ওরা কি আলোর বিপরীতে হাটছে না!
ফজলুর রহমান, প্রতিক্ষণ ডট কম
ওই চোখ জোড়া খুব সুন্দর। মায়াময়। ওই দেহে বাহারি এক পোশাক খন্ড। পরিপাটি সাজানো তাকে। তার চলনে অপূর্ব আভিজাত্য।
তাকে ঘিরে এক টুকরো আনন্দ যাত্রা। ওই যাত্রার শুরুতে তাকে রাখা। বাকিরা অনুসরণে।
বাকিদের মাঝে একদল আবার বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত। চারজনের কাঁধ থেকে ঝোলানো ঢোল। দুই হাতে পড়লে ঢোলের বাড়ি। অবিরাম। ছন্দ মিলিয়ে।
তিনজেন হাতে তিন কিসিমের বাঁশি। কখনো সানাইয়ের সুর। কখনো আরোহন বা অবরোহন। তালে তাল মিলিয়ে। দুই জনের হাতে আরো দুটি যন্ত্রানুষঙ্গ। কেবল একজনের হাতে একটি লাঠি। যে জন লাঠি হাতে সেই নেতা। তার লাঠির চলাচলে বাকিরা মেতেছে। লাঠি যেভাবে ঘুরে বাদ্যও সেভাবে বাজে।
সাথে আছে আরো কয়েকজন। দুয়েকজন বাঁশি বাজিয়ে পথ পরিষ্কারে সচেষ্ট। কারো মাঝে মৃদু নাচ। কারো মাঝে অদ্ভুত সাজ। কয়েকজনের পোশাকও একটা আলাদা বার্তা হয়ে আছে। কি উপলক্ষে, কোথায় যাওয়া-সেই বার্তা। লোকের মুখে রটে যাওয়ার উদ্দশ্যে হাসিল হচ্ছে। বেশ ভালোভাবেই হচ্ছে। কয়েক কিলোমিটার ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অবশেষে কাঙ্খিত মঞ্জিলে।
যেখানে আগে থেকেই সাজানো এক উৎসব(!) উপলক্ষ। কায়দা করে বানানো তোরণ পেরিয়ে উপস্থিত এই যাত্রা বহর। এই আগমনের ধ্বনি পেয়ে আগেই বরণে প্রস্তুত ছিলেন কয়েকজন।
সোনালি কাবিনের কবি আল মাহমুদ যেমন বলেছিলেন-
‘বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।’
কিছুটা তেমন ভাব। তবে সবটা নয়।
সবটা ওই কাব্য লাইন জোড়ার সাথে না যাওয়ার কারণ অনেক। একটি কারণ-এখানে ‘গাঙের ঢেউয়ের মতো’ মৃদু শব্দ নেই। আছে দরিয়া পাড়ে শোনা শব্দের মতো বাদ্যে বাজনা। সাথে যোগ দিয়েছে সাউন্ড সিস্টেমের উচ্চ কোরাস। তবে সবচেয়ে বড় কারণ- এখানে কবিতায় চিত্রিত বধূ নেই। আছে কেবল একটি গরু।
গায়ে তেল মাখানো নাদুস-নুদুস একটি ষাড় মাত্র! যাকে আনা হয়েছে একটি ওরশ উপলক্ষে। রাখা হয়েছে মাজার কমপ্লেক্সে। সামিয়ানার নিচে। বড়ই আদরে। এই দামী প্রাণীটিকে ওই রাতেই জবাই করে খাবার বানানো হবে। ভূরিভোজে মেতে উঠবেন যারা পরম যতনে নিয়ে এসেছিলেন তারাও।
আচ্ছা, এই সব দৃশ্য কি ম্রো উপজাতির গো-হত্যা উৎসবকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না! বান্দরবানের টংগাবতী ইউনিয়নের ম্রো পাড়ায় চলে এই গো-হত্যা উৎসব। অতি প্রাচীনকালের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী গো-হত্যার প্রচলিত বিশ্বাস ও ম্রো উপজাতির আদি উপাখ্যান থেকে জানা যায়, সৃষ্টিকর্তা যখন প্রত্যেক জাতির উন্নয়নের জন্য নিজস্ব অক্ষর বা বর্ণমালা প্রদান করতে ধরণীতে নেমে আসেন, তখন সব জাতি উপস্থিত থাকলেও ম্রো জাতি ছিল না।
তারা সেদিন আমোদ-প্রমোদে ব্যস্ত থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করেই দিন কাটায়। সৃষ্টিকর্তা গরুকে দূত হিসেবে ডুমুরপাতায় লেখা ম্রো ভাষার বর্ণমালা পাঠান। পথিমধ্যে ভীষণ ক্ষুধা পেলে গরুটি ডুমুর গাছের পাতাসহ ম্রোদের অক্ষরগুলো খেয়ে ফেলে। পরে বিধাতার কাছে ম্রোরা জানতে চাইলে তাদের বলেন, ‘তোমরা নাচ, গান, আনন্দ-উল্লাসের মধ্যদিয়ে গরু হত্যা কর, যাতে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করা যায়।’
এরইপ্রেক্ষিতে একটি গরুকে হেডম্যানের উঠানে বাঁশ দিয়ে তৈরি করা একটি ছোট্ট ঘেরার মধ্যে আটকে রাখা হয়।
তার উপরে বাঁশের আঁশ তুলে তৈরি করা একটি বিশাল রঙিন চাটাই থাকে।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় চাটাইয়ের নিচে গরুকে ঘিরে ম্রোদের নিজস্ব ধারায় তৈরি বাঁশের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তরুণ-তরুণীদের নৃত্য।
এভাবে একেকটি দল রাতব্যাপী পালা করে নাচতে থাকে। পরদিন ভোরে হেডম্যান ভোর ৭টার দিকে একটি বিষ মাখানো সেল দিয়ে পরপর তিনবার আঘাত করে গরুটিকে হত্যা করে।
এরপর শুরু হয় ভাগ-বাটোয়ারা ও রান্না-বান্নার আয়োজন এবং নাচ-গান। এভাবেই সারাদিন চলতে থাকে উৎসব।
এই উপজাতির সাথে একটি বড় জাতিসত্ত্বাকে মেলানোর প্রচেষ্টা এটি নয়। যেটি এখনো সবখানে ছড়ায়নি, কেবল অতি ক্ষুদ্র অংশের অতি উৎসাহ হয়ে আছে। শুধু বলতে চাওয়া প্রক্রিয়াটির অশালীন উপস্থিতি নিয়ে, যার কোন কোন নির্দেশনা নেই কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াসেও। তবে কেন এই অনাচারের অপচেষ্টা?
জীবন সায়াহ্নে মহানবী (সা:) শেষ যে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল-‘‘ ইহুদি-খ্রিস্টানরা নবীগণের কবরগুলোকে সিজদাগাহ বানিয়েছে। ইহুদি-খ্রিস্টানদের ন্যায় আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার কবরকে সেজদাগাহ বানিয়ো না। (বুখারি, ৪৪৪৩)।’’ সবক্ষেত্রে নয়, তবে এখন কিছু জায়গায় দেখা যায় কবর কেবল সেজদাগাহ নয়, কিছু বিকৃত আচারও জড়িয়ে গেছে তাতে।
পাপের বিভীষিকাময়, অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পৃথিবী। হেদায়েতের আলোয় আলোকিত করে ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত আরব উপদ্বীপ থেকেই হয় নবুয়তের সূর্যোদয়। আর সেই আলোকরশ্মির ঝলকে গোটা দুনিয়াই দীপ্তিময়। মানবতা পায় হারানো বসন্ত। বসন্ত ফিরে পায় তার স্নিগ্ধতা। কুফর-শিরকে নিমজ্জিত পাষন্ড আত্মায় তাওহিদের নির্মল পানি সঞ্চারিত হয়।
দিকভ্রান্ত বিবেক পায় আলোর পথ। যে মানুষগুলো ছিল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম- পশুসম, তারাই পরিণত হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সোনালি সত্তায়…। উপরে শুরুতে বর্ণিত দৃশ্যমালা কি সেই হেদায়েতের আলো ধারণ করছে, না উল্টো পথে চলছে?
ফজলুর/প্রতিক্ষণ/এডি/রাজু