নদী নিয়ে ভাবতে হবে নদী দিবসে
“ওরে তোরা জানিস কেউ
জলে কেন উঠে এত ঢেউ
ওরা দিবস রজনী নাচে
তাহা শিখেছে কাহার কাছে”
নদী যে জীবন্ত সত্তা, তার আইনি স্বীকৃতি এলো সেদিন মাত্র। ‘হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ নামক সংগঠনের এক রিট (পিটিশন নং ১৩৯৮৯/২০১৬) আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রায়ে – তুরাগ সহ দেশের সব নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে বিবেচনার নির্দেশ দিয়েছিলেন ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি।
এমনকি পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুয়েকটি কবিতার চরণও স্থান পেয়েছে, যেমন,
“নদীকে দেখিনি
জলের কিনারে গিয়ে দেখেছি তোমার মুখ
তোমাকে পাবার জন্যই এভাবেই বারবার নদীকে দেখেছি”
একই সাথে সেই ঐতিহাসিক রায়ে পানিকে ‘তরল ডলার’ বলে ভবিষ্যত গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে। আমরা জনসাধারণও নদী নিয়ে বেশ আবেগপ্রবণ। প্রেম হলে যেমন নদীর ধারে ছুটে যাই প্রেম করতে, তেমনি বিচ্ছেদেও সঙ্গী হয় সে নদীর পাড়-ই।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে জালের মত ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নদ-নদী বিলুপ্ত হয়েছে আঞ্চলিক পরাশক্তি সদৃশ প্রতিবেশি সমূহের আগ্রাসন ও আমাদের দূষণের অত্যাচারে। অসংখ্য নদ-নদী থেকে গত ৫ দশকে সংখ্যার বিচারে টিকে থাকা ৪০৫টি নদীর মধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে ১৭৫ টি নদ-নদী। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। ২৪ হাজার কিঃমিঃ নৌ-পথ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার কিঃমিঃ এ। শুষ্ক মৌসুমে যা ৪ হাজার কিমিঃ এ এসে দাঁড়ায়। এ তথ্য আমার নয়, ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত তথ্য।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী- দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৭টি জেলায় নদ-নদী বিভিন্ন মাত্রায় দখল ও দূষণের করাল গ্রাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর এক গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৫ লক্ষ ঘনমিটার গৃহস্থালি বর্জ্য, প্রায় ৭ হাজার শিল্প ইউনিট থেকে নির্গত ১৩ লক্ষ ঘনমিটার শিল্প বর্জ্য শুধু ঢাকার বুড়িগঙ্গার বুকে নিক্ষেপ করা হয়। এছাড়া ট্যানারি গুলো থেকে নদীতে পড়ছে ২১ হাজার কিউবিক মিটার বিষাক্ত বর্জ্য। এছাড়া ১৪০টির বেশি গোপন-প্রকাশ্য টানেল বা ড্রেন দিয়ে শিল্প কারাখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে।
খোদ হাইকোর্টের রায়ে ১৫১টি ট্যানারির বর্জ্য নদীতে ফেলার কথা তুলে ধরা হয় এবং এর ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক ,যেমন- সালফিউরিক এসিড,ক্রোমিয়াম, এমোনিয়াম সালফেট, ক্লোরাইড, ক্যালসিয়াম অক্সাইডের মিশ্রণ কীভাবে দূষিত করছে, তাই অকপটে স্বীকার করা হয় ।
এ তো গেলো নদীর উপর আমাদের অত্যাচারের কথা। নদীর পানি নিয়ে প্রতিবেশিদের আক্রমণাত্মক আচরণ ও কর্মকান্ড আমাদের নদী তথা জীবন জীবিকাকে ফেলছে বহুমাত্রিক হুমকিতে। চতুর্মুখী পানি আগ্রাসনের ফলে আমাদের নদীগুলো আরো বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।
নিকট প্রতিবেশির সাথে ৫৪টি নদীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যায্য হিস্যা পায় না। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন হতে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে নিয়েই যাচ্ছে আমাদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি। এরপর এলো তিস্তা, টিপাইমুখ বাঁধ। এখন আশঙ্কার আরেক নাম তাদের ‘আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প’। এ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস সর্বজনবিদিত। টিঁপাইমুখ বাঁধের ফলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে মরুকরণ ও মাত্রাতিরিক্ত বন্যা, উভয় দুর্যোগে আক্রান্ত হছে কয়েক বছর ধরে।
এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের অভাব নেই। ১৯৬৬ সালে ‘The Helsinki Rules On The Uses of The Waters of International Rivers’ তৈরি হয়, যা ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয় এবং প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। অবশ্য ২০০৪ সালে এই আন্তর্জাতিক আইনটি ‘Berlin Rules on Water Resources’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়।
‘Berlin Rules on Water Resources’ আইনের ১৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়- “Basin States, in managing the waters of an international drainage basin, shall refrain from and prevent acts or omissions within their territory that cause significant harm to another basin State having due regard for the right of each basin State to make equitable and reasonable use of the waters.”
অর্থাৎ উঁচু অববাহিকার দেশ নিচুতর অববাহিকার দেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবে না নদী নিয়ে।
১৯৯২ সালে ‘THE DUBLIN STATEMENT ON WATER AND SUSTAINABLE DEVELOPMENT’ এ বলা হয়েছে- “Water development and management should be based on a participatory approach, involving users, planners and policy-makers at all levels.”
অর্থাৎ, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে সবক্ষেত্রে।
উপরোক্ত দুটো আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াও আরো ভঙ্গ করা হচ্ছে বাংলাদেশের নদীর পানি নিয়ে,
* Convention On The Protection and Use of Trans Boundary Water Courses and International Lakes এর ৭ (১) (২) (৩) (৪) অনুচ্ছেদ সমূহ
* Convention on Bio-Logical Diversity 1992 এর ১৪ নং অনুচ্ছেদ
* Ramsar Convention 1971 এর ৫ নং অনুচ্ছেদ
প্রতিবেশি মহাজন রাষ্ট্রের এমন অন্যায্য ও অবিবেচনা প্রসূত নদী আগ্রাসনের ফলে,
* উত্তরাঞ্চলের প্রায় ২ কোটি মানুষ পানি পাচ্ছে না
* দক্ষিণাঞ্চলের ৪ কোটি মানুষ ও এক তৃতীয়াংশ কৃষি এলাকা সেচের অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে
* দেশের ২১ শতাংস অগভীর নলকূপ এবং ৪২ শতাংশ গভীর নলকূপ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
* প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১০ সালের এক মূল্যায়ন পত্রে উল্লেখ করেছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ ৯৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা
যুগ যুগ ধরে নদী যেমন তার বুকভরা প্রাচুর্য দিয়ে সাজিয়েছে এ সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলাকে, তেমনি সেই নদী আবার তার বুকভরা কষ্ট উজাড় করে বন্যার নির্মমতায় ভাসিয়েছে সমৃদ্ধ এ জনপদ। দখল-দূষণ, বাঁধ ইত্যাদির অত্যাচারে নদীর প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখন প্রতিশোধের বন্যা-খরা’ই যেন তার হাঁফ ছেড়ে বাঁচার একান্ত প্রয়াস। আসুন আমরা নিজেরাই নিজেদের নদী গুলোর গলা টিপে ধরা বন্ধ করি, আর প্রতিবেশি দেশ গুলো যাতে নদী গুলোকে বিবস্ত্র করতে না পারে, সেজন্য সোচ্চার হই।
এস এম নুরুন নবী
সাবেক শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চবি
প্রতি/ এডি/রন