রোমাঞ্চের জন্যই বিখ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
ডেস্ক রিপোর্ট, প্রতিক্ষণ ডটকম:
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়···একতারা হাতে গাইছিলেন বাউলশিল্পী আলী আজম খান। আঁধার নামতেই মেয়ে মনিরাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে আসেন কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে। আট-দশ বছর ধরে পর্যটকদের নিয়মিত গান শুনিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে লালনের গানে মেতেছেন বেশ কয়েকজন পর্যটক। চাঁদের আলোয় সৈকতে পা দিয়েই তাঁদের অনুসরণ করি। সমুদ্রের বিরামহীন আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে বাউলের দরাজ কণ্ঠের গানের মিশেলে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়। মুহূর্তেই ঘণ্টা তিনেকের ভ্রমণের যে কষ্টের অনুভূতি তা উধাও হয়ে যায়।
রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। পূর্ণিমার রাতে তখনো অনেকেই সৈকতের আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে গুনছেন। অদ্ভুত দৃশ্য-একদিকে বিশাল সমুদ্র যেন দুই হাত বাড়িয়ে ডাকছে, অন্যদিকে আছে তারাদের রাজ্যত্বে ডুবে যাওয়ার আহবান। একঘেয়ে জীবনের বেড়াজাল ভাঙার এই সুযোগটা কি ছাড়া যায়?
একই বেলাভূমি থেকে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয় দেখাটা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর! আর এই রোমাঞ্চের জন্যই বিখ্যাত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখি কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় হাজির কিশোর ভ্যানচালক ইউসুফ। শীতের শুরুতে শেষরাতের ঠান্ডা বাতাসে কাঁচুমাচু হয়ে ঝাউবাগান সংলগ্ন সৈকতে পৌঁছাই। ঘুম জড়ানো চোখে আমাদের মতো অনেকেই হাজির। পুব আকাশকে অদ্ভুত সব রঙের ছটায় রাঙিয়ে একসময় কুয়াশার চাদরে মোড়া সুয্যি মামার দেখা পাওয়া গেল। আশ্চর্য রকমের শান্তি শান্তি একটা ভাব যেন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তখনো পেছনে নিকষ আঁধার।
সূর্য দেখার পাঠ চুকিয়ে সকালের নাশতা সেরে ইউসুফের ভ্যানেই পশ্চিম পানে রওনা হই। উদ্দেশ্য ম্যানগ্রোভে ভরা লেবুর চর। এখানে শ্বাসমূল, খাল, গাছের সাঁকো-সবকিছু মিলিয়ে বেশ একটা সুন্দরবন সুন্দরবন ভাব। ওপারেই আবার সুন্দরবনের দক্ষিণের শেষ অংশ ফাতরার চর। জোয়ার-ভাটার অপরূপ খেলার সঙ্গে বনের ভেতর হারিয়ে কীভাবে যে ঘণ্টাখানেক সময় কেটে যায়, বলা মুশকিল। ফেরার পথে ঢুকে পড়ি সমুদ্রপারের শুঁটকিপল্লীতে। বাঁশের আড়ে রূপচাঁদা, লইট্টা, বাইলা, শাপলা পাতাসহ কয়েক শ জাতের সামুদ্রিক মাছের শুঁটকিতে এ এক অন্য জগৎ। শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের কৌশল কাছ থেকে দেখার সুযোগ ছাড়াও ঢাকায় নিয়ে আসার কাজটা সেরে নিই সহজেই।
মূল সৈকতের পূর্ব পাশে দুই কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠেছে ইকো পার্ক। সঙ্গেই বিশাল ঝাউবাগান। সৈকত ধরে আরও সামনে চর গঙ্গামতী। কিলো দশেক এই পথটুকু মোটরসাইকেল ভাড়া করে যাওয়া যেতে পারে। পথে চোখে পড়বে লাল কাঁকড়া দলের রোদ পোহানো, নারিকেলের বাগান, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, জেলেদের মাছ ধরা, বিশাল খালের সমুদ্রের বুকে মেশার মতো অপূর্ব দৃশ্য।
কুয়াকাটা চৌরাস্তাসংলগ্ন পূর্ব পাশেই বৌদ্ধ বিহার। এর ছাদের নিচেই এখন শত বছর পুরোনো অষ্ট ধাতুর বুদ্ধমূর্তি। পাশেই কুয়াকাটার ঐতিহ্যবাহী কুয়া। সংস্কার করা পাড় বাঁধানো কুয়া এখন আরও বেশি আকর্ষণীয়। পেছনের বার্মিজ মার্কেটে পাওয়া যাবে রাখাইনদের তৈরি পোশাক ও হস্তশিল্পের পসরা। রাখাইনপল্লীতে একবার ঢুঁ না মারলে কুয়াকাটা ভ্রমণ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
আরও একটু দূরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে লেক ভিউ প্লাস কুয়াকাটায় ২০০ রকমের সামুদ্রিক মাছের সংগ্রহশালা, চিত্রপটে রাখাইনদের জীবন ও ইতিহাস ছাড়াও মহিপুরের মিশ্রিপাড়ার বৌদ্ধ মন্দিরের ৩৯ ফুট উচ্চতার বুদ্ধমূর্তি দেখে আসতে পারেন।
যেখানেই যান শেষ বিকেলে অবশ্যই সৈকতে ফেরত যেতে হবে সূর্যাস্ত দেখার জন্য। সমুদ্রের পেটে ডুবে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দিগন্তের সূর্যের বর্ণনা দেওয়াটা আসলেই মুশকিল। সেটা বরং চোখে দেখার জন্য কুয়াকাটা চলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
থাকবেন কোথায়
থাকার জন্য কুয়াকাটায় বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল, মোটেল, রেস্টহাউস ও কটেজ আছে। পর্যটন করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ ডাকবাংলো ছাড়াও হোটেল গোল্ডেন প্যালেস, হোটেল নীলাঞ্জনা, হোটেল স্কাই প্যালেস, স্কাই কটেজ, হোটেল বনানী, হোটেল কুয়াকাটা, কুয়াকাটা রেস্ট হাউস ইত্যাদি হোটেলে থাকা যাবে। আর রাতটাও যদি একেবারে সমুদ্র লাগোয়া থাকতে চান তবে একমাত্র স্কাই কটেজেই উঠতে হবে।
যেভাবে যাবেন
সড়ক ও নদী উভয় পথেই কুয়াকাটা যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী থেকে সরাসরি বাস পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় যায়। এ ছাড়া সদরঘাট থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত সরাসরি লঞ্চ সার্ভিস আছে। পটুয়াখালী থেকে মিনিবাসে কুয়াকাটা যেতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা।সূত্র: প্রথমআলো।
প্রতিক্ষণ/এডি/আবিদ