জব্বারের আমৃত্যু কারাদন্ড
আদালত প্রতিবেদক, প্রতিক্ষণ ডটকম:
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য পলাতক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বয়স বিবেচনা করে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন।
তার বিরুদ্ধে আনিত ৫ টি অভিযোগের সবকটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
এ রায়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ১৭তম রায় ঘোষণা করা হল।
এদিকে, ইন্টারপোলের মাধ্যমে জব্বারকে গ্রেফতারে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রায় পড়া শুরু হয়।
ট্রাইব্যুনালের ১৪১ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় মঠবাড়িয়ায় হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণে সহযোগিতায় জব্বারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ৫টির মধ্যে ৫টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে তার বয়সের দিকটি বিবেচনায় রেখে চারটি অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও একটিতে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণাকালে ট্রাইব্যুনাল জানান, আসামিকে গ্রেফতার করা যায়নি, তার অবস্থানও জানা যায়নি। আসামির বিরুদ্ধে ৩৬ জনকে হত্যা ও দুই শতাধিক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করার মতো অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে যা মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার যোগ্য। তবে আসামির বয়সের দিক বিবেচনা নিয়ে চারটিতে আমৃত্যু এবং একটিতে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
১, ২, ৩ ও ৫ নম্বর অভিযোগ মৃত্যুদণ্ড যোগ্য হওয়া সত্বেও বয়স বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন টাইব্যুনাল। জোরপূর্বক ধর্মান্তিরিতকরণের ৪ নং অভিযোগে ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জারিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।
আব্দুল জাব্বার বর্তমানে আসামি কানাডায় পলাতক আছে বলে জানা গেছে। দেশে তার মেয়ে হাজির থাকলেও মামলা পরিচালনায় তিনি কোনও রকম সহায়তা করেননি।
জব্বারকে পলাতক ঘোষণা করে গত বছরের ১৪ আগস্ট তার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচার শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে ২৪ জন সাক্ষ্য দেন। জব্বারের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান।
রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর জাহিদ ইমাম বলেন, রায়ে তারা সন্তুষ্ট। নতুন করে একটি অভিযোগের বিপরীতে আর্থিক দণ্ড সংযুক্ত হওয়ার বিষয়টি তারা বারবার উল্লেখ করেন। তারা আসামিকে গ্রেফতারের জন্য ইন্টারপোল ও আইজিপিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরীন আফরোজ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “বয়স বিবেচনার ক্ষেত্রে ‘বিবেচনা’ শব্দটাই বলা হয়েছে। যদিও বয়স বিবেচনা করার কোনও আবেদন আসামিপক্ষ থেকে ছিল না। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে হলে আমাদের পূর্ণাঙ্গ রায় দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এজন্য যে আসলে ট্রাইব্যুনাল কোন বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েছেন বা কী ব্যাখ্যা উল্লেখ আছে। ১০ লাখ টাকাটা ফাইন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, কমপেনশেন না। এটা রাষ্ট্র-তহবিলে যাবে।”
ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের বিরুদ্ধে ৫টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৩৬ জনকে হত্যা-গণহত্যা, ২০০ জনকে ধর্মান্তরিতকরণ এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে ৫৮৭টি বাড়ি-ঘর ধ্বংস করার মোট ৫টি অভিযোগ আনা হয়। তিনি মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি, নলী ও আঙ্গুলকাটা গ্রামে এসব অপরাধ সংঘটিত করেন বলে উল্লেখ ছিল অভিযোগে।
জব্বারের শ্বশুর ছিলেন স্থানীয় মুসলিম লিগ নেতা। তিনি ১৯৫৬ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। আব্দুল জব্বার ১৯৭১ সালের আগে মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে মঠবাড়িয়া থানায় রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। জব্বার ছিলেন থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। আত্মীয় ইস্কান্দার মৃধাকে তিনি রাজাকার কমান্ডার করেন সেসময়। মামলা শুরুর অনেক আগে থেকেই তিনি পলাতক রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহঃ
১ নং অভিযোগ : জব্বারের নেতৃত্বে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৬ মে মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি গ্রামের দুই মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক বিশ্বাস ও মোতালেব শরীফকে হত্যা করে। এছাড়া গ্রামের নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার আনুমানিক ১৬০টি বাড়িতে লুট এবং অগ্নিসংযোগ করে।
২ নং অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৭ মে ইঞ্জিনিয়ার জব্বারের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ফুলঝুড়ি গ্রামে আক্রমণ করে। তারা গ্রামের শারদা কান্ত পাইককে হত্যা এবং ৩৬০টি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
৩ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২২ মে জব্বার শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের নিয়ে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার নলী গ্রামে আক্রমণ করেন। জব্বার নিজে তার হাতে থাকা রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন গ্রামের সাখানাথ খরাতীকে। জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে গ্রামের নিশিকান্ত বিশ্বাস ও তার ছেলে সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, জিতেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, গণেশ চন্দ্র মিস্ত্রি, উপেন্দ্র নাথ মিস্ত্রি, বসন্ত হালদার, বলরাম মিস্ত্রি, ষষ্ঠী হালদারকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন গ্রামের মোট ১১ জন শহীদ হন। রাজাকাররা গ্রামের ৬০টি বাড়ির মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
৪ নং অভিযোগ : একাত্তর সালের ১৬ মে তুষখালী হাইস্কুল মাঠে ইঞ্জিনিয়ার জব্বার মিটিং করেন। ওই মিটিংয়ে হিন্দুদেরকে তিনি ‘পাকিস্তানের শত্রু’ তাদের অর্থ-সম্পত্তিকে ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তার এ ঘোষণায় রাজাকাররা ফুলঝুড়ি গ্রামের সাতটি বাড়িতে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে। জব্বারের নির্দেশে রাজাকাররা গ্রামের প্রায় দুইশ’ নিরস্ত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে জোরপূর্বক কলেমা পড়িয়ে ধর্মান্তর করে এবং তাদের নাম পরিবর্তন করানো হয়।
৫ নং অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার আঙ্গলকাটা ও মঠবাড়িয়া গ্রাম থেকে ৩৭ জনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও তাদের মালামাল লুণ্ঠন করে রাজাকাররা। জব্বার ইঞ্জিনিয়ার তাদের মধ্য থেকে ৭ জনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন। বাকি ৩০ জনকে সূর্যমনি নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে জব্বারের নির্দেশে গুলি করা হয়। এ সময় ২২ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এবং ৮ জন গুরুতর আহত হন।
প্রতিক্ষণ /এডি/বাবর