কাকন বিবিদের অশ্রুর কোন মূল্য নেই !!
প্রতিক্ষণ ডেস্ক:
মুক্তিযুদ্ধ জয়ী আটপৌড়ে এক গ্রাম্য পাহাড়ি খাসিয়া নারী। নিভৃত জীবনযাপন শেষে মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পর তিনি অন্ধকার ভেদ করে প্রচারণায় আলোয় আসেন। আদিবাসী গ্রাম্য এই নারী সরাসরি অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবনবাজি রেখে বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন স্বাধীনতাযুদ্ধে। যুদ্ধকালীন সময়ে তার বীরোত্বপূর্ণ অবদান এখনো সহযোদ্ধাদের মুখে শোনা যায়। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্য অংশগ্রহণকারী এই নারী যুদ্ধকালীন সময়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করলেও এখন তিনি জীবনযুদ্ধে পরাজিত। স্বাধীনতার ২৫ বছর পর সরকার কতৃক বীর প্রতীক ঘোষিত এই (আদিবাসী) বাঙ্গালি নারী কাকন বিবি দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন।
বাঙ্গালি জাতির যুদ্ধজয়ী এই মাতা সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে বর্তমানে বসবাস করছেন। এক সময়ের চঞ্চল পাহাড়ি এই মেয়েটির যৌবনের সেই জৌলুস নেই। নেই চঞ্চলতা। সর্বণ অভাবের চাবুক তাড়া খেয়ে এখন নিশ্চল বসে আছেন নিজের শূন্য ভিটায়। কাকন বিবি মূলত খাসিয়া স¤প্রদায়ের লোক। তার মূল বাড়ি ছিল ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামে। ১৯৭০ সালে তার বিয়ে হয় দিরাই উপজেলার জনৈক শহীদ আলীর সাথে। বিয়ের পর তার নাম হয় নুরজাহান বেগম।
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ তার এক কন্যা সন্তান জন্ম হয়। কন্যা সন্তান জন্ম দেবার কারণে স্বামী শহিদ আলীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য দেখা দেয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে মৌখিক ছাড়াছাড়ি হয়। পরবর্তীতে এপ্রিল মাসে ইপিআর সৈনিক মজিদ খাঁনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ওই সৈনিক তখন সিলেট ইপিআর ক্যাম্পে চাকরিরত ছিলেন। স্বামীর সাথে দুই মাস সিলেটে বসবাসের পর কাকন বিবি তার পূর্বের স্বামীর বাড়ি থেকে মেয়ে সখিনাকে আনতে যান। মেয়েকে নিয়ে সিলেট আসার পর স্বামী মজিদ খাঁন কে আর খুঁজে পাননি। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার স্বামীকে দোয়ারাবাজার সীমান্ত এলাকার কোন এক ক্যাম্পে বদলী করা হয়েছে।
স্বামীর খোজে কান্ত কাকন বিবি লোকমুখে তার স্বামীর খবর শোনে সিলেট থেকে দোয়ারাবাজার সীমান্তে আসেন। তখন ছিল জুন মাস। পাকবাহিনীর সঙ্গে ওই সীমান্ত অঞ্চলে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছিল। শিশুকন্যা সখিনাকে সীমান্তবর্তী ঝিরাগাও গ্রামে জনৈক শাহীদ আলীর আশ্রয়ে রেখে দোয়ারাবাজারের টেংরাটিলা ক্যাম্পে স্বামীর খোজে বের হন। তখন তার ছিল টগবগে যৌবন। আর এই যৌবনই কাল হয়ে দাড়ায়। পাক বাহিনীর নজর পড়ে তার উপর। নরপিশাচ পাকবাহিনী তাকে আটক করে নিয়ে যায় ব্যাঙ্কারে। ব্যাঙ্কারে রেখে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে।
পাকবাহিনী ও স্থানীয় রাজাকাররা অমানুষিক নির্যাতনের পর তাকে ছেড়ে দেয়। এই ঘটনার পরই বদলে যান কাকন বিবি। প্রতিশোধের নেশায় বিধ্বস্ত মনকে পাথর করে স্বামীর আশা বাদ দিয়ে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠেন। যৌবনের রক্তে আগুন নিয়ে বিভিন্ন বেশে একশনে নেমে পড়েন এক নীরিহ বাঙ্গালি গিন্নি কাকন। শুরু হয় এই নারীর যুদ্ধ জীবন।
জুলাই মাসে তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন দেখা হয় মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর সঙ্গে। রহমত আলী তাকে সেক্টর কমান্ডার লেফট্যানেন্ট কর্ণেল মীর শওকত এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মীর শওকত তার সঙ্গে কথা বলে তাকে বিশ্বস্থ গুপ্তচরের দায়িত্ব দেন। কাকন বিবি সাহসিকতার সাথে গুপ্তচরের কাজ করে সকলের আস্তা অর্জন করেন। তিনি বিভিন্ন বেশে ঘুরে ঘুরে পাক বাহিনীর খবর পৌছে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। আর সেই খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা একশনে নামতেন। এভাবে অনেক সফল অপারেশনের নায়ক এই কাকন বিবি।
গুপ্তচরের কাজ করতে গিয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারে পাকবাহিনীর হাতে আবার ধরা পড়নে কাকন। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে একনাগাড়ে ৭ দিন বিবস্ত্র করে অমানুষিক নির্যাতন চালায় পাক হানাদার-রাজাকার আলবদর। লোহার রড গরম করে তার বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে তাকে ছ্যাক দেয়। তার উপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে পাক বাহিনী অজ্ঞান অবস্থায় মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। কয়েকদিন পর তার জ্ঞান ফিরে এলে মুমুর্ষ অবস্থায় তাঁকে বালাট সাব সেক্টরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা করানোর পর কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার বাংলাবাজার ফিরে আসেন। তার চোখে তখন সব হারানোর আগুন। আর এই প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলীর কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিণ নেন। রহমত আলীর দলে সদস্য হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সমান তালে চলে তার সম্মুখ যুদ্ধ আর গুপ্তচরের কাজ।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে টেংরাটিলায় পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন। সেই যুদ্ধে কয়েকটি গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়। উড়–তে কয়েকটি গুলির ত দাগ এখনও আছে। এই ত এখনো অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ব্যথা জাগিয়ে তোলে। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে চোখের জলে স্বরণ করেন সেই বিধ্বস্থ দিন। টেংরাটিলা যুদ্ধের পর আমবাড়ি, বাংলাবাজার, টেবলাই, বালিউরা, মহব্বতপুর, বেতুরা, দূর্বিনটিলা, আধারটিলা সহ প্রায় ৯টি সম্মুখযুদ্ধে তিনি অস্ত্র সহকারে যুদ্ধ করেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি রহমত আলী সহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সুনামগঞ্জ সিলেট সড়কের জাউয়া ব্রীজ অপারেশনে যান। ব্রীজ অপারেশনে তারা সফল হন। এভাবে অনেক অপারেশনের তিনি সফল হন। আমবাড়ি বাজার যুদ্ধে তার পায়ে গুলি লাগে। সেই গুলির চিহ্ন আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন। উড়–তে সেই তচিহ্ন নিয়ে এখন অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটান।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাকন বিবি দোয়ারা বাজার উপজেলার লীপুর ইউনিয়নের ঝিরাগাঁও গ্রামে জনৈক এক ব্যক্তির কুড়েঘরের বারান্দায় মেয়ে সখিনা সহ আশ্রয় নেন। ৭১-এর এই যোদ্ধা স্বাধীনতার পর লোকচুর অন্তরালে ছিলেন প্রায় দুই যুগ। ১৯৯৬ সালে স্থানীয় এক সাংবাদিকের দৃষ্টিতে পড়লে তাকে নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হয়। কাকন বিবির দুরবস্থা সংবাদপত্রে আসার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাকন বিবিকে এক একর খাস ভূমি প্রদান করেন এবং তাঁকে বীরপ্রতিক উপাধি দেন। এরপর সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান কাকন বিবিকে ঐ জায়গার উপর একটি ছোট কুড়ে ঘর নির্মাণ করে দেন। পরবর্তীতে দৈনিক জনকন্ঠ কাকন বিবিকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়। কয়েক বছর ভালই কেটে ছিল তাঁর।
হঠাৎ করে ২০০৭ সালের প্রথম দিকে জনকন্ঠ কাকন বিবির ভাতা বন্ধ করে দেয়। পুনরায় শুরু হয় দুর্বিষহ জীবন। এখন কাকন বিবি তার অভাবের সঙ্গেই দিনাতিপাত করছেন। কাকন বিবি জানান, তিনি তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে থাকেন। জনকণ্ঠ থেকে প্রাপ্ত ভাতা ২০০৭ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে একাধিকবার দেখা করে বন্ধের কারণ জানতে পারেনি নি তিনি। বয়সের ভারে ন্যুজ কাকন জানান, রোগে শোকে ভোগে এখন তিনি কাতর। প্রায়ই বিছানায় পড়ে থাকেন। নিয়মিত টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
এই দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি নিজের স্বর্বস্বটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন সেই কাঁকন বিবির এখনও নিরন্তর অশ্রু ঝরে। আমরা গর্ব সহকারে স্মৃতিসৌধে যাই, ফুল দেই। কিন্তু কাকন বিবিদের মনে রাখার প্রয়োজনবোধ করিনা !!
প্রতিক্ষণ/এডি/রাকিব