প্রভাবশালীর বাইকে পিষ্ট সাধারণের স্বপ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জীবনের এখন আর মূল্যই নেই বললেই চলে। তাদের জীবন যেন এখন প্রতিদিন প্রভাবশালীদের গাড়ির রেসের সময় গাড়ির নীচে পরে অথবা প্রভাবশালীর বখাটে ছেলের বাইকের ধাক্কায় শেষ হবে এটায় নিয়ম হয়ে গেছে। আর প্রতিবারই যখন সাধারণ মানুষে জীবন যাচ্ছে তখন প্রভাবশালীদের এইসব বখাটে, মদপ্য সন্তানরা হয়ে যাচ্ছে শিশু।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মতিঝিলে এজিবি কলোনি হাসপাতাল জোন বি টাইপ কোয়ার্টারের গেটের সামনে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলেন গণপূর্ত বিভাগের হিসাব সহকারী (সেগুনবাগিচা, মেডিকেল বিভাগ) রুনা আক্তার ও তাঁর বোন তানিয়া আক্তার।
বিবিএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সন্ধ্যা ছয়টার দিকে দুই বোন কলোনির (৯৮/বি-২) বাসা থেকে বের হই। কলোনির গেটে রিকশা না পেয়ে রাস্তা পার হওয়ার জন্য আইল্যান্ডের কাছে দাঁড়াই। পরপর চারটা মোটরসাইকেল বিকট হর্ন বাজিয়ে অনেক স্পিডে পাশ দিয়ে চলে যায়। তারপর আমার বোন আইল্যান্ড থেকে এক পা নামায়। ঠিক তখনই আরেকটি মোটরসাইকেল চলে আসে। হর্ন বাজায়নি, হেডলাইটও ছিল না। স্পিডে এসে আমার বোনের ওড়না ধরে টান দেয়। ও গিয়ে ওড়নাসহ হোন্ডার ওপর পড়ে। তখনই স্পিড বাড়িয়ে দেয়। বেশ কিছু দূর ওভাবেই বোনকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। ওর ওড়না চাকার সঙ্গে পেঁচিয়ে গেলে ওকে ধাক্কা দিয়ে আইল্যান্ডে ফেলে দেয়। বিকট শব্দ হয়। তারপর আবার ওর পায়ের ওপর দিয়ে হোন্ডাটি চালিয়ে সামনে নিয়ে যায়। এতে দুই পা ভেঙে যায়। তখনই ও মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘আমার হাতের আঙুল ধরে ছিল ও। আমার হাত থেকে বোনকে টেনে নিয়ে গেল। আর কোনো কথা হলো না।’ রুনার ওড়না পেঁচিয়ে মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে যায়। তখন পেছনের আরোহী পালিয়ে গেলেও এলাকাবাসী ও পুলিশ চালককে ধরে ফেলে।
তানিয়া আক্তার বলেন, প্রথমে রুনা আক্তারকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রুনা আক্তারের স্বামী লুৎফর রহমান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলায় (৯ নম্বর) অভিযুক্ত মোটরসাইকেলের (ঢাকা মেট্রো ল-২৭-২২৩৫) আরোহী হিসেবে আল আমিনের (১৯) নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে।
রুনা আক্তারের বাবা মোহাম্মদ সোবহান গণপূর্ত বিভাগে কাজ করতেন। পরে মেয়ে রুনা আক্তার একই বিভাগে যোগ দেন। বাবার নামে বরাদ্দ বাসা পান রুনা আক্তার। তিনি বৃদ্ধ বাবা, মা ও ছোট বোনকে নিয়ে কলোনিতে থাকতেন। বিয়ে হয়েছে চার বছর আগে।
মোহাম্মদ সোবহান বলেন, ‘এখন এত ছোট নাতিরে কেমনে মানুষ করমু? ও মরল, আমারেও শেষ কইরা দিল। আমরা তিনটা মানুষ মেয়ের বাসায় থাকতাম। এলাকার বখাটেরা প্রত্যেক দিন মোটরসাইকেলের মহড়া দেয়। হর্নের আওয়াজে রাস্তায় চলা যায় না। আমার পাঁচটা মেয়ে ছিল, একটারে মাইরাই ফালাইল বখাটেরা। আসামির পরিবার প্রভাবশালী, তারপরও আমি এর বিচার চাই। জানি না আমি বিচার পামু কি না।’
রুনা আক্তারের মা শাহিদা বেগম বলেন, ‘আমার মেয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। সব শ্যাষ হইয়া গেছে। আমারটারে তো আর ফিরে পামু না। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।’
ঘটনায় অভিযুক্ত আল আমিনের বাবা শাহ আলম বলেন, ‘আমার ছেলে গাড়ি চালাইয়্যা নিয়া যায়। এখন ওর গাড়ি না অন্য গাড়ি ধাক্কা মারছে তা তো বলতে পারব না। আমি তো আর ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তবে আমার ছেলে যদি একটা ভুল কইরাই ফালায়, আমি চাই রুনার ছোট মেয়ের সারা জীবনের ভরণপোষণের ভার নিতে। আমার ছেলের বয়স ১৮ বছরও পূর্ণ হয় নাই। মাত্র কলেজে পড়ে।’
প্রভাবশালীদের এমন মদপ্য, বখাটে ছেলেদের কার কিংবা বাইক রেস শুধুমাত্র মতিঝিল এলাকাতেই না ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। এবং প্রতিদিনই এরা সাধারণ মানুষকে কোন না কোনভাবে হয়রানী করছে। আবার কেউ কেউ কেড়ে নিছে সাধারণ মানুষের চোখের স্বপ্ন কিংবা এমন কোন শেষ ভরসাকে।
তবুও থেমে থাকে না ফারিজ কিংবা আল আমিনদের রেস। কারণ তারা প্রভাবশালীদের “শিশু”। তাদের বিচার হয় না কারণ তাদের রয়েছে টাকার প্রভাব।
প্রতিক্ষণ/এডি/এনজে