কোরবানির তাৎপর্য ও শিক্ষা
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
মুসলিম দুনিয়ায় দুটো বড় আনন্দ উৎসব গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালিত হয় যার একটির নাম ঈদুল ফিতর এবং অন্যটির নাম ঈদুল আযহা। ঈদ আসে বিশ্ব মুসলিমের কাছে প্রতি বছর। বিশ্বের একশ ছাপ্পান্ন কোটি মুসলিম নর-নারী ঈদের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ঈদ-উল আযহার অপর নাম কোরবানির ঈদ। কোরবানি এই ঈদের প্রধান উপলক্ষ্য।
কোরবানি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই (হে নবী!) আমি আপনাকে (নিয়ামত পূর্ণ) কাওসার দান করেছি; অতএব, আপনি আপনার ‘রব` এর সন্তুষ্টির জন্যে সালাত কায়েম করুন ও তার নামে কোরবানি করুন।’ (সুরা আল কাওসার)।
রাসূল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করবে না সে যেন ঈদগাহের কাছেও না আসে` (আহমদ ও ইবনে মাযাহ)।
কোরবানি শব্দের অর্থ হচ্ছে, নিকটবর্তী হওয়া বা সান্নিধ্য লাভ করা। আল কোরআনে সুরা আল মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘ইয ক্কাররাবা-ক্কুরবা-নান` অর্থাৎ যখন তার দু‘জনে কোরবানি পেশ করলো বা পশু জবাই করলো, কিংবা জবাই করে ফেলে আসল। সুরা আল কাওসারে বলা হয়েছে, ‘ফাছাল্লি লিরাবিবকা ওয়ানহার` অর্থাৎ অতএব, (হে নবী!) আপনার ‘রব`-এর স্মরণে সালাত আদায় করুন ও তার সন্তুষ্টির জন্যে কোরবানি করুন`। এখানে ‘নাহার` বলতে কোরবানি বোঝানো হয়েছে। আসলে ‘নাহার` শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- নহর, বিশেষ নিয়মে জবাই বা হত্যা করা কিংবা প্রিয় বস্তুকে জবাই বা ত্যাগ করা।
আজ মুসলিম সমাজে কোরবানির যে প্রচলন তা মূলত: মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ) এর দেখানো পথ। ইব্রাহীম (আ.) এর শতবর্ষ বয়সের পর আল্লাহ তাকে যে সন্তান দান করেছিলেন, তিনি আল্লাহতায়ালা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে তার সে কলিজার টুকরা ইসমাইল (আ.) এর কোরবানির সূত্র ধরে আজও কোরবানি প্রচলিত আছে।
ইব্রাহীম (আ.) তার স্ত্রী হাজেরার কলিজার টুকরা ছেলেকে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে কা‘বা ঘরের নিকটবর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে নির্জন স্থানে সামান্য কিছু খেজুর ও এক মসক পানিসহ রেখে আসেন। ইব্রাহীম (আ.) যখন তাদেরকে রেখে স্থান ত্যাগ করছিলেন, তখন হাজেরা প্রশ্ন করছিলেন, আপনি আমাদের এ নির্জন স্থানে রেখে চলে যাচ্ছেন? ইব্রাহীম (আ.) ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। আবারো হাজেরা প্রশ্ন করলেন, এটা কি আল্লাহ্তায়ালার নির্দেশ? ইব্রাহীম আবারও জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ। হাজেরা আল্লাহ্তায়ালার ওপর ভরসা করে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করলেন।
সে সময় কাবা ঘরের তেমন কোন চিহ্ন ছিলো না। হাজেরা ও তার সন্তানের খাদ্য ও পানীয় যখন শেষ হয়ে গেল তখন খাদ্য ও পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। যখন নিরাশ হয়ে ফিরছিলেন তখন একটি আওয়াজ শুনতে পান। হাজেরা বলেন, ‘কে আছ আমি তোমার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, সম্ভব হলে তুমি আমাকে আল্লাহর ওয়াস্তে একটু সাহায্য করো।’ হঠাৎ তিনি শিশু পুত্র ইসমাইল -এর কাছে একজন লোক (ফেরেশতা) দেখতে পেলেন। সে তার পায়ের গোড়ালী অথবা ডানা দ্বারা যমীনে আঘাত করলে অথবা হযরত ইসমাইল -এর কান্নাজনিত পায়ের গোড়ালীর ঘর্ষণে নীচ থেকে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হতে লাগলো। সেই ফোয়ারাই আজ ‘যমযম’ নামে বিশ্ব মুসলিমের কাছে পরিচিত। যে সুপেয় পানীয় হিসেবে পান করে পরিতৃপ্ত হয় মুসলমাগণ।
হাজেরা তার মশক পূর্ণ করে নিলেন আর নিজেও তৃপ্তির সাথে পানি পান করলেন। এতে তার ক্ষুধা নিবারণ হলো ও তার শিশু পুত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় দুধেরও ব্যবস্থা হলো। হাজেরা সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ক্রমাগত ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার কারণে সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ হজ ও ওমরাহ পালনকারীদের জন্যে সাফা মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌড়াদৌড়ি করার বিধান জারি করেছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই ‘সাফা ও মারওয়া` পাহাড় দু`টো আল্লাহতায়ালার নিদর্শন সমূহের অন্যতম, অতএব, যদি তোমাদের মধ্যে কোন লোক হজ বা ওমরাহ আদায় করার এরাদা করে তার জন্যে এই উভয় পাহাড়ের মাঝে ‘সাঈ` করতে হবে। কেননা যদি কোন ব্যক্তি অন্তরে নিষ্ঠার সাথে কোন ভালো কাজ করে তাহলে তারা যেন জেনে রাখে, নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা কৃতজ্ঞতাপরায়ণ ও প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী।’ (সূরা বাকারা)
ইসমাইল (আ.) এর যখন হাঁটা-চলা ও খেলাধুলা করার বয়স তখন ইব্রাহীম (আ.) কে স্বপ্নে আদেশ করা হলো, তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো। ইব্রাহীম (আ.) ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারও একই স্বপ্ন দেখলেন। ইব্রাহীম (আ.) আবারও ১০০টি উট কোরবানি করলেন। আবারও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছেতো এ মুহূর্তে আমার কলিজার টুকরা প্রিয় পুত্র ইসমাইল ছাড়া আর তেমন কোন প্রিয় বস্তুু নেই।
আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে (ইব্রাহীমকে) একজন ধৈর্য্যশীল পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দান করলাম। সে যখন পিতার সাথে হাঁটা-চলার উপযোগী হলো, তিনি বললেন, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে কোরবানি করছি। সুতরাং তোমার মতামত কি? সে (ইসমাইল) বললেন, হে আমার পিতা! আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা পালন করুন। আপনি আমাকে আল্লাহর মেহেরবাণীতে ধৈর্য্যশীলদের একজন পাবেন। অতঃপর যখন তারা দু`জন একমত হলো আর আল্লাহতায়ালার ইচ্ছার সামনে আত্মসমর্পণ করলো এবং ইব্রাহীম (আ.) ইসমাইলকে জবাই করার জন্যে কাত করে শুইয়ে দিলো; তখন আমি ইব্রাহীমকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহীম তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে রূপ দিয়েছো। নিশ্চয়ই এটা ছিল ইব্রাহীম ও ইসমাইলের জন্যে একটা পরীক্ষা। অতঃপর আমি ইব্রাহীমকে দান করলাম একটি মহা কোরবানির পশু। অনাগত মানুষের জন্যে এ (কোরবানির) বিধান চালু রেখে, তার স্মরণ আমি অব্যাহত রেখে দিলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহীমের ওপর। আমি এভাবেই সৎপরায়ণ ব্যক্তিদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ (সুরা আস সফফাত)
হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কতিপয় সাহাবা রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কোরবানি কি? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানি মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইব্রাহীম (আ.) এর সুন্নত। তারা আবারও প্রশ্ন করলেন, এর মধ্যে আমাদের জন্যে কি আছে ? রাসূল (সা.) বললেন, কোরবানির পশুর প্রতিটা পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী আছে। তারা বললেন, ভেড়ারতো অসংখ্য পশম আছে। রাসূল (সা.) বললেন, ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী দেয়া হবে, যদি তা খালেস নিয়তে কোরবানি করা হয়` (ইবনে মাযাহ)।
আবু দাউদ শরীফের এক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদার দিন হচ্ছে কোরবানির দিন।
কোরবানির শিক্ষা : কোরবানি কোন চাপ বা জবদস্তির বিষয় নয়। মানুষ স্বেচ্ছায় তার প্রতিপালকের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় সবচাইতে প্রিয় বস্তুু ত্যাগ করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। যেমন- ইব্রাহীম (আ.) শুধু মাত্র স্বপ্নে দেখেছেন, তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাহে কোরবানি করো। আর অমনি তিনি তার আদরের একমাত্র সন্তানকে কোরবানির জন্যে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করলেন। পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচাইতে আকর্ষণীয় বস্তুর মধ্যে অর্থ-সম্পদ বা টাকা-কড়ি আর সন্তান অন্যতম। এই অর্থ-সম্পদের মোহ ত্যাগের এ মানসিকতা সৃষ্টি করাই হচ্ছে কোরবানির শিক্ষা। কোরবানি আমাদের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে ও পরকালের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে।
রাসূল (সাঃ) নির্দেশ করেছেন, হে লোকসকল তোমরা ত্রুটিমুক্ত ও উত্তম প্রাণী কোরবানি করো, কারণ কোরবানি র এ পশুগুলো হবে তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন।`(বায়হাকি)।
কোরবানি সচ্ছল সকল মুসলমানের ওপর ওয়াযিব। কোরবানির গোশতের ওপর আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর, গরীব-মিসকিনের ও মুসাফিরের হক আছে। খেয়াল রাখতে হবে সমাজের কোন একজন ব্যক্তিও যেন কোরবানির গোশত থেকে বঞ্চিত না হয়।
প্রতিক্ষণ/এডি/ডিএইচ