খাতা দেখে বিস্মিত শিক্ষিকা !

প্রকাশঃ আগস্ট ২২, ২০১৫ সময়ঃ ১১:১২ পূর্বাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

pisরাজধানীর একটি কলেজের বাংলার একজন শিক্ষিকা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট লিখে জমা দিতে বললেন। একজন ছাত্রীকে তিনি অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন ‘পিকনিক থেকে ফিরে এসে ডায়েরি বা দিনলিপি’ লেখা বিষয়ে। ওই ছাত্রী অ্যাসাইনমেন্ট খাতায় যা লিখে জমা দিয়েছে তাতে বিস্ময়ে হতবাক শিক্ষিকা। অ্যাসাইনমেন্ট খাতায় ওই ছাত্রী যা লিখেছে তার মূলকথা হলো আফজাল নামে একজন ক্লাসমেট ভালো লাগে তার। আফজাল সবসময় কালো শার্ট পরে ক্লাসে আসে। তাই তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সেও পিকনিকে গেছে কালো শাড়ি পরে। পিকনিক থেকে ফিরে এসে শাড়ি পরা অনেক ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছে সে। তাতে অনেকে অনেক ধরনের কমেন্টও করেছে এবং লাইক দিয়েছে। কিন্তু আফজাল ফেসবুকে অ্যাকটিভ থাকা সত্ত্বেও এখনো তার ছবিতে কোনো লাইক না দেয়ায় ও কমেন্ট না করায় সে অনেক দু:খ পেয়েছে।

অ্যাসাইনমেন্ট খাতা পড়ার পর শিক্ষিকা ছাত্রীকে ডেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে ছাত্রী জানাল, সে যা লিখেছে তা কোনো সত্য ঘটনা নয়। একটি গ্রামার বইয়ে এ রকম একটি ঘটনা লেখা রয়েছে দিনলিপিতে এবং সেটি দেখে সে তার অ্যাসাইনমেন্টটি লিখেছে।

এবার শিক্ষিকা ছাত্রীর কাছ থেকে ওই বইটি সংগ্রহ করে ‘পিকনিক থেকে ফিরে এসে দিনলিপি’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে আরো হতবাক হলেন। বইটিতে লেখা হয়েছে ‘উফ্ফ। যা একখান ঝক্কি গেল। শরীরের হাড্ডি- মাংস কিমা হয়ে গেছে। সারা শরীরে ক্লান্তি, অবসাদ। চোখ বুঝে আসছে ঘুম…। পিকনিক থেকে ফিরে এলাম। হট শাওয়ার নিয়েছি।

আফজাল হোসেন, সব সময় কালো শার্ট পরে, তাই আমিও বেছে নিয়েছিলাম কালো শাড়ি। সবার চোখ ট্যারা হয়ে গেছে। গ্রুপছবিতে আমাকে চেনা যাচ্ছে আলাদা করে। বাসায় ফিরেই আমার ফেসবুক ওয়ালে বাছাই করা তিনটি ছবি আপলোড করেছি। দারুন দারুন সব কমেন্টস করা হচ্ছে। কিন্তু আফজাল এখনো কোনো কমেন্ট করেনি। অথচ ফেসবুকে ওকে এ্যাকটিভ দেখাচ্ছে। বাসে আমি বসেছিলাম জানালার পাশে, ও বসেছিল ঠিক আমার দুই সারি পেছনে। ওর বন্ধু আল ফারাবি রিয়েল ও হৃদয় খান বারবার আমার দিকে তাকালেও একবারও আমার দিকে তাকায়নি। পিকনিকে যাওয়াই আমার ভুল হয়ে গেছে। মহা ভুল। বাসে নাস্তার বক্সে দেওয়া হয়েছিল আপেল, কলা আর একটা নিমকি। অথচ জার্নি করার সময় আমি মিষ্টি খেতে পারি না। বমি আসে। বাসে রিয়েল একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে ‘আফজাল পাঠিয়েছে।’ খুলে দেখি বার্গার সমুচা আর সিঙ্গারা। কাচ্চি বিরিয়ানি আমি খাই না অথচ আমাদের পিকনিকে দুপুরের মেনুই ওটা। খাবার সময় আলাদাভাবে তাই কাঁঠাল গাছটার তলায় গিয়ে বসেছিলাম। হৃদয় একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে ‘আফজাল পাঠিয়েছে।’ খুলে দেখি- চিকেন বিরিয়ানি। ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। ল্যাপটপ খুলে বসে আছি। আমার ছবিতে কত ফ্রেন্ডস লাইক দিচ্ছে, কমেন্টস করছে। কিন্তু … কিন্তু… কান্নার একটা ধাক্কা আসে। সেটা সামলে নিয়ে আবার ওয়ালে তাকাই। আমার প্রোফাইল পিকচারটা চেঞ্জ করেছিল গত সপ্তাহে। ফাটাফাটি এসেছে ছবিটা। ছবিতে আমার মামাতো বাই তনয় আমার হাত ধরে হাসছে। আমিও বত্রিশ দাঁত বের করে হাসছি।

বইটির নাম ‘উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি।’ বইয়ের কাভার পেজে প্রফেসর নিরঞ্জন অধিকারী ও প্রফেসর ড. শফিউদ্দিন আহমদের নাম লেখা রয়েছে। বইয়ের ওপরে লেখা হয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানরীতি অনুসারে উচ্চমাধ্যমিক, স্লাতকসহ (পাস ও অনার্স) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত। বইয়ের ওপরে আরো লেখা হয়েছে ২০১৪-২০১৫, ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষের নতুন সিলেবাস অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে।

বিস্মিত ওই শিক্ষক এ প্রতিবেদককে জানান, বইটি সংগ্রহ করে তিনি নাড়াচাড়া করে দেখেছেন এবং বইটিতে প্রচুর বানান ভুল রয়েছে।

এ ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্য রাজধানীর দু’টি নামকরা কলেজের পাশে অবস্থিত দু’টি লাইব্রেরিতে গিয়ে জানতে চাওয়া হয় ওই নামে কোনো গ্রামার বই আছে কি না। দু’টি লাইব্রেরিতেই বইটি পাওয়া যায়। এরপর খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেল, রাজধানীসহ দেশের অনেক নামকরা কলেজ থেকেই বইটি পড়ার জন্য শিক্ষার্থীদের রেফার করা হচ্ছে।
বিশালাকৃতির বইটির মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৩৫১। একটি নামকরা প্রকাশনা সংস্থা বইটি প্রকাশ করেছে এবং ৪৮০ টাকায় বিভিন্ন লাইব্রেরিতে বইটি বিক্রি হচ্ছে। বইটি দেখতে সুদৃশ্য কিন্তু ভেতরের অনেক বিষয় রয়েছে যাকে মার্জিত বলা যায় না। যেমন ‘একজন কলেজছাত্রের অঘটনের দিনলিপি’ শিরোনামে লেখা হয়েছে ‘ক্লাস শেষে স্যারের মেজাজ খারাপ করার জন্য সবাই আমাকে দায়ী করল। কেউ কেউ আমাকে বেশ ঝাড়িও দিলো। আমি নীরবে সব মাথা পেতে নিলাম।

এই ফাঁকে দীপু সামীর কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করছিল। মজা করার জন্য আমিও বললাম, ‘দীপু আমি তো তোর কাছে আরো আগে থেকেই এক হাজার টাকা পাই। তুই আমারটা না দিয়ে ওর ধার শোধ করছিস যে?’ বলাই বাহুল্য কথাটা বলেছিলাম নিছক মজা করার জন্য। কিন্তু আমার চোখ কপালে উঠল যখন এ কথা শুনে দীপু সুন্দর কড়কড়ে দুটো পাঁচ শো টাকার নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে, খুশী?’ আমাকে আর কে পায়? দীপু, সামী আর সেই সাথে আরো চার- পাঁচজনকে সাথে নিয়ে কাবাব হাউসে গিয়ে সবাইকে শিক-পরোটা খাওয়ালাম। খাওয়া শেষ হতেই দীপু আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘অকেশনটা কী?’ সুন্দর করে বললাম, ‘দোস্ত মনে কিছু নিস না। আসলে আমি তোর কাছে কোনো টাকাই পেতাম না। এ খাওয়াটা আসলে তোর টাকাতেই হলো। তাই তু-ই বল অকেশনটা কী?’ দীপু লা-জবাব হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল আমাকে। আর সবাই হো হো করে হেসে উঠল।’

বইটির রচনামূলক অংশে দেখা গেছে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যা মানানসই বলা যায় না। ‘কলেজে নতুন ভর্তি হয়েছে এমন একজন শিক্ষার্থীর দিনলিপি’ শীর্ষক লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমান আইনমন্ত্রীর নাম।

অ্যাসাইনমেন্ট প্রদানকারী শিক্ষিকা বলেন, ‘পিকনিক থেকে ফিরে এসে দিনলিপি’ শিরোনামে একজন ছাত্রীর বইটিতে যা লেখা হয়েছে তা কখনো কাউকে ভালো কিছু শেখাতে পারে না। তার মতে, পাঠ্যবইয়ে এ জাতীয় বিষয় অশোভন ও অনৈতিক। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, এ লেখাটি পড়ে একজন শিক্ষার্থী কী শিখবে। এমনিতেই আমাদের সমাজে নানা কারণে বিভিন্ন ধরনের অনাচার-বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ছে।

উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি বইটির কাভার পেজে প্রফেসর নিরঞ্জন অধিকারী ও প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদের নাম বড় করে লেখা থাকলেও তারা বইটির রচয়িতা নন। বইয়ের ইনার পেজে সব শেষে উল্লেখ করা হয়েছে রচয়িতাদের নাম। ইনার পেজে শুরুতে লেখা হয়েছে সম্পাদনায় প্রফেসর নিরঞ্জন অধিকারী ও প্রফেসর ড. সফিউদ্দিন আহমদ। তার নিচে লেখা হয়েছে পরিমার্জনায় প্রফেসর মো: আরিফুর রহমান, প্রফেসর আহমেদ ফারুক, ড. মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন, নিগার সুলতানা, প্রফেসর রোমজান আলী ও রাশিদা আক্তার। এরপর সবশেষে উল্লেখ করা হয়েছে রচনায় প্রফেসর মু. আব্দুল মান্নান ও জুলফিকার হোসেন তারা। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে।

প্রতিক্ষণ/এডি/এমএস

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G