ছোটদের বন্ধু নজরুল
এনায়েত রসুল
কাজী নজরুল ইসলামকে বলা হতো বিদ্রোহী কবি। কারণ, তীক্ষষ্ট লেখনীর মধ্য দিয়ে হতাশা জর্জরিত দেশবাসীর মনে তিনি সত্ সাহস জুগিয়েছেন। কবিতার ছন্দময় অস্ত্র দিয়ে শাসন করেছেন অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীকে। তাই শাসকরাও ভয় পেতো নজরুলকে।
শাসক আর অত্যাচারীরা নজরুলকে যতোই ভয় পাক, ছোটরা মোটেও ভয় পেতো না তাকে। সুযোগ পেলেই ছোটরা ছুটে যেতো নজরুলের কাছে। কবি নজরুলও খুব ভালোবাসতেন ওদের। বলতেন, ওরা আমার ছোট্ট বন্ধু।
ছোটদের জন্য অনেক মজার মজার ছড়া লিখেছেন নজরুল। তার লেখা পিলে পটকা, খাঁদু-দাদু, মট্কু মাইতি, লিচুচোর আর খুকি ও কাঠবিড়ালীর মতো শিশুতোষ মজার ছড়া অন্য কেউ লিখেছেন কি-না, জানা নেই। ভাবতে গিয়ে অবাক হতে হয়, ছোটদের জন্য লেখা প্রায় প্রতিটি ছড়া-কবিতার পেছনেই নজরুলের কোনো না কোনো ক্ষুদে বন্ধুর কাহিনী জড়িয়ে আছে।
ভারতে দেওঘর নামে একটি জায়গা আছে। স্বাস্থ্যকর জায়গা হিসেবে খুব নাম-ডাক সেই দেওঘরের। নজরুল কিছুদিনের জন্য একবার গেলেন দেওঘরে। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া নিলেন।
সেই বাড়ির উপরতলায় থাকতেন বাড়িওয়ালা। তাদের ছিলো একটি চঞ্চল মেয়ে। দুদিনেই নজরুলের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেলো সেই মেয়েটির। নজরুলের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায় সে। গান শোনে তন্ময় হয়ে। ছড়া শোনে নেচে নেচে। আর হঠাত্ হঠাত্ যখন চারপাশ কাঁপিয়ে হা-হা করে নজরুল হেসে ওঠেন, সেই মেয়েটি তখন অবাক বিস্ময়ে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে থাকে নজরুলের দিকে। মোট কথা, সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে যায় বিদ্রোহী কবির ছোট্ট বন্ধু।
কয়েকদিন দেওঘরে কাটিয়ে নজরুল ইসলাম কলকাতা ফিরে এলেন। কিন্তু তার মনে সেই মেয়েটির স্মৃতি সারাক্ষণ জেগেই রইলো। যার সঙ্গে দেখা হয়, তাকেই নজরুল বলে বেড়ালেন দেওঘরের সেই ক্ষুদে বন্ধুর কথা।
একদিন নজরুল একটি চিঠি পেলেন অচেনা হাতের লেখায়। খুলে তো অবাক। আরে! এ যে দেওঘরের সেই বাড়িওয়ালার চিঠি। তিনি জানিয়েছেন কদিন পরেই তার মেয়ের জন্মদিন। মেয়ের ইচ্ছে কবিকে জন্মদিনের উত্সবে উপস্থিত থাকতেই হবে। তার ছোট্ট মেয়েটি নাকি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি কবিকে। নজরুল চিঠি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলেন। বন্ধুদের ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে চললেন সেই চিঠি। বারবার পড়ে শোনালেন। আর সিন্ধান্ত নিলেন ছোট্ট বন্ধুটির জন্মদিনের উত্সবে উপস্থিত থাকবেন তিনি। কিন্তু কি দেবেন সেই ছোট বন্ধুটিকে? কবির যা কাজ তাই করলেন কবি। উত্সবে উপহার দেয়ার জন্য তিনি লিখে ফেললেন চমত্কার একটি কবিতা। নজরুল লিখলেন :
নাম-হারা তুই পথিক শিশু
এলি অচিন দেশ পারায়ে
কোন্ নামে আজ পরলি কাঁকন?
বাঁধন হারার কোন্ কারা এ?
এ কথা তো নিশ্চিন্তে বলা যায়, দেওঘরের সেই ছোট্ট মেয়েটি তার জন্মদিনে যতো উপহার পেয়েছিলো, নজরুলের কবিতাটি ছিলো সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।
ছোটদের জন্য লেখা নজরুল ইসলামের একটি বিখ্যাত কবিতার নাম ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’। এ কবিতা লেখা নিয়েও দারুণ একটি ঘটনা আছে। আর সেই ঘটনাও ছোট একটি মেয়েকে নিয়ে।
১৯২১ সালে একবার কুমিল্লায় বেড়াতে এসেছিলেন নজরুল। তিনি উঠেছিলেন ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত নামে এক ভদ্রলোকের বাসায়। তার একটি ছোট মেয়ে ছিলো। ওর নাম ছিলো অঞ্জলি। পুতুলের মতো ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে।
একদিন নজরুল বারান্দায় বসে আছেন। হঠাত্ তার চোখ পড়লো অঞ্জলির ওপর। নজরুল দেখলেন, একটা পেয়ারা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে চোখ-ঠোঁট উল্টিয়ে, হাত-পা নেড়ে অঞ্জলি যেনো কার সঙ্গে কথা বলছে। সেই কথা আর শেষই হতে চায় না।
নজরুল ভাবলেন, নিশ্চয়ই কেউ পেয়ারা গাছে উঠেছে। তার কাছে কাকুতি-মিনতি করে অঞ্জলি পেয়ারা চাইছে, কিন্তু গাছের ওপর যে, সে পেয়ারা দিচ্ছে না।
নজরুল তো ছোটদের খুব ভালোবাসতেন। তিনি ভাবলেন, অঞ্জলির হয়ে পেয়ারা চাইবেন। ছেলেটা দেয় তো ভালো। না দিলে নিজেই পেয়ারা পেড়ে দেবেন।
মজার ব্যাপার হলো, অঞ্জলির সামনে গিয়ে কবি নজরুল গাছের ওপর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তবে অঞ্জলি কথা বলছিলো কার সঙ্গে?
নজরুল তখন অঞ্জলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কার সাথে কথা বলছিলে অঞ্জলি?
অঞ্জলি বললো, কাকাবাবু! ওই দেখো দুষ্টু কাঠবেড়ালী। রোজ রোজ দুষ্টুটা পেয়ারা খেয়ে পালিয়ে যায়। আমাকে একটাও দেয় না।
কাঠবেড়ালীর সঙ্গে অঞ্জলির এই মান-অভিমানের ঘটনাটি নজরুলকে এতোটাই চমত্কৃত করলো যে, এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য লিখলেন একটি দারুণ কবিতা। ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’ নামের সেই কবিতার শুরুটা ছিলো এমন :
কাঠবেড়ালী! কাঠবেড়ালী!
পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও! দুধ-ভাত খাও?
বাতাবি লেবু? লাউ?
বেড়াল বাচ্চা? কুকুরছানা তাও?
ছড়া-কবিতা পড়তে পারে অথচ এ কবিতাটি পড়েনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না বললেই চলে।
কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি শিশুতোষ বিখ্যাত কবিতার নাম ‘লিচু চোর’। এ কবিতাটি লেখার পেছনেও সুন্দর একটি ঘটনা আছে। এ ঘটনার পেছনে অবশ্য সরাসরি ছোট কেউ জড়িত ছিলো না। জড়িত ছিলেন এক পৌঢ় ব্যক্তি। তবে ছোটদের ভালোবাসতেন বলেই যে কবি নজরুল ‘লিচু চোর’ কবিতাটি লিখেছিলেন, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নজরুল যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। ঊনপঞ্চাশ নম্বর বাঙালি পল্টনে হাবিলদার পদে চাকরি করতেন নজরুল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে তার বাহিনী যখন ভেঙে দেয়া হয় নজরুল ইসলাম তখন কলকাতায় চলে আসেন। একদিন নজরুলের সঙ্গে আলী আকবর নামে এক ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। ছোটদের জন্য পাঠ্যবই লিখতেন তিনি।
এই আলী আকবর সাহেব একদিন নজরুল ইসলামকে একটি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে মতামত চাইলেন। পুরো পাণ্ডুলিপিটি পড়ে নজরুল বললেন, আপনার পাণ্ডুলিপির ছড়াগুলো ছোটদের উপযোগী হয়নি। এগুলো বদলাতে হবে। যদি বলেন তো আমিও একটা কবিতা লিখে দিতে পারি।
আলী আকবর সাহেবের জন্য এ ছিলো আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো প্রস্তাব। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অনুরোধ করলেন নজরুলকে একটি কবিতা লিখে দেয়ার জন্য। নজরুল ইসলামও দু’খিলি পান মুখে পুরে লিখলেন সেই বিখ্যাত ‘লিচু চোর’। সেই কবিতায় নজরুল লিখলেন :
বাবুদের তালপুকুরে
হাবুদের ডালকুকুরে
সেকি ব্যস করলো তাড়া
বলি, থাম-একটু দাঁড়া।
কাজী নজরুল ইসলামের আরেকটি বিখ্যাত কবিতার নাম ‘মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়’। এটা লেখার গল্পটা আরো মজার।
নজরুল ইসলাম চাকরি করতেন তখন হিন্দুস্তান গ্রামোফোন কোম্পানিতে। সেই কোম্পানির রিহার্সেল রুম ছিলো কলকাতা শহরের চিত্পুরে বিষ্ণুভবনে। নজরুলকে প্রতিদিন যেতে হতো সেখানে। যাবার সময় প্রতিদিনই দুটি ছেলে দৃষ্টি কাড়তো তার। ওরা গলা ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতো। তা যাক। এটা কোনো আকর্ষণীয় দৃশ্য নয়। কিন্তু কবি নজরুলের কাছে যেটা আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল তা হলো সেই ছেলে দুটোর আকৃতি। একজন ছিলো দারুণ বেঁটে আর মোটা—অন্যজন টিনটিনে শুকনো আর ছিপছিপে লম্বা। অনেকটা তালপাতার সেপাইয়ের মতো।
এ দু’জনকে দেখে নজরুল এতোটাই মজা পেয়েছিলেন যে, একদিন হঠাত্ই তিনি লিখেছিলেন :
মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়
ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যায়
বেঁটে খাটো নিটপিটে পায়
ছেরে চলে কেরে চায়
মটকু মাইতি বাঁটকুল রায়।…
ছড়া কবিতা লেখার পেছনে এমন অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে, যা থেকে বোঝা যায় ছোটদের কতো ভালোবাসতেন কাজী নজরুল ইসলাম।
প্রতিক্ষণ/এডি/নির্ঝর