কাতার বিশ্বকাপ : ফিলিস্তিনিরা যেভাবে হারিয়ে দিল ইসরাইলকে 

প্রকাশঃ ডিসেম্বর ১৪, ২০২২ সময়ঃ ১১:১৩ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:১৪ অপরাহ্ণ

আন্তর্জাতিকে ডেস্ক

কাতারে ফিফার বিশ্বকাপ ফুটবল এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু এরইমধ্যে বিজয়ীর বেশে হাজির হয়েছে একটি দেশ। নিশ্চিতভাবেই সেই দেশটি হচ্ছে ফিলিস্তিন। তারা জয়ী হয়েছে দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে।

প্রশ্ন হতে পারে, কীভাবে জয়ী হলো, যখন তারা বিশ্বকাপের খেলাতেই অংশ নেয়নি। জবাবে বলা যায়, বিজয়ী দল যেভাবে হাজারো ভক্তের মন জয় করে নেয়, ঠিক একইভাবে বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছে ফিলিস্তিন। যার প্রমাণ স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে ফিলিস্তিনের পক্ষে জয়ধ্বনি। প্রতিটি ম্যাচের প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিটে লাখো-কোটি মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে একটি নাম, ‘ফিলিস্তিন! ফিলিস্তিন’।

স্বাধীনতার সংগ্রাম, বর্ণবাদবিরোধিতা ও উপনিবেশবাদের নিগড় থেকে মুক্তির লড়াইয়ে একাকার যে ভূখণ্ডের নাম–তারই পতাকা জড়িয়ে বিশ্বকাপের গ্যালারিতে হাজির হচ্ছেন ফুটবল ভক্ত-সমর্থকরা। ম্যাচ যে দেশেরই হোক– আরব বিশ্বের প্রথম এ ফুটবল আয়োজনে– গ্যালারিতে ভালোভাবে চোখ রাখলেই নজরে পড়ে ফিলিস্তিনের পতাকা, পতাকার রঙের আর্মব্যান্ড ও ব্রেসলেট।

কান পাতলেই শোনা যায় ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ ধবনি। শুধু স্টেডিয়ামেই নয়, কাতারের রাস্তায় রাস্তায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ফিলিস্তিনেরই জয়ধ্বনি। যা প্রমাণ করে, আরব শাসকরা যতই অবহেলা করুন বা ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠতা বাড়াক না কেন, আরব জনগণ এখনও ফিলিস্তিনের পাশেই আছে।

শুধু আরবরাই নয়, নানা দেশ ও জাতির ফুটবল ভক্তরাও এভাবেই ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন। এসব দেখে যে কারও মনে হবে, বিশ্বকাপে শুধু ৩২ দেশ নয়, উপস্থিত রয়েছে আরও একটি দেশ-ফিলিস্তিন। ল্যাটিন আমেরিকার কিছু গণমাধ্যম ফিলিস্তিনকে কাতার বিশ্বকাপের ‘৩৩তম দল’ বলে অভিহিত করেছে।

কাতারে কেন ফিলিস্তিনের জয়জয়কার

ফিলিস্তিনের জাতীয় ফুটবল দল ভাল ফুটবল খেললেও তারা কখনই বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেয়নি। এবার কাতার বিশ্বকাপেও তারা নেই। তারপরও এই বিশ্বকাপে ফিলিস্তিন চরমভাবে রয়েছে। কিন্তু কেন? এর কারণ বিশ্বকাপ ফুটবল শুধুমাত্র একটা খেলা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। এটা এমন একটি প্রতিযোগিতা যা সারাবিশ্বের মানুষের উপস্থিতি আর অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে মিলনমেলা হয়ে ওঠে। এখানে তারা শুধু ফুটবলের প্রতি তাদের আবেগ প্রকাশ করতেই আসেন না, এটি হয়ে ওঠে মানবজাতির সহমর্মিতার এক আয়োজন।

ফুটবলের ইতিহাসে এটাই প্রথম কোনো বিশ্বকাপ যা কোনো আরব দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও যাতায়াতের সুবিধার কারণে আগের বিশ্বকাপগুলোর তুলনায় এই বিশ্বকাপ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার সাধারণ মানুষকে বেশি বেশি অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ফিলিস্তিন কাতার বিশ্বকাপের মধ্যমণি হয়ে উঠেছে। যা আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যদিয়ে আরবদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। মূলত পশ্চিমা বিশ্বাসঘাতকতা ও উপনিবেশবাদের চূড়ান্ত শিকার ফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি আরব জনগণ বছরের পর বছর ধরে যে সহানুভূতি ও প্রতিশ্রুতি লালন করে আসছে, এই বিশ্বকাপের আসরে তারই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ করছে।

ফিলিস্তিনি ও আরবদের মধ্যকার আত্মিক বন্ধন যে আজও অটুট, তারই প্রমাণ কাতার বিশ্বকাপ আসর। স্বাভাবিকভাবেই কাতার বিশ্বকাপে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে ফিলিস্তিন সমস্যা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আরব জনতার ঐক্যের যোগসূত্র হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিন। ফুটে উঠেছে ফিলিস্তিনিদের স্বাধিকার সংগ্রামে তাদের দৃঢ় সমর্থন।

গ্যালারিতে গ্যালারিতে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার স্লোগান

কাতার বিশ্বকাপের আসরে দর্শক হিসেবে আরবরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্যক্তিগতভাবে তাদের কেউ হয়ত ব্রাজিল দলের সমর্থক, কেউ হয়ত আর্জেন্টিনা দলের ভক্ত। কারও কারও হয়ত পছন্দ বিশ্বকাপে অংশ নেয়া কাতার, সৌদি আরব ও মরক্কোর মতো আরব দেশগুলো। কিন্তু এক জায়গায় এসে তারা সবাই এক। আর সেটা হলো ফিলিস্তিন প্রশ্নে। আর তাইতো স্টেডিয়ামে স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে গ্যালারিতে উড়ছে ফিলিস্তিনি পতাকা। শত কণ্ঠে ভেসে আসছে ফিলিস্তিন মুক্ত করার স্লোগান।

কাতার বিশ্বকাপে আরবদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যে চর্চা তা শুধুমাত্র ফিলিস্তিনে ইসরাইলের অব্যাহত দখলদারিত্বের বিরুদ্ধেই নয়, এটা একইসঙ্গে অত্যাচারী আরব শাসকদের নব্য-উপনিবেশবাদী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও। এটি তাদের নিপীড়ক আরব শাসকদের প্রতি এক প্রকাশ্য ধিক্কার।

কাতার বিশ্বকাপে আরবদের এই জাগরণ এক দশক আগের আরব বিশ্বকে আন্দোলিত করা আরব বসন্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে আন্দোলনে আরব জনতা ফিলিস্তিনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে একইভাবে ফিলিস্তিনি পতাকা উড়িয়েছিল।

সেই আরব বসন্তের মতোই আরও এক বসন্ত হয়ে এসেছে কাতার বিশ্বকাপ। আর তাই বসন্তের উন্মাদনায় মুক্তাকাশে ফিলিস্তিনি পতাকা ওড়াচ্ছেন আরবরা। আর নিজেদের মর্যাদা ও অধিকারের দাবিতে ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করছেন আকাশ-বাতাস।

ঐতিহাসিকভাবেই আরবদের রাজনৈতিক সংগ্রামের কেন্দ্রে চিরকাল দেখা গেছে ফিলিস্তিনের পতাকা। তাই কাতার বিশ্বকাপে এর ব্যতিক্রম হওয়াটাই হতো বিস্ময়কর। ফলে প্রতিটি ম্যাচেই গ্যালারির শোভা বাড়াচ্ছে ফিলিস্তিনি কেতন।

ফিলিস্তিনি কেতন উড়ছেই 

ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে গত ২৬ নভেম্বর তিউনিশিয়া বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ চলাকালে। তারপর একই ধারা ছিল পরের দিনে মরক্কো বনাম বেলজিয়ামের ম্যাচেও। তারপর থেকেই ফিলিস্তিনের পতাকা আন্দোলিত হচ্ছে আরও বেশি বেশি।

তিউনিশিয়া বনাম ফ্রান্সের ম্যাচ চলাকালে ফিলিস্তিনের ঝাণ্ডা নিয়ে গ্যালারি ছেড়ে মাঠে ঢুকে পড়েন তিউনিশয় এক ফ্যান। তিনি স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘ফ্যালেস্তিন’ ‘ফ্যালেস্তিন’ (ফিলিস্তিনের আরবি উচ্চারণ) বলে। পরে তাকে মাঠের বাইরে নিয়ে যায় নিরাপত্তা কর্মীরা।

কানাডাকে হারিয়ে ১৬ দলের নকআউট পর্বে ওঠা নিশ্চিতকারী ম্যাচ শেষে– ফিলিস্তিনের পতাকা ওড়ান মরোক্কোর খেলোয়াড়রা। এরপর তারা স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করেছে।

কাতারের রাজধানী দোহার জনপ্রিয় বাজার ‘সুক ওয়াফিক’-এ এই জয় নেচেগেয়ে উদযাপন করেন মরোক্কোর ফুটবল ভক্তরা। কিন্তু উপযাপনের সঙ্গীত ছিল ফিলিস্তিনের দুঃখ ভারাক্রান্ত জাতীয় সংগীতের পঙক্তিতে।

আরেকটি হৃদয়বিদারক তবে অভিনব ‘প্রতীকী’ সমর্থনও জানান আরবরা। প্রতি ম্যাচের ৪৮ মিনিটের মাথায় উড়েছে ফিলিস্তিনের পতাকা। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের স্লোগান মুখরিত করেছে স্টেডিয়াম। একইসঙ্গে এ ছিল ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’র স্মরণ।

নাকবার আক্ষরিক অর্থ ‘বিপর্যয়’- ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে সে বছর যে শত-সহস্র ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছিল, নিজ ভূমি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল, তাকেই তাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় মহাবিপর্যয় বলে মনে করে ফিলিস্তিনিরা।

শুধু আরবরা নয়, ফিলিস্তিনের জয়গাঁথা মাতিয়েছে ল্যাটিন দর্শকদেরও। ক্যামেরুনের সাথে স্বদেশের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার সময় দোহার মেট্রো স্টেশনে ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ স্লোগান দিতে শোনা গেছে ব্রাজিলের সমর্থকদের।

শুধু ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার সমর্থকরাই নয়, পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফুটবল পাগল মানুষকে দেখা গেছে দোহায়। যারা মুক্ত মনে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়িয়েছেন, আর তাদের মুক্তির আন্দোলনের প্রতি জানিয়েছেন অকৃত্রিম সমর্থন ও অগাধ ভালবাসা।

সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইসরাইলি চেষ্টা বিফল

আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে মরিয়া ইসরাইল। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবে ফিফার নীতি মেনে ইসরাইলি গণমাধ্যম ও তাদের নাগরিকদের কাতার বিশ্বকাপ উপভোগের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

ইসরাইলি সরকার সম্ভবত ভেবেছিল, এই বিশ্বকাপ আসরকে ব্যবহার করে আরব দেশগুলো ও তাদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে। তারা মনে করেছিল, ইসরাইলি উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র মেনে না নেয়ার যে নীতি গত কয়েক দশক ধরে আরবরা ধরে রেখেছে, তা জয় করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটেনি। তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি।

সেটা বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। কাতার বিশ্বকাপে যে দলগুলো খেলছে, তাদের পতাকার বাইরে যে দেশটির পতাকা সবচেয়ে বেশি উড়েছে, যে দেশের নাম সবচেয়ে বেশি শোনা গেছে, সেটা হচ্ছে ফিলিস্তিন।

এমন ডজন ডজন ভাইরাল ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। সেসব ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে, ইসরাইলি সাংবাদিকরা বিভিন্ন দেশের নাগরিক ও ফুটবল ভক্তদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু লেবানিজ, সৌদি, মরক্কান, মিশরীয়, জর্ডানীয়, ইয়েমেনি, কাতারি, তিউনিশীয় ও ফিলিস্তিনি কোনো আরবই ইসরাইলি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেনি। এমনকি জাপানি, ব্রাজিলীয়, ইরানি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক ও ফুটবল ভক্তদের ইসরাইলি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার না দিয়ে এড়িয়ে যেতে দেখা গেছে।

এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, এক ইসরাইলি সাংবাদিককে সৌদি আরবের এক সমর্থক বিনয়ের সঙ্গে বলছেন, ‘দুঃখিত, আপনাকে সাক্ষাৎকার দিতে পারছি না। আপনি এখানে অনাহূত।’ ওই ভক্ত আরও বলেন, ‘এমনকি যদিও এটা কাতার। এটাও আমাদের দেশ। এখানে ইসরাইলের কোনো জায়গা নেই। শুধুই ফিলিস্তিন।’

সূত্র : আল জাজিরা

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G