ঘুরে আসুন বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
প্রতিক্ষণ ডেস্ক
বালিয়াটি প্রাসাদ বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত মানিকগঞ্জ জেলার সদর থেকে আনুমানিক আট কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা জেলা সদর থেকে পয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের ১৯ শতকে নির্মিত অন্যতম প্রাসাদ। একে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বা সাটুরিয়া জমিদার বাড়ি বলেও ডাকা হয়। মোট সাতটি স্থাপনা নিয়ে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। এই বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বা প্রাসাদটির সবগুলো ভবন একসাথে স্থাপিত হয়নি। এই প্রাসাদের অন্তর্গত বিভিন্ন ভবন জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্লকটি যাদুঘর। এই প্রাসাদটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ও পরিচালিত।
প্রায় দুশ’ বছরের ইতহাস-ঐতিহ্য বুকে লালন করে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বালিয়াটির জমিদার বাড়ি। সে সময়কার মানুষের জীবন-জীবিকা, চাল-চলন, আনন্দ-বিনোদন আর শৌখিনতার পরিচয় পাওয়া যায় এ জমিদার বাড়িটিকে দেখলে। মানুষের মেধা আর পরিশ্রমকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করা যেমন কঠিন নয়, এই জমিদার বাড়ির মানুষগুলোই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কেননা একটি নিুবিত্ত পরিবার থেকে এ জমিদার বাড়ির কর্তারা তাদের মেধা মননশীলতা আর পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে জমিদারি হাল-হকিকতে নিজেদের নাম লেখাতে পেরেছেন। উন্নতির শীর্ষে নিজেদের অবস্থানকে ধরে রেখেছেন যুগ থেকে যুগান্তরে।
যেভাবে এ জমিদার বাড়ি : একটি নিবিত্ত সাহা পরিবার থেকেই বালিয়াটি জমিদার বংশের উদ্ভব। মহেশরাম সাহা নামে জনৈক বৈশ্য বারেন্দ্র শ্রেণীর ছোট্ট এক কিশোর ভাগ্য অন্বেষণে বালিয়াটিতে আসে। সেখানে জনৈক পান ব্যবসায়ীর বাড়িতে চাকরি নেয় মহেশরাম সাহা নামের ওই ছোট্ট বালক। চাকরিতে তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে সেখানেই বিয়ে করে সংসারী হন। তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে মহেশরামের ছেলে গণেশ রামকে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন তিনি। গণেশ রাম তার পিতার আনুগত্যতায় লবণের ব্যবসা শুরু করেন। গণেশ তার মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে লবণের ব্যবসায় বেশ উন্নতি লাভ করেন।
গণেশ রামের চার ছেলের মধ্যে একজন হল গোবিন্দ রাম। তিনিও তার পিতার ব্যবসাকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নেন। গোবিন্দ রাম বিয়ে করেন বালিয়াটিতে। তার ঘরে জন্ম নেয় চার ছেলে। যথাক্রমে আনন্দ রাম, দধিরাম, পণ্ডিত রাম ও গোপাল রাম। এ চার ভাইয়ের পৃথক পৃথক ব্যবসা ছিল। বাণিজ্য কেন্দ্র সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ঝালকাঠি, নলছিটি প্রভৃতি স্থানে লবণ, সুপারি, চাল ইত্যাদি ব্যবসার মাধ্যমে অনেক অর্থের মালিক হন তারা। এদের ঐশ্বর্য বেড়ে উঠলে তারা জমিদারি ও তালুকদারি কিনতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা শান-শওকতে বসবাসের জন্য নিজেদের শৌখিনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ইমারত গড়তে শুরু করেন। ওই চার ভাই থেকেই বালিয়াটি গোলাবাড়ি, পূর্ববাড়ি, পশ্চিম বাড়ি, মধ্যবাড়ি ও উত্তরবাড়ি নামে পাঁচটি জমিদার বাড়ির সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক বাড়িরই রয়েছে পৃথক পৃথক নামকরণের বৈশিষ্ট্য।
গোলাবাড়ি : লবণের একটি বড় গোলা ছিল বলেই এ বাড়ির নাম গোলাবাড়ি। গোলাবাড়ির চত্বরে দোল পূর্ণিমার ১২ দিন পর বারুণীর মেলা বসত। সেই মেলা এখন বসে বালিয়াটির পুরনো বাজারে। এ বাড়ির জমিদাররা ছিলেন ধর্মপ্রাণ। বাড়ির মন্দিরে বিগ্রহের পূজা হতো। কিন্তু ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকাররা গোলাবাড়ি আক্রমণ করে অনেক মূল্যবান সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে যায়।
পশ্চিম বাড়ি : জমিদার বাড়ির পশ্চিম অংশে অবস্থিত বলেই এ বাড়ির নাম পশ্চিম বাড়ি। দধিরাম ছিলেন পশ্চিম বাড়ির জমিদারদের পূর্বপুরুষ। এই বাড়ির উত্তরসূরি জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বিখ্যাত, জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে এটি ছিল স্কুল। কলেজে উন্নীত হওয়ার সময় স্কুল শাখা আলাদা করা হয়। সেটি বর্তমানে কেএল জুবিলী হাইস্কুল নামে পরিচিত। বর্তমানে জগন্নাথ কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এছাড়াও ওই বাড়ির জমিদাররা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং পাঠাগার নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পূর্ববাড়ি : বালিয়াটির পূর্ব অংশে এ বাড়ির অবস্থান বলেই এ বাড়ির নামকরণ করা হয় পূর্ববাড়ি। এ বাড়ির প্রথম জমিদার পুরুষ রায় চাঁন। তিনি দুটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সম্পত্তির দশ আনা অংশ এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তানদের দান করেন ছয় আনা অংশ। দশ আনির জমিদার বাড়িটিই বর্তমানে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান। এ বাড়িটি ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রতত্ত্ব অধিদফতর অধিগ্রহণ করে এবং এখনও এর সংস্কার কাজ চলছে। এ বাড়িটি বালিয়াটি প্রাসাদ নামে পরিচিত। এখানে পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত চারটি সুবৃহৎ অট্টালিকা বিদ্যমান। এগুলো বড় তরফ, মেঝো তরফ, নয়া তরফ এবং ছোট তরফ নামে পরিচিত।
ছয় আনির জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব বর্তমানে নেই। ৫.৮৮ একর জমির ওপর বাড়ির মূল সৌধমালা। গোপাল রাম এবং পণ্ডিত রাম এ দু’ভাই হলেন এ বাড়ির প্রাচীন আদি পুরুষ। এ বাড়ির এক তেজস্বিণী মহিলা জমিদারের নাম উজ্জ্বলা রানী রায় চৌধুরানী। এ জমিদার বাড়ির প্রাণপুরুষ শাম্বিকা চয়নের মেয়ে কিরণ বালাকে বিয়ে করেছিলেন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর শহীদ রণদাপ্রসাদ সাহা। যিনি আরপি সাহা নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বালিয়াটিতে হাসপাতাল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জমিদার এতে অনুমতি দেননি বলে তিনি নিজের গ্রাম মির্জাপুরে তার মায়ের নামে কুমুদিনী হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা আরপি সাহাকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। এ বাড়ির জমিদারদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য কীর্তির মধ্যে রয়েছে ধামরাইয়ের রথ, ঢাকার কেএল জুবিলী হাইস্কুল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বালিয়াটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যালয়, বালিয়াটি রামকৃষ্ণ মিশন, নহবত খানা, শ্রী শ্রী মাধব গৌড়ির মঠ ঢাকা, নিতাই গৌড়ের আখড়া ইত্যাদি।
বাড়ির স্থাপত্যকলা : বালিয়াটির জমিদার বাড়িটি স্থাপত্যকলার দিক দিয়ে বহু প্রাচীন। বাড়ির সূক্ষ সুনিপুণ কারুকাজ ও স্থাপত্যকলা যে কোন পর্যটকের নজর কাড়বে। বেশিরভাগ বাড়িই তিনতলা বিশিষ্ট। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দাগুলোতে রয়েছে লোহার কারুকাজ শোভিত প্রাচীর। তবে এ বাড়ির অনেক স্থাপত্য কীর্তিই এখন আর বর্তমান নেই। বাড়ির প্রতিটি দেয়ালই প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরু। বাড়ির গাঁথুনিতে সিমেন্টের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে চুন-সুড়কি আর বেশ শক্তিশালী কাঁদামাটি। বাড়ির ছাদে লোহার রডের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে বেশ শক্তিশালী লোহার পাত। বাড়ির ভেতরে কখনও কখনও লোহার সিঁড়ি দেখতে পাওয়া যায়।
জমিদার বাড়ির প্রবেশ দরজার দু’পাশে উপরের দিকে রয়েছে দুটি তেজী সিংহের পাথরের মূর্তি। দেখলে মনে হবে এই বুঝি তেড়ে আসছে। সুতরাং প্রবেশদ্বারকে সিংহদ্বার বলতেই হয়। এ সিংহদ্বার পেরুলেই নজরে আসবে প্রশস্ত আঙিনাটি। যেখানে বর্তমানে রয়েছে ফুলের বাগান। বাড়ির পেছনের অন্দর মহল পেরুলেই চোখে পড়বে বিশালাকার পুকুর। পুকুরের একপাশে রয়েছে শৌচাগার। পুকুরের চারপাশে রয়েছে চারটি শান বাঁধানো ঘাট। সম্ভবত চার জমিদার আনন্দ রাম, দধিরাম, পণ্ডিত রাম ও গোপাল রামের জন্যই চারটি আলাদা আলাদা ঘাট বাঁধানো হয়েছে। বর্তমানে পুকুরটি পানিশূন্য রয়েছে। ১৭৯০ সালে ওই চার ভাইয়ের মাধ্যমেই বালিয়াটি জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তন হয়।
বালিয়াটি জমিদার বাড়ির দৃষ্টিনন্দন ইমারত, নির্মাণ কৌশল আর অলংকরণের অপূর্ব সমাহার পর্যটকদের কাছে টানে। বিশাল বিশাল ভবন আর নির্মাণশৈলী জমিদার আমলে জমিদারদের বিত্তবৈভবের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। ঝড়-বৃষ্টি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি।
প্রতিক্ষণ/এডি/এআরকে