দেশীয় মননে বৈশ্বিক নজরুল
হোসাইন আহাম্মদ:
কবিতা প্রেম, কবিতা স্বপ্ন, কবিতা জীবন, কবিতা কল্পনা , কবিতা শিল্পালঙ্কারে ঝংকিত নন্দিত উপমা। সেই নন্দিত উপমার অন্তর্নিহিত রুপকে নজরুল সাজিয়েছেন বর্ণিল রংয়ে। সকল স্থবিরতাকে তিনি গতিশীল করে দিয়েছেন। অমিতবেগে পৃথিবীকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন উল্কার মত। তার হাতের খেলায় জীর্ণতা পেয়েছে যৌবনের মহিমা। পৃথিবীকে তিনি সাজাতে চেয়েছেন আপন ভাবনার ইন্দ্রজালে। তাই নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন পৃথিবীকে , ভালোবেসেছেন, আঁকড়ে ধরেছেন তারপর সুর যোজনা করে তাকে ছেড়ে দিয়েছেন মহাকালের মোহময় ভুবনে। দৈশিক চিন্তা-চেতনা বৈশ্বিক হয়েছে তার কলমের ছোঁয়ায়। দেশীয় মননে তিনি বৈশ্বিক ভাবনা বলয় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। দেশ-কাল-জাতি সীমার উর্ধ্বে উঠে যেমন নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করেছেন, তেমনি দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। উপমার পর উপমা সাজিয়ে তৈরি করেছেন তার কাব্য জমিন। তিনি এ দেশে এ সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে শুধু এই দেশের এই সমাজের নন তিনি সকল দেশের সকল মানুষের। তিনি যশ চান নি ,খ্যাতি চান নি, প্রতিষ্ঠা চাননি , নেতৃত্ব চান নি কিন্তু বিশ্ববাসীকে জাগাতে চেয়েছেন। নজরুল আমাদেরকে হাসিয়েছেন , কাঁদিয়েছেন,ভাবিয়েছেন , বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। আমাদের মনের চোখকে খুলে দিয়েছেন , ধামা ধরা-জামা ধরাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করে বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠেছেন। বাঁশ আর বাঁশিতে বাঁশাবাঁশি করে বাঁশির সুরই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন । বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন পাগল করা সুরে। অকুণ্ঠিত চিত্তে মুক্ত কণ্ঠে নিজের তারুণ্যের স্পর্ধা প্রকাশ করেছেন; সে প্রকাশ কখনোই অসঙ্গত মনে হয়নি। বাংলা কবিতা নতুন রুপে সেজেছে নজরুলের হাতে। রবীন্দ্রনাথের পরে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলা সাহিত্যে নতুন যগের সূচনা করেন। তিনি আপন মালা পরিয়ে কবিতাকে ব্যঞ্জণা দিয়েছেন। সে ব্যঞ্জণা ভারত বর্ষকে ছাড়িয়ে ইরান-তুরাণের গুল বাগিচায়ও ঝংকার তুলেছে ।
নজরুলের কবিতার পরতে পরতে দানা বেঁধে উঠেছে বিপ্লব-বিদ্রোহের অগ্নি সুর। নজরুলের পূর্বসুরীরা বলেছেন – জাগো দেশ,জাগো জাতি, জাগো বিশ্ব। নজরুল বলেছেন- জাগো নিপিড়িত ,জাগো নির্যাতিত-নিষ্পেষিত, জাগো শ্রমিক, জাগো কৃষক, জাগো মুটে,জাগো মালী,জাগো শ্রমিক, জাগো মজুর, জাগো নারী ,জাগো মানুষ। কারণ এরা জাগলেই বিশ্ব জাগবে। জেগে ওঠার আসল জায়গা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন নজরুল। তিনি জানতেন কোন জায়গায় টোকা দিলে টনটন করে বাজবে আর কোন জায়গায় নাড়া দিলে হুংকার দিয়ে উঠবে জনতা এবং কোন জায়গায় আঘাত করলে মানুষ বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবে ; ছিনিয়ে আনবে বিজয়। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও উড়াবে বিজয়ের অমোঘ নিশান, পরোয়া করবে না কোনো অশুভ শক্তিকে। কোন জায়গায় ধাক্কা দিলে মানুষ বুঝতে পারবে – বিপ্লব মানে শিরায় শিরায় উদ্দাম ঝড়, ঝড়ো হাওয়া টর্নেডো, সাইক্লোন ; বিপ্লব মানে কল্লোলিত সমুদ্রের শোঁ শোঁ অশান্ত গর্জন ; বিপ্লব মানে ত্যাগ ও বিজয়ের অমোঘ পুষ্পমাল্য। বুঝবে বিপ্লবই জীবনের মানে । অনুধাবন করবে সত্য প্রতিষ্ঠা বড় কঠিন আর সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিপ্লব ছাড়া কোনো গতিপথ নেই। উপলব্ধি করবে বিপ্লব শুধু বাহ্যিক শত্র“র বিরুদ্ধে নয় নিজের ভিতরকার প্রতিটি কু-চিন্তা, কু-কর্ম আর জড়ত্বের বিরুদ্ধেও । যখন মানুষ বিপ্লবের মানে অনুধাবন করতে পারবে তখন নিজেকে
চিনতে পারবে। নিজেকে চিনতে পারলে কোনো কাজই আর অসাধ্য হবে না। নজরুলের ভাষায়-‘আমি আমার আমিকে চিনেছি আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’। মানুষ রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করবে নিজের অস্তিত্ব। সুন্দরের সাধনাই তখন তার জীবন সাধনা হবে। নজরুল তার জাগরণমূলক প্রত্যেকটি কবিতায় মানুষের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন। বিশ্ব মানবিক বোধের সাযুজ্য স্থাপন করতে চেয়েছেন। নজরুলের জাগরণী কবিতাগুলোর প্রতিটি শব্দ অন্যায়,অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে এক একটা পারমাণবিক বিস্ফোরণ। নজরুল নিজে অসহায় ছিলেন তাই অসহায়ের মর্মবেদনা তিনি প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাদেরকে কিভাবে জাগিয়ে তোলা যায় সেটিও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই রেল লাইনের কুলির জন্যও তার মমত্ববোধ জেগে উঠেছিল আর বাবু সাবের প্রতি ধিক্কারে তার অন্তর রি রি করে উঠেছিল। তিনি লিখলেন…
দেখিনু সেদিন রেলে,কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে !
চোখ ফেটে এলো জল,এমন ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল ?
(কুলি-মজুর/ সাম্যবাদী)
বিশ্বের অবহেলিত, লাঞ্চিত,বঞ্চিত,নিগৃহীত, নির্যাতিত,নিষ্পেষিত মানুষের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন নজরুল মুক্ত মনে তাদের প্রশংসা করেছেন। তুরস্কের কামাল পাশা , আনোয়ার পাশাকে নিয়ে কবিতা লিখে নজরুল তা দেখিয়েছেন। একই ভাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাষক হযরত মুহাম্মদ(সা.) কে নিয়ে পুরো একটি কাব্যগ্রন্থ (মরুভাস্কর) রচনা করে তিনি তার বৈশ্বিক ভাবমণ্ডল প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজেকে বিশ্বের মাঝে দেখার ভিতরে নজরুলের বিশ্ব ভাবনা নিহিত। বৈশ্বিক ভাবনা তৈরির ক্ষেত্রে নজরুলের বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়ন ব্যাপক প্রেরণা যুগিয়েছে। তিনি যেমন আল্লামা ইকবাল ,রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন তেমনি পাঠ করেছিলেন শেলী, ইয়েটস, নেগুচি , কিপলিং, কীটস্, বার্ণডশ, গোর্কি, টলস্টয়, পুশকিন, চেখব, দস্তয়ভস্কি, ইবসেন, এমিলি জোলা, ফ্রয়েড, কার্ল মার্কস, হুইটম্যান; বাদ যায়নি ওমরখৈয়াম, রুমি,জামি, আর হফিজও।
ছোটবেলা থেকেই তার পড়ার অভ্যাস। কিন্তু সৈনিক জীবনেই তাকে সবচেয়ে বেশি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়তে দেখি বিশ্ব সাহিত্য অধ্যয়নে। ১৯১৭ সালে ৪৯ নং বাঙ্গালি পল্টনে যোগ দেয়ার জন্য তিনি হাওড়া থেকে ট্রেনে লাহোর হয়ে নৌশেরা গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কোয়েটা ও করাচী তাঁর পল্টন জীবন পরিব্যাপ্ত ছিল । নজরুলের মন,মানস ও সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ সাধন শুরু হয় করাচিতেই । জন্মভূমির বাহিরে বসে সাহিত্য বিকাশ শুরু হওয়ায় নজরুলের মধ্যে বৈশ্বিক আবহ বেশি পরিমানে দেখা যায়। ছোট বেলায় বদ্ধ ঘরে না থাকার যে সংকল্প নজরুল করেছিলেন তার বিকাশ ঘটেছে নৌশেরা ,কোয়েটা ও করাচী অবস্থানের সময়ে। এসব স্থানে অবস্থানের কারনেই তার কল্পনায় উদিত হয় বিশ্বের বিরাট দিগন্ত। সেই দিগন্তকে তিনি আপন হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছেন , জয় করেছেন। পল্টন জীবনেই তার বিশ্ব মানবতাবোধের উন্মেষ ঘটে। ধর্ম-বর্ণ-, উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে সমবেত হওয়ার অন্তরের আহবান নজরুল এখান থেকেই পেয়েছিলেন। লেনিনের রুশ বিপ্লব ,মোস্তফা কামাল পাশার তুরষ্ক বিপ্লব , সান ইয়াত সেনের পরে মাও সেতুং এর চীন বিপ্লব তার রচনা ধারাকে বৈশ্বিক রুপ দিতে সহায়তা করেছে। নজরুল বিশ্ব পরিমণ্ডলে মুক্তির প্রত্যাশা করেছিলেন —
মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
বিংশ শতাব্দীর
( গান – সর্বহারা )
দিকে দিকে , পথে পথে পুরো বিশ্বময় নিজের আগমন বার্তার তুর্য নিনাদ ঘোষণা করেছিলেন নজরুল। তার আত্মার স্পন্দনে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে ভারতে , তার দোলা লেগেছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। কুহেলির দোলায় চড়ে যে বালক পাতাল ফেড়ে নিচে নামার এবং আকাশ ফুঁড়ে উপরে উঠার স্বপ্ন বুনেছিল সেই বালক বিশ্বকে আপন হাতের মুঠোয় ধারণ করতে পেরেছিল এবং জয় করেছিল। ধুমকেতুর মত আবির্ভাব হলেও ধুমকেতুর মতো চকিতে মিলিয়ে যান নি তিনি , অমরত্মে বন্দী হয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যের অমরায় । বিশ্বের বিজয়ী জাতিগুলো তাকে দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তিনি লিখেছেন -কোন বেদনায় টিকি কেটে চণ্ডুখোর এ চীনের জাতি
এমন করে উদয়-বেলায় মরণ খেলায় উঠল মাতি !
আয়ার্লন্ড আজ কেমন করে স্বাধীন হতে চলছে ওরে ; তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাট্ল শিকল রাতারাতি ! কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য রাতি ।
তুরষ্কের সঙ্গে বাংলার মানুষের সম্পর্ক অনেক আগ থেকেই প্রগাঢ়। তুর্কি জনগণের আনন্দ-বেদনাকে বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের বলে মনে করেছে। তুরষ্ক যখন সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা আক্রান্ত তখন এই সুদূর বাংলাদেশ থেকে কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মত শত শত স্বেচ্ছাসেবক ছুটে গিয়েছিলেন তুর্কি জনগণের পাশে। বাংলার সঙ্গে তুরষ্কের সম্পর্ক আরো গভীর করেছে নজরুলের কবিতা। গ্রীসের বিরুদ্ধে আঙ্গোরা-তুর্ক গভর্নমেন্ট কর্তৃক যে যুদ্ধ চালিয়েছিল সেই যুদ্ধে কামাল পাশার সাহায্যের জন্য ভারতবর্ষ থেকে দশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী সৈনিক প্রেরণের প্রস্তাব শুনে নজরুল আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন। লেখেন ‘রণ-ভেরী’ কবিতা ……ওরে আয় ঐ মহা সিন্ধুর পার হতে ঘন রণ-ভেরী শোনা যায় ওরে আয়
তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন- ‘তোর জান যায় যাক্ পৌরুষ তোর মান যেন নাহি যায় ’। পৌরুষত্বের অহংকার তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাছাড়া আধুনিক তুরষ্ক গড়ার প্রবাদ পুরুষ কামাল পাশার প্রতি নজরুল অনুরক্ত হয়ে পড়েন। কামাল পাশা ভগ্নপ্রায় একটা জাতিকে টেনে তুলে আনেন এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতিগুলোর মধ্যে পরিগণিত করেন। তিনি কামাল পাশার জয়গান করে লেখেন –
সাব্বাস ভাই ! সাব্বাস দিই , সাব্বাস তোর শমসেরে !
পাঠিয়ে দিলি দুষমন সব যমঘর একদম-সেরে !
বল দেখি ভাই বল হাঁরে ,দুনিয়ায় কে ডর করে না তুর্কির তেজ তলোয়ারে ?
(কামাল পাশা- অগ্নি-বীণা)
তাছাড়া তুর্কি বীর আনোয়ার পাশাকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। এছাড়াও তুর্কির সাম্যবাদী কবি নাজিম হিকমাতের কাব্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নজরুলের কাব্য বৈশিষ্ট্যেরও মিল পাওয়া যায় । সর্বোপরি নজরুলের সুবাদে তুরষ্কের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কও জোরদার হয়েছে। নজরুলের কবিতা তুর্কি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তুর্কিরা বাংলাদেশের জাতীয় কবি ,সাম্যবাদী কবি ,এবং বিপ্লবী কবির প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে বিন্দু মাত্রও কার্পণ্য করেনি ।
স্কটল্যান্ডের জাতীয় কবি রবার্ট বার্নসের সৃষ্টি ও জীবন সংগ্রামের সঙ্গে নজরুলের সৃষ্টি ও
জীবনের অদ্ভুদ মিল খুঁজে পান গ্লাসগোর ক্যালিডেনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রবাসী বাঙালি। তিনি লক্ষ্য করলেন নজরুল সাহিত্য বার্নসের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্রময়, গভীর এবং গতিশীল। ড. জসীম সেখানে নজরুল নিয়ে সভা ,সেমিনার ও নজরুলের গানের অনুষ্ঠান করলেন । স্কটল্যান্ডের জনগণ হতবাক হল ,বিস্ময়ে বিমুঢ় হল এবং নজরুলকে বুঝতে পারল। ২০০০ সালে গ্লাসগোর ক্যালিডেনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলভিন গ্যালারিতে নজরুল জয়ন্তী উদ্যাপিত হল। ২০০৪ সালে দুই কবিকে নিয়ে সেখানে “নজরুল-বার্নস সেন্টার” স্থাপন করা হল; এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তজার্তিক সাহিত্য ও ভাষা বিভাগে নজরুল পাঠ্য হল । এমনকি গ্লাসগোর ক্যালিডেনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. গ্যারি ক্যারাথার্স এখন স্কটিশদের কাছে নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। বার্নস ও নজরুল দুজনই দুই বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত হন; একজন ফরাসী বিপ্লব অন্যজন রুশ বিপ্লব। দুজনই দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এদিকে চীনের প্রখ্যাত অনুবাদক পাই খাই ইউয়ান হাত দিয়েছেন নজরুল চর্চায়। তিনি নজরুলের কবিতা ও গান চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। চীনের লোকজনও নজরুলের মধ্যে তাদের চাওয়া পাওয়ার সন্ধান পেয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়াতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্যবাদী কবিদের মধ্যে নজরুল শীর্ষ পর্যায়ে আছেন। রুশ ভাষায়ও তার কাব্যের অনুবাদ হয়েছে ।
২০০৬ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে ১১ টি দেশের প্রতিনিধি নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়
আন্তজার্তিক নজরুল সম্মেলন। আবার ইরানী কবি হাফিজের সঙ্গে নজরুলের ব্যাপক মিল পাওয়া যায়। নজরুল হাফিজ এবং ওমর খৈয়ামের কবিতার অনুবাদও করেন। বসে নেই জাপানিরাও। ভারতের বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়েছে নজরুল। লন্ডনের নজরুল সেন্টার এবং করাচীর নজরুল একাডেমিও বেশ কাজ করে চলেছেন নজরুলকে নিয়ে। বিশ্বের যে দেশের মানুষই নজরুল অধ্যয়ন করেন সেই দেশের মানুষই নিজেকে খুঁজে পান নজরুলের মধ্যে । নজরুলের অবিরল প্রাণ প্রবাহের ধারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এটা নজরুলের বিশ্বজনীনতার অনন্য দৃষ্টান্ত ।
দেশ,কাল জাতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে মানুষ বেড়ে উঠে । নজরুল এর ব্যতিক্রম নন । নজরুল যে বিশ্বজনীন হয়েছেন তাতেও উপমহাদেশের বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে বিরাজমান ছিল । তিনি নিজ সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময় । অমাদের ইতিহাসবিদদের এক সময় ধারণা ছিল বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের জাতীয়তাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বপ্নদ্রষ্টা । অথচ বঙ্কিম শুধু হিন্দু সমাজের জাতীয়তা প্রত্যাশা করেছিলেন মুসলমানদের অবজ্ঞা করে । আর নজরুল ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে সকল ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন । যার ফলে প্রচণ্ড হিন্দুবাদী ইতিহাসবিদ গোপাল হালদারকেও লিখতে হয়েছে ‘বঙ্কিম বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বস্বীকৃত স্রষ্টা নন ,যেমন স্রষ্টা নজরুল ।’ আসলে নজরুলই আমাদের জাতীয় চেতনার কেন্দ্র বিন্দু । প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয় দিক দিয়ে তিনি আমাদের জাতীয়বোধকে জাগরুক করেছেন । আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন সমৃদ্ধির পথে মিলনের; যেমন সৃষ্টি দিয়ে তেমনি জীবন দিয়ে । হিন্দু মেয়ে বিয়ে যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ । শুধু কি তাই যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন । তবে এক্ষেত্রে তিনি কোনো সংর্কীণতার পরিচয় দেন নি । বাঙালি জাতীয়তাবাদের মধ্যেও যে বিশ্বজনীনতা আছে তা নজরুলই প্রথম দেখিয়ে দিলেন । নজরুলের দানে বাঙালি সংস্কৃতি হল বিশ্ব সংস্কৃতি।
ভারত বর্ষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা । নজরুল এর অবসান চেয়েছেন । উভয়ের মধ্যে রাখি বন্ধন করতে চেয়েছেন । তিনি তাদের গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছেন । হিন্দু-মুসলমানের এই সংকট দেখে তিনি মিসরের বীর জগলুল পাশাকে নিয়ে লেখা কবিতায় বলেছেন ……..
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে হে ঋষি
তেত্রিশ কোটি বলির ছাগল চরিতেছে দিবানিশি
গোষ্ঠে গোষ্ঠে অত্ম কলহে অজা যুদ্ধের মেলা
এদের রুধিরে নিত্য রাঙিছে ভারত সাগর বেলা
(চিরঞ্জীব জগ্লুল)
হিন্দু-মুসলিম উভয়কেই তিনি অঙুলি দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের পতনের কারণ। তিনি মনে প্রাণে ভারতের সুদিনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনেছেন । তিনি বুঝেছিলেন হিন্দু-মুসলিম দুয়ের সমন্বয়েই ভারতবর্ষ সুতরাং একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজন কখনোই বেঁচে থাকতে পারে না , তারা একে অন্যের পরিপূরক । তিনি লিখেছেন–মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ -(হিন্দু-মুসলমান)
শুধু হিন্দু-মুসলিম নয় তিনি সকল ধর্মের ,সকল মতের মানুষের মধ্যে ঐক্য কামনা করেছেন । হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন এবং শুনিয়েছেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্লোগান- “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান” এবং হৃদয়ের ধর্মই যে বড় ধর্ম সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন । তিনিই প্রথম যথাযথ সাম্যের গান গেয়েছেন, সাম্যবাদের দাবী তুলেছেন । বিশ্ব মানবতাবাদের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা নজরুল । সমাজতন্ত্রের জন্য সাম্যবাদ নয় মানুষের মানবিক দাবী পূরণের জন্য সাম্যবাদের স্লোগান তুলেছিলেন নজরুল । যদিও রুশ বিপ্লবের ছোঁয়া তার সত্তায় বিরাজমান ছিল তবুও লেলিনের সাম্যবাদের চেয়ে নজরুলের সাম্যবাদ অনেক বেশি পরিপূর্ণ এবং মানুষের আকাক্সক্ষা পুরণে সমর্থ । মানবতার কল্যানের জন্যই সাম্যবাদ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সার্থোদ্ধারের জন্য নয় । সম বন্টনের সাম্যবাদ নজরুল চান নি তিনি চেয়েছেন সুষম বন্টনের সাম্যবাদ । যার যতটুকু অধিকার তাকে ততটুকুই দেয়ার কথা নজরুল বলেছেন এবং সকল কিছুকে ছাপিয়ে হৃদয়ের সংবিধানকে বড় করে দেখেছেন । আমিত্বের যে ধারা বাংলা সাহিত্যে শুরু হয়েছিল তাতে সাম্যবাদের সুর নজরুলই যোজনা করেছিলেন । জারজ-কামজ সন্তানে তিনি কোনো পার্থক্য করেন নি । মানুষ হিসেবে মানুষকে বিচার করেছেন । মানুষের মানবীয় সকল বোধকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন , তাই পাপী-তাপী সবাই তার ভাই সবাই তার বোন হয়েছে । নারী পুরুষের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন নজরুল । বাংলার মেয়েদেরকে শিক্ষিত ও শিল্পিত ভাবে দেখতে চেয়েছেন । নারীর অধিকারের প্রতি সচেতন থেকে নারী পুরুষের কোনো ভেদাভেদ করেন নি । নারীদেরকে সচেতন করে তুলেছেন তিনি । তাদেরকে ঘোমটা ছিঁড়ে মুক্ত বায়ুর স্বাদ নিতে বলেছেন । পুরুষের সকল বিজয়ের পিছনে নারীর গোপন অবদানের কথা তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন । তার উদার বাণী-
তাজমহলের পাথর দেখেছো ,দেখিয়াছ তার প্রাণ ?
অন্তরে তার মমতাজ নারী , বাহিরেতে শা-জাহান ।
( নারী – সাম্যবাদী )
দেবত্বের উপরে মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার ধারাকে বেগবান করেছিলেন তিনি । দেব-দেবির বুকে হাতুড়ি ঠুকে মানুষকে দেবত্বের তাজ পরিয়েছিলেন । তার চরণের তলে ভগবানও মার খেয়ে মরেছে । তিনি যেমন একাই বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠেছেন তেমনি একাই ধুমকেতুর অগ্নিচ্ছটা ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বময় । সকল অনাসৃষ্টির বিরুদ্ধে তার নির্ভিক উচ্চারণ-
মম পুচ্চে জড়ায়ে সৃষ্টি
করি উল্কা-অশনি বৃষ্টি
অমি একটি বিশ্ব গ্রাসিয়াছি ,গ্রাসিতে পারি এখনো ত্রিশটি ।
(ধুমকেতু-অগ্নি-বীণা)
অধীন বিশ্বকে উপাড়ি ফেলে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা আনার যে তপস্যা করেছিলেন নজরুল তা এখনো স্মরণীয়, বরণীয়। ফুল, পাখি, প্রকৃতি নয় মানুষই নজরুল কবিতার প্রধান বিষয় । নদী,সমুদ্র , মহাকাশকে মন্থন করে এনে মানুষের পায়ে লুটিয়ে দিয়েছেন তিনি । অবলোকন করেছেন মানব মহিমার মাহাত্ম । ভরিয়ে দিয়েছেন মানুষের আত্মাকে গানে গানে, প্রাণে প্রাণে । নিখিল মানবতার রুপ উন্মোচন করেছেন তিনি। মিশরের সাম্যের নেতা জগলুল পাশাকে উদ্দশ্য করে লিখেছেন……
তবুও এশিয়া আফ্রিকা গাহে তোমার মহিমা গান,
মনুষ্যত্ব থাকিলে মানুষ সর্বশক্তিমান ।
নজরুল তার কবিতায় পুরান ব্যবহারেও হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-ইহুদি-গ্রীক ঐতিহ্যকে পাশাপাশি স্থাপন করে বৈশ্বিক অবহ তৈরি করেছেন । তার বৈশ্বিক ভাবনা এতই প্রবল যে জগতের সকল সংস্কৃতিকে তিনি এমনভাবে পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছেন একটি থেকে অপরটি আলাদা করা সাধারণ পাঠকের পক্ষে দুরুহ । তাদের কাছে সকল সংস্কৃতিই নিজের সংস্কৃতি মনে হবে । আরবি-ফারসি শব্দের প্রচুর প্রয়োগ এবং বিভিন্ন ভাষার ছন্দে বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে তিনি বিশ্বজনীনতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বিশ্ব মানবতার কবি । নজরুল বলেছেন তিনি এই দেশে এই সমাজে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে শুধু এই দেশের এই সমাজের নন তিনি সকল দেশের ,সকল কালের, সকল মানুষের । তাই একজনকে ব্যথা দিলে সমগ্র মানবের কাছে সে বেদনা সমান ভাবে বাজতে তিনি দেখেছেন । তিনি লিখেছেন…….
সকল কালের সকল যুগের সকল মানুষ আসি
এক মোহনায় দাঁড়ায়ে শোন এক মিলনের বাঁশি একজনে দিলে ব্যাথা সমান হইয়া বাজে সে বেদনা সকলের বুকে হেথা একের অসম্মান
নিখিল মানব জাতির লজ্জা সকলের অপমান ।
(কুলি-মজুর/ সাম্যবাদী)
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “অগ্নি-বীণাতে” তিনি অন্তত ২৮বার নিজেকে বৈশ্বিক বলে দাবি করেছেন । এ দাবি যেমন কলা সম্মত হয়েছে তেমনি বাস্তবেও প্রতিফলিত হয়েছে ।
তার এই বিশ্ব ভাবনা দেশ,কাল জাতি থেকেই এসেছে। দেশীয় কবিতার ঘ্রাণে,ঝাঁঝে,তীব্রতায় তিনি মাতোয়ারা করেছেনে বিশ্ব কাব্য পরিমণ্ডলকে । বিশ্বকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছেন বাংলা ভাষাতেই । দেশ ও দেশের মানুষের অধিকার আদায় করতে গিয়েই তার মাথায় বিশ্ব ভাবনার উদয় হয়েছে । নজরুল দেশীয় আলো হাওয়ার স্বাদ দিয়ে বিশ্ব সাহিত্যে বাজিমাৎ করেছেন । বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বাংলা ভাষার শক্তি । দেশীয় ভাব পরিমন্ডলে পরিব্যাপ্ত হয়ে নজরুল বৈশ্বিক মানুষের আবহমান সুরকে ধরতে পেরেছিলেন । দেশীয় ভাবনা বলয় মাথায় কাজ করলেও তিনি বৈশ্বিক । তবে সেই বিশ্ব ভাবনা বাংলাদেশের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত । তিনি দেশীয় মননে বৈশ্বিক । সুতরাং নজরুল প্রতি মুহুর্তেই দৈশিক, প্রতি মুহুর্তেই বৈশ্বিক, অবিরল ভাবে দৈশিক, অবিরল ভাবে বৈশ্বিক , এমনকি কি ন্যায়, অন্যায় সকল বিচারেই তিনি দেশীয় মননে বৈশ্বিক ।
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১. নজরুল ইসলাম কালজ কালোত্তর , আবদুল মান্নান সৈয়দ, পুনমুদ্রণ ডিসেম্বর ২০০৮, বাংলা একাডেমী, পৃ. ১৫
২. নজরুল সাহিত্য বিচার , শাহাবুদ্দীন আহমদ, মে ১৯৯৯,ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ , পৃ. ৩১২-৩১৮
৩. নজরুল রচনাবলী (১ম খণ্ড) আবদুল কাদির সম্পাদিত, ১৯৯৬ ,বাংলা একাডেমী। পৃ. ২৪৭,
৪. নির্বাচিত নজরুল , তিতাস চৌধুরী , জানুয়ারি ২০১৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পৃ. ২৪০
৫. বিশ্বময় নজরুল – আবদুল হাই শিকদার , প্রকাশ-২০১০, শিকড় প্রকাশনী, পৃ. ৩৫
৬. নজরুল ও বিশ্বসংস্কৃতি , ডক্টর রাজীব হুমায়ুন, বিশেষ সংস্করণ ফেব্র“য়ারি ২০০৫, সূচীপত্র, পৃ. ২২-২৩, ১১৪-১৩৩।
৭. কাজী নজরুল ইসলাম (জন্মশতবর্ষ), ওয়াকিল আহমদ সম্পাদিত, ফেব্রয়ারি ২০০০, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি , পৃ. ১২৮,১৩৮ ।
৮. কাজী নজরুল ইসলাম জন্ম শত বার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ ,সম্পা: আবদুল মান্নান সৈয়দ, ফেব্রয়ারি ২০০১, এ্যডর্ন পাবলিকেশন, পৃ. ৯৫ ।
হোসাইন আহাম্মদ
প্রভাষক
বাংলা বিভাগ
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ