ছেলেটি বেঁচে নেই ! – আজিজ মুনির
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে আত্মহত্যা করেছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র অরিন্দম সৈকত। ২৩ তারিখে এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হলে অরিন্দম আইসিটিতে ফেল করে বলে জানা যায়।নিজের এ ব্যার্থতাকে মেনে নিতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে।
এসএসসি ও এইচএসসি’র রেজাল্টের পর এরকম কত প্রাণ অসময়ে ঝরে যায়, তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান কি আমরা রাখি? উন্নত বিশ্বে আত্মহত্যার সংকট আছে, সেখানে নানা কারণ আছে। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি পড়ুয়া একটা ছেলে যার সামনে পড়ে আছে এখনো অফুরন্ত সময়, নানা রঙিন স্বপ্ন; সে কেন আত্মহত্যা করতে যাবে!আত্মহত্যা করা ছেলেটি ফেসবুকে লিখেছে, ” এটাই তো হেরে যাওয়া এক সৈনিকের প্রাপ্তি!” অরিন্দম সৈকত একজন হেরে যাওয়া সৈনিক । কিন্তু প্রশ্ন হলো, কার বিরুদ্ধে ছেলেটি প্রতিনয়ত যুদ্ধ করে গেছে? নিজের? সমাজের? পরিবারের? যাদের কাছে নিজে হেরে গিয়ে গেলেন- তারা কারা? এই পুঁজিবাদী সমাজ না ভোগবাদী রাষ্ট্র? ভারসাম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা না সোশ্যাল মিডিয়ার মেকি দুনিয়া? এই প্রশ্নসমূহের উত্তর আমাদের জানা থাকা চাই । আত্মহত্যা করার একদিন আগে (২২ জুলাই) নিজের ফেসবুকে লিখেন,”আজকে রাতেই ডিসিশন হবে, এই ঘরে আর থাকতে পারবো কিনা! ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি। মানিব্যাগ ও মোটামুটি ভর্তি। এখন শুধু রেজাল্ট টা পাওয়ার অপেক্ষায়”।
কেউ কি শুধু রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় নিজের জীবন নষ্ট করে? নতুন প্রজন্ম যে সময়ে ও সমাজে বেড়ে উঠছে, এতে নানা আরোপিত উপাদান আছে। সে সবকিছুর হিসেব-নিকেশ মিলাতে পারে না। নিজের ভেতরে ক্রমান্বয়ে তৈরী হওয়া পুঞ্জীভূত সংকট ও ক্রমবর্ধমান হাহাকারের একটি চিত্র এই উঠতি তরুণদের মধ্যে আমরা দেখি। যেমন ধরুন, একটি ছেলে বা মেয়ে দিব্যি প্রেম করে যাচ্ছে, কিন্তু আমি পারছি না, হতে পারে পারিবারিক বাধা বা মূল্যবোধের প্রশ্ন। আমি দেখছি, অনেকেই উন্নত রেস্টুরেন্টে গিয়ে পার্টি করছে, মজা করছে, আমার খুব ইচ্ছে, কিন্তু আমি পারি না ।আমি দেখলাম, সেদিন সামান্য ঘটনায় বাবা আমার সামনে মাকে বকা দিতে, আমি কিছু বলতে পারিনি। আমার খুব ইচ্ছে, আমার বন্ধুর মতো প্রাইভেট কারে কলেজে আসতে, কিন্ত পারি না; আমার বাবার সার্মথ্য নেই। এই যে আমার মাঝে না পাওয়ার হাহাকার তৈরী হচ্ছে এই সংকট বাসা বাঁধতে থাকে আমাদের চিন্তায়, মননে। এর সাথে যুক্ত হতে থাকে সামাজিক মাধ্যমের তৈরী বাবল্স বা বুদ্বুদ জগৎ। বিশ্বায়নের রঙিন দুনিয়াকে খুব কাছে মনে হতে থাকে। জাস্টিন বিবার- সেলিনা গোমেজ হয়ে উঠতে থাকে আমার চিন্তার অংশ। বিদেশী দামি মডেলের গাড়ি হয়ে উঠছে আমার প্রিয় চাহিদা। এই ছেলেটির ফেসবুকে আপনি দেখবেন, সুইজারল্যান্ডের কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য কিংবা সবশেষ মডেলের কোনো উন্নত গাড়ি। মিউজিক বা তার প্রিয় শিল্পীর ছবি। কত কিছুকেই সে আপন ভেবেছে। তার এতো এতো বন্ধু, কিন্তু দু:সময়ে কাউকে কাছে না পাওয়ার জন্য প্রচণ্ড আক্ষেপ করেছে। এই যে সামাজিক মাধ্যমের মানবীয় বন্ধন তৈরির ব্যর্থতা; এটা তরুণদের বুঝতে হবে।
চারিদিকে তৈরী হওয়া এই নানা কৃত্রিম সংকটের মধ্যে একজন তরুণ জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতার হিসেবে নিকেশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠে। সিজিপিএ কত, গোল্ডেন না সিলভার; এইটা নির্ণয় করে দিচ্ছে তার মা বাবার ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন! অরিন্দম মা বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারেনি। ছেলে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার গল্প মা-বাবা কত জনের কাছে গল্প করে বেরিয়েছে! ছেলেটা হয়তো মেডিক্যাল বা ভার্সিটি কোচিংও করছিল। এখন ছেলেকে নিয়ে তারা সমাজে মুখ দেখাবে কী করে! তাইতো অরিন্দম সৈকত একজন হেরে যাওয়া সৈনিক।
সম্ভবত বিশ্বের মধ্যেই বাংলাদেশ আজব একটি দেশ; যেখানে রেজাল্ট ভালো হলে উৎসব করতে হয়! পত্রিকাওয়ালাদের বিশাল বিশাল শিরোনাম করতে হয়। খারাপ হলেই অসম্ভব চাপের মুখে পড়তে হয়। সামাজিক চাপ। পারিবারিক চাপ। চারিদিকে শুধু মনে হয় অন্ধকার। রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় অনেক মেয়ের বিয়ের চাপ বাড়তে থাকে। অনেকেই আত্মহত্যা করে। পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনেই চট্টগ্রামের একটি মেয়ে আত্মহত্যা করে। বাংলানিউজ একটি সংবাদের শিরোনাম করেছে ‘দুপুরে ফল প্রকাশ, বিকেলে আত্মহত্যা'(২৩ জুলাই ২০১৭)।এটি একটি বীভৎস রকমের পরিস্থিতি। হয়তো মেয়েটি ভেবেছিলো, ফলাফল ভালো না হলে বিয়ে না করে উপায় নেই। তার চেয়ে মরে যাওয়ায় ভালো! এরকম তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সৃজনশীল কিছু করা তো দূরের কথা, সুস্থভাবে বেঁচে থাকা দায়। শিশু বয়স থেকে এতো চাপ নিয়ে সে বেশি দূর এগোতে পারে না। তাছাড়া গণমাধ্যের অতি আগ্রহ অনভিপ্রেত। মিডিয়া শুরুতেই শিক্ষার্থী-অবিভাবকদের মনে একটি কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দেয়। গণমাধ্যম গবেষকদের নিউজ ট্রিটমেন্টের এই প্রচলিত ধারা ও তার প্রভাব নিয়ে ভাবা উচিত। কোনো স্কুলে কত জিপিএ ৫ তার তুলনামূলক চুলচেরা বিশ্লেষণ থাকে। এতে কি আদৌ
কোনো লাভ হয়?
আমরা উন্নত দেশসমূহে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে কখনো উৎসব করতে দেখি না। স্কুলের ফলাফল একজন শিক্ষার্থী ও তার অবিভাবক ছাড়া কেউ জানে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়ে নিজের একাউন্টে বিস্তারিত জেনে নিতে পারে। পাশ না ফেইল কেউ জানে না। কারো যায় আসে না। কে কত পেলো এইটা প্রাইভেসি। ব্যক্তির গোপনীয়তাকে সম্মান করতে শেখানো হয় স্কুল লেভেল থেকেই। ফলে কেউ কারো ফলাফল নিয়ে উল্লাস করে না। শোকে মাতম করে না। কেউ কারো চেয়ে নম্বর বেশি পাওয়ার প্রতিযোগিতা নেই। আছে পারস্পরিক সহযোগিতা। সবাই যে যার মতো পড়াশুনা করে একটা ভালো ফলাফল চায়।
এই সামান্য একটা বিষয়কে আমরা ব্যক্তি বা পরিবার পরিসর থেকে সামাজিক মর্যাদার পর্যায়ে নিয়ে গেছি। কী উদ্ভট একটা সিস্টেম হয়ে আছে। এটাকে ভাঙতে হবে। বাবা-মা যদি তার সন্তানকে না বুঝেন, বন্ধুরা পাশে না থাকে, ব্যক্তি পর্যায়ে কারো প্রাইভেসি ও স্বাধীনতাকে সম্মান করতে না জানি; তাহলে অনেক প্রাণ, প্রতিভা খুব অসময়ে হারিয়ে যাবে। জনঘনত্বের দারিদ্রে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য আজকের প্রজন্ম অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এ দেশে ধীরে ধীরে যেকোনো সমস্যার সমাধান ভাবা হলে, এই তরুণ প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে। জীবন-জীবিকা-পরিবার ও সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে এই তারুণ্যের কোনো বিকল্প নেই ।
এই আত্মাহুতির প্রতি আমাদের কোনো সহমর্মিতা নেই। কারণ প্রায় লেখাপড়ার নামে অর্থহীন প্রতিযোগিতায় আমরা লাখে লাখে মানবিকবোধহীন প্রজন্ম তৈরি করছি। কিন্তু ফলাফল আর সামাজিক মর্যাদালোভী সমাজের প্রতি তার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নের জবাব আমাদেরকেই দিতে হবে। এই আত্মহননকারী একটি ছেলের জীবনের দাম হাজার অর্থহীন জিপিএ পাঁচের চেয়ে অনেক মূল্যবান। ফলাফলের এই অশুভ প্রতিযোগিতা থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে। পরিবার থেকে প্রতিষ্ঠান-সবার সচেতনতামূলক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। তাই, গণপ্রজাতন্ত্রের জনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা-রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগে একটি সামগ্রিক ও অনুকূল শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করা খুব প্রয়োজন মনে করছি।
আজিজ মুনির
ব্রাসেলস,বেলজিয়াম
ফেলো, নেদারল্যান্ড ফেলোশিপ প্রোগ্রাম ও গণমাধ্যম গবেষক।