি নিষ্কাশনের নালীটি সিরামিক পাইপ দ্বারা তৈরি, যা ছাদের কিনারার বাড়তি অংশ, এটি ছাদ থেকে সরাসরি ড্রেনেজ সিস্টেম হিসেবে কাজ করে এবং দেয়ালের বাইরে পানি নিষ্কাশন করে।
মসজিদটিকে বনি নদীর বন্যাজনিত কারণে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ভূমি থেকে ৩ মিটার উঁচুতে নির্মাণ করা হয়েছে। স্তম্ভ দ্বারা সজ্জিত ৬টি সিঁড়ির সেট মসজিদের প্রবেশদ্বারে নিয়ে যায়। মসজিদটির বার্ষিক সংস্কার কাজ একটি উৎসবের মতো এবং পুরো জেনের অধিবাসীরাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী এতে অংশ নেয়। উৎসবের প্রথম দিনগুলোতে গর্তের মধ্যে প্লাস্টার প্রস্তুত করা হয়। এতে কয়েকদিন সময় লাগে কিন্তু নিয়মিতভাবে একে নাড়তে হয়। এই দায়িত্বটি সাধারণত কিশোর-তরুনদের উপর দেওয়া হয়। পুরুষেরা মসজিদের তাল কাঠের তৈরি মই ও রাজমিস্ত্রিদের ভারার উপর ওঠে এবং তৈলাক্ত ও আঠালো এক রকম পদার্থ মসজিদের গায়ে প্লাস্টার করে। উৎসবের শুরুতে একটি দৌঁড় প্রতিযোগিতা হয় এটা দেখার জন্য যে কে প্রথমে মসজিদে প্লাস্টার করবে। নারী এবং কিশোরীরা গর্তের এবং কর্মীদের কাছে উৎসবের আগে পানি পৌঁছে দেন। বয়স্ক ব্যক্তিরা মার্কেট চত্বরে বসে উৎসবের পুরো বিষয়টি উপভোগ করেন।
এই মসজিদে আগে অমুসলিমদের প্রবেশাধিকার ছিল কিন্তু ১৯৯৬ সালে ফ্রেঞ্চ ভোগ ম্যাগাজিন এই মসজিদের ভেতর ফটোশুট করার অনুমতি পায় এবং নারী মডেলদের অর্ধনগ্ন ছবি তোলা হয়। এতে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা ক্রুদ্ধ ও আতঙ্কিত হন এবং এর পর থেকে মসজিদটিতে সকল অমুসলিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
“দ্যা গ্রেট মস্ক”সহ জেনের ঐতিহাসিক এলাকাকে ইউনেস্কো ১৯৮৮ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও এর চাইতে পুরনো অনেক মসজিদ রয়েছে, কিন্তু তারপরও জেনে শহর এবং সমগ্র মালির সবচাইতে বিখ্যাত মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি এই মসজিদটি।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া