জুট মিলের ফেলে দেয়া পাটে ভাগ্য বদল

প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৫ সময়ঃ ১২:১১ অপরাহ্ণ.. সর্বশেষ সম্পাদনাঃ ১২:৩২ অপরাহ্ণ

প্রতিক্ষণ ডটকম:

তুলা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানের ঝুট মিলের ফেলে দেয়া অংশ (ধুনা) দিLAP TOSAK PICয়ে তৈরি লেপ তোশক বদলে দিয়েছে আড়াইহাজার উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের বগাদীসহ আশেপাশের গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের ভাগ্য।

একটা সময় এই পরিবারগুলো অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতো। অর্থঅভাবে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারতো না। অভাবের সংসারে গৃহধূরা বিভিন্ন মিল, কারখানায় সুতা ভরার কাজ করতেন আর পুরুষরা কেউ রিক্সা, কেউ বদলী, কেউ কৃষি কাজ করে কোনো মতে সংসার চালাতো। অভাব যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছিল না তাদের। বর্তমানে পরিবারগুলোতে সুখের হাঁসি। অভাব ঘুচিয়ে তারা সঞ্চয় করছেন।

বগাদী গ্রামের ইসমত আলীর কাছে শুনছিলাম, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি ঝুট মিলের ফেলে দেয়া ধুনা দিয়ে তৈরি করা লেপ তোশক বিক্রি করে সংসারের সকল খরচ” চালাচ্ছেন। এই কাজের আগে তিনি রিক্সা চালাতেন। রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাতে অনেক বেগ পেতে হত তাকে। এখন ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছেন। বাড়ির পাশে ৩৫ শতাংশের একটি ধানি জমি বন্ধ নিয়ে তাতে শাক-সবজির আবাদ করছেন। সেখান থেকেও তার ভাল আয় হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তার দেখাদেখি বগাদী এলাকাসহ এর আশেপাশের গ্রামের অনেক পরিবার ধুনা দিয়ে লেপ তোশকের ব্যবসায় জড়িত হয়েছেন। ওই গ্রামের তৈরিকৃত লেপ তোশক দেশের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বিক্রি করা হয়।

একি গ্রামের সাইদ মিয়া বলেনছিলেন, তিনি বেকার ছিলেন। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা বাতেন মিয়ার আয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হতো । বাবা, মা সহ সাত সদস্যে পরিবার তাদের। সংসারে অভাবের কারণে তেমন লেখাপড়া করতে পারেনি তিনি। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের পুরো ভারটাই তার ওপর । বেকারত্বের কারণে নিয়মিত বকাঝকা শোনতে হতো তাকে ।

এক পর্যায়ে বড় পরিবারের নিত্য খরচ জোগাতে বাবা বাতেন মিয়া হাঁপিয়ে উঠেন। উপায় অন্তর না পেয়ে একই গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আবুল মিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী তিনি এক বন্ধুর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা কর্জ নিয়ে ধুনা দিয়ে লেপ তোশক তৈরির কাজ শুরু করেন। স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভ জনক হওয়ায় পরে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২০১১ সালে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তিনি ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করেন। তার অধীনে ৬ জন লোক বিভিন্ন মজুরিতে লেপ তোশক তৈরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বর্তমানে তার সংসারে অভাব নেই। একটি ভটভটি গাড়ী রয়েছে তার। সেখান থেকেও প্রতিদিন ভাল আয় হচ্ছে।

একই গ্রামের ইসহাক মিয়া বলেন, বেকার জীবন একটা অভিশাপ মতো ছিল তার কাছে। গাঁয়ের লোকজন তাকে নিয়ে হাঁসি তামশা করতো। কেউ টাকা ধার দিতে চাইতো না । দোকানে বাকী চাইলে দোকানদার মুখ ফিরিয়ে নিতো। এক কাপড় পড়ে তিনি কাটিয়েছেন দিনের পর দিন। এই ব্যবসা করে তার সংসারের অভাব দূর করেছেন।

মজুরি ভিত্তিতে ওই গ্রামে লেপ তোশকের কাজ করেন জয়নব বেগম। তিন বলেন, দীর্ঘ ৭ বছর ধরে তিনি লেপ তোশক তৈরির কাজ করছেন। তার অধীনে ৮ জন মহিলা লেপ তোশক তৈরির কার করে থাকেন। এ ব্যবসা করে তিনি স্বাবলম্বী হয়েছেন। এি গ্রামের লেপ তোশকের কাজে জড়িত রোকেয়া বেগম বলেন, একাজ করে তিনি প্রতিদিন একশ’ ২০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন। তার সাথে তার মেয়ে রেখাও কাজ করে। এতে তাদের সংসারে দূর হয়েছে।

গ্রামের লেপ তোশক বিক্রেতা গিয়াসউদ্দিন বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঝুট মিলের ধুনা ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়। এসব ধুনা মিল মালিকরা এক সময় ফেলে দিতো। এখন এগুলো লেপ তোশক তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে । উপকরনটি দামে কম হওয়ায় তেমন পুঁজির প্রয়োজন হয় না। তিনি জানান, একটি লেপ অথবা তোশক ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকার মধ্যে পাইকাররা তাদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যায়। এতে তাদের লাভ হয় ভালো।

বগাদী কান্দাপাড়া এলাকার জোলেখা বেগম বলেন, তার স্বামী দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর ধরে প্যারালাইসিসে ভোগছেন। ২ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে তার সংসার। স্বামী আক্কাছ আলী রিক্সা চালাতেন। এখন ঘরে শোয়ে বসে দিন কাটাতে হয় তার। সংসারের অভাবতো আর বসে থাকে না। অভাব যেন পিছু ছাড়ছিল না তার। অভাবের তাড়ণায় ওই গ্রামের আলাউদ্দিনের বাড়িতে বেশ কিছু দিন লেপ তেরির কাজও করেছেন তিনি। পরে স্বামীর রিক্সাটি ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে পুঁজি নিয়ে লেপ তোশক তৈরির কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার পুঁজি বাড়তে থাকে। এখন তার অধিনে ৭ জন মহিলা এই কাজ করছেন।

ব্যবসার আয় দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন আমম্বিয়া বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী রমিজউদ্দিন এ ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। বয়স বেশি হওয়ায় তিনি আর পরিশ্রম করতে পারে না। তাই বর্তমানে আমম্বিয়া নিজেই ব্যবসায় হাল ধরেছেন। । ছোট দুই মেয়ে নার্গিছ ও রুমাকে নিয়ে এ ব্যবসা চালাচ্ছেন ।

জোহরা বেগম জানান, শীত মৌসুম এলে ওই গ্রামের ব্যবসায়ীদের আয়-রোজগার বেড়ে যায়। ব্যস্ততা বেড়ে যায় কারীগরদেরও। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে লেপ তোশক তৈরির কাজ। তিনি জানান, কেউ তোশকের কাপড়ে বিভিন্ন কালারের রং করছেন, কেউ কাপড়গুলো লেপের সাইজ অনুযায়ী কাটিং করে, আবার কেউ সেগুলো সেলাই করে থাকেন। কেউ সেলাইকৃত কাপড়ের থলেতে ধুনা ভরাট করেন। একটি বড় আকারের লেপ অথবা তোশক তৈরি করতে তাদের সময় লাগে ১ঘন্টা। একজন কারিগর দৈনিক ৫ থেকে ৬টি লেপ অথবা তোশক তৈরি করতে পারেন।সুরুজ মিয়া জানান, তাদের গ্রামে তৈরিকৃত লেপ তোশক দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়ে থাকে।

তাদের তৈরি লেপ তোশক অল্প টাকা কেনা যায় বিদায় স্থানীয়ভাবে এর চাহিদা বেশ তুঙ্গে। বছরের শীত মৌসুম এলে এই ব্যবসায়ীদের নাওয়া- খাওয়ার সময় থাকে না। বগাদী গ্রামের শত শত পরিবার দিনভর শীত নিবারনের এই বস্ত্রটি তৈরি করছেন।

প্রতিক্ষণ/এডি/শিমুল

আরো সংবাদঃ

মন্তব্য করুনঃ

পাঠকের মন্তব্য

20G