ধান নেই মাছ নেই! খাব কি?
মাহমুদ এইচ খান, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
বাবারে আমাদের সব ধান এবারও পানিয়ে লইয়া গেলগি। এর আগের বছরও আমরা ধান তুলিয়া নিতাম পারছি না, এবারও না। কত আশা লইয়া ধান ফলাইছলাম এখন হাওরে ধানও নাই মাছও নাই। খাব কি?
এমন আহাজারি করে নিজের সর্বশান্ত হওয়ার কথা বলছিলেন কাউয়া দিঘী হাওর পাড়ের কইসাপুর গ্রামের কৃষক গোলাপ হোসেন।
টানা বারি বর্ষণ, শীলা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের হাওড়গুলোর ১৭হাজার ৪শত ৩২ হেক্টর বোরো ধান বিনষ্ট হয়েছে। বৃষ্টি থেমে রোদের দেখা মিললেও দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় এসব ধান ঘরে তুলতে পারবেন না কৃষকরা। যার ফলে জেলার সর্বত্র জুড়ে কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বৃষ্টি থামার তিনদিন হয়ে গেলেও হাওড় থেকে পানি নামেনি। এখনো ধান পানির নিচে রয়েছে। কৃষকদের অতিকষ্টে ফলানো ধানের উপর দিয়ে চলছে নৌকা। কৃষকেরা ধানের আশা ছেড়ে হাওরে মাছ ধরছেন। অনেক কৃষক হতাশাগ্রস্থ হয়ে জমির ধারে কাছেও আসছেন না। যদি সামান্য ধান তোলা যায় এমন আশায় কেউ কেউ বিষন্ন মনে চেয়ে আছেন হাওড়ের দিকে। এমন অবস্থায় রয়েছেন জেলার সবকটি প্লাবিত হাওড় ও নিম্নাঞ্চলের কৃষকরা।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার কাঞ্জার হাওর, মানিক হাওর, হাইল হাওর ও কাউয়াদিঘি হাওর পানির নিছে তলিয়ে গেছে ৬২২ হেক্টর, শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওড়ে ৩০৭ হেক্টর, রাজনগর উপজেলার সোনাদিঘি, কাইয়াদিঘি ও সিঙ্গাহুরা হাওড়ে ১৩৬৬ হেক্টর, কমলগঞ্জ উপজেলার কেওলার হাওড়ে ৩০০ হেক্টর, কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওর, ডলডল হাওর, রফিনগর হাওর, খাদিমপাড়া হাওর, আলিয়ার হাওর, বহিষমারা বলি, মেঘাবিল, হাওর বিল, কালাপানির বিল, পালের বিল, হাগুয়া বিল ও লাউয়র বিলসহ অন্যান্য এলাকায় ৪৫০০ হেক্টর, বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওর, মালাম বিল ও হুয়ালা বিলে ৩৪১৫ হেক্টর, জুড়ী উপজেলা হাকালুকি হাওর ও কইরকোনা হাওড়ে ৪৬৫০ হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। হাওরাঞ্চলে ১৫হাজার হেক্টর ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চলে আরো ২,৪৩২ হেক্টর তলিয়ে যাওয়ায় সর্বমোট ১৭৪৩২ হেক্টর বোরো ধান বিনষ্ট হয়েছে।
বিশেষ করে জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার কৃষকরা নতুন ধান ঘরে তোলার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ধান কাটার উপযোগী না হওয়া কেউই ঘরে নতুন ধান তুলতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঐ তিন উপজেলার বেশির ভাগ কৃষক বিভিন্ন ব্যাংক, সমিতি ও ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ এনে জমি চাষাবাদ করেছেন। কিন্তু ধান পানির নিছে তলিয়ে যাওয়ায় কিভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন আবার কিভাবে সংসার চালাবেন এনিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।
কাউয়াদিঘী হাওড়পাড়ের কৃষক জোবেল মিয়া বলেন, আগের বছরো আমাদের ধান হয়নি। এই বছর তো হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। পানি এখনো থৈ থৈ করছে হাওর জুড়ে। ঋণ করে চাষ করেছি এখন তা কিভাবে পরিশোধ করব জানিনা। সরকার আমাদের বিষয় বিবেচনা না করলে না খেয়ে মরতে হবে।
এ বিষয়ে হাওর বাঁচাও, কৃষি বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের একাধিক ব্যক্তির সাথে আলাপ হলে তারা বলেন, ফেঞ্চুগঞ্জের বুড়িকিয়ারী নদী খনন না করার কারণে হাকালুকি হাওরের পানি নিষ্কাষন হতে পারে না। যার ফলে দু-একদিনের বৃষ্টির কারণে পুরো হাওরটি তলিয়ে যায়। তাদের দাবি এ অঞ্চলের কৃষকদেরকে বাঁচাতে হলে যতদ্রুত সম্ভব ওই খালটি খনন করে পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ শাহজাহান তথ্যটি নিশ্চিত করে বলেন, পানি কমতে থাকলে যে ফসলগুলো তলিয়ে গেছে তা রক্ষা করার সম্ভাবনা নেই। আমাদের ধারণা এতে করে ১৮৫ থেকে ২০০ কোটি টাকা ক্ষয়-ক্ষতি হতে পারে।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাই