কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের নানা দিক ও বিশেষ করে এ বিপ্লবের মহানায়ক ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং মহান সঙ্গীদের শাহাদতসহ তাঁদের নানা ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক শোক-গাঁথা বা মর্সিয়া, কবিতা ও শোকের সঙ্গীত। এখানে নজরুলের বিখ্যাত ‘মহররম’ কবিতাটি দেয়া হলো ।
“নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া
আম্মা! লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।”
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে।
রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া-দামেসকে
“জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?”
‘হায় হায় হোসেনা’, ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদেরো পঞ্জায়।’
উন্মাদ দুলদুল ছুটে ফেরে মদিনায়,
আলিজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়।
মা ফাতিমা আসমান কাঁদে খুলি কেশপাশ,
বেটাদের লাশ নিয়ে বধূদের শ্বেত বাস!
রণে যায় কাসিম ঐ দু’ঘড়ির নওশা;
মেহেদীর রঙটুকু মুছে গেল সহসা।
‘হায় হায়’ কাঁদে বায় পূরবী ও সখিনা
‘কঙ্কন পঁইচি খুলে ফেল সকীনা!’
কাঁদে কে রে কোলে করে কাসিমের কাটা-শির?
খান খান খুন হয়ে করে বুক-ফাটা নীর।
কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,
বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা ও ক্ষুদ্র!
গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে কচি মেয়ে ফাতিমা,
‘আম্মা গো, পানি দাও, ফেটে গেল ছাতি, মা!”
নিয়া তৃষা সাহারার দুনিয়ার হাহাকার
কারবালা-প্রান্তরে কাঁদে বাছা আহা কার।”
দুই হাত কাটা তবু শের-নর আব্বাস,
পানি আনে মুখে, হাঁকে দুশ্ মনও ‘সাব্বাস্’ !
দ্রিম্ দ্রিম্ বাজে ঘন দুন্দুভি দামামা,
হাঁকে বীর “শির দেগা,নেহি দেগা আমামা !
কলিজা কাবাব সম ভূনে মরু রোদ্দুর
খাঁ খাঁ করে কারবালা নাই পানি খজ্জুর
মার স্তনে দুধ নাই বাচ্চারা তড়পায়
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়টায়
দাও দাও জ্বলে শিরে কারবালা ভাস্কর
কাঁদে বানু পানি দেও মরে যাদু আসগর
পেলনাতো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন
ডাকে মাতা পানি দেব ফিরে আয় বাছা শোন –
পুত্র হীনা আর বিধবার কাঁদনে
ছিড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাধনে
তাম্বুতে সজ্জায় কাঁদে একা জয়নাল
দাদা তেরি ঘর কিয়া বরবাদ পয়মাল
‘হাইদরী-হাঁক-হাঁকি দুলদুল-আসওয়ার
শম্ শের চম্ কায় দুষমনে ত্রাস্ বার ।
খ’সে পড়ে হাত হ’তে শত্রুর তরবার,
ভাসে চোখে কিয়ামতে আল্লার দরবার !
নিঃশেষ দুষমন্ ; ও কে রণ-শ্রান্ত
ফোরাতের নীরে নেমে মুছে আঁখি-প্রান্ত ?
কোথা বাবা আস্ গর? শোকে বুক-ঝাঁঝরা
পানি দেখে হোসেনের ফেটে যায় পাঁজরা !
ধুঁকে ম’লো আহা তবু পানি এক কাৎরা
দেয় নি রে বাছাদের মুখে কম্ জাত্ রা !
অঞ্জলি হ’তে পানি প’ড়ে গেল ঝর্-ঝর্,
লুটে ভূমে মহাবাহু খঞ্জর-জর্জ্জর !
হল্ কুমে হানে তেগ ও কে ব’সে ছাতিতে ?
–আফ্ তাব ছেয়ে নিল আঁধিয়ারা রাতিতে ।
‘আস্ মান’ ভ’রে গেল গোধূলিতে দুপুরে,
বেটাদের লোহু-রাঙা পিরাহান-হাতে,আহ্-
‘আরশের’ পায়া ধরে,কাঁদে মাতা ফাতেমা,
“এয়্ খোদা বদ্ লাতে বেটাদের রক্তের
মার্জ্জনা কর গোনাহ পাপী কম্ বখতের ।”
‘কত মহররম এলো, গেল চলে বহু কাল
ভুলি নি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল!
মুসলিম! তোরা আজ ‘জয়নাল আবেদীন’
‘ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা’ কেঁদে তাই যাবে দিন।
ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা,
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।
উষ্ণীষ কোরানের হাতে তেগ আরবীর
দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির,
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা,
শমশের হাতে নাও, বাঁধো শিরে আমামা!
বেজেছে নাকাড়া, হাঁকে নকীবের তূর্য,
হুশিয়ার মুসলিম ডুবে তব সূর্য।
জাগো, ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দরী হাঁক,
শহীদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক!
নওশার সাজ নাও খুন-খচা আস্তীন,
ময়দানে লুটাতে রে লাশ এই খাস দিন!
হাসানের মতো পিব পিয়ালা সে জহরের,
হোসেনের মতো নিব বুকে ছুরি কহরের,
আসগর সম দিব বাচ্চারে কোরবান
জালিমের দাদ নেবো, দেব আজ গোর জান!
সকীনার শ্বেত বাস দবো মাতা-কন্যায়,
কাসিমের মতো দেবো জান রুধি অন্যায়।
মহররম! কারবালা! কাঁদো ‘হায় হোসানা’!
দেখো মরু-সূর্য এ খুন যেন শোষে না!”
প্রতিক্ষণ/ এডি/ শাআ